শনিবার, ৫ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

বিভক্ত বিশ্বে বাংলাদেশ কার পক্ষে?

সৈয়দ বোরহান কবীর

বিভক্ত বিশ্বে বাংলাদেশ কার পক্ষে?

১৯৭৪ সাল। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজ করছেন জাতির পিতা। দেশে খাদ্য সংকট। আবার রপ্তানি বাড়ানো জরুরি। এ রকম উভয় সংকটের মধ্যেই বাংলাদেশ পাট রপ্তানি করল কিউবায়। এটি হলো বাংলাদেশের জন্য কাল। কিউবায় পাট রপ্তানির অজুহাতে পিএল ৪৮০-এর চুক্তির আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গম সহায়তা বন্ধ করে দিল। খাদ্যাভাব সৃষ্টি হলো। পিএল ৪৮০ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্যসহায়তা চুক্তি। এ চুক্তি অনুযায়ী কিউবাসহ আরও কিছু দেশে পণ্য রপ্তানি বারণ ছিল। এসব দেশে পণ্য রপ্তানি করলে খাদ্যসহায়তা বন্ধের নির্দেশনা ছিল ওই চুক্তির শর্তে। কিন্তু খাদ্যসহায়তার মতো মানবিক কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্র এভাবে হুট করে বন্ধ করে দেবে তা সদ্যস্বাধীন একটি দেশ হয়তো স্বপ্নেও ভাবেনি। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে কাজটি করেছিল সে সময়। যুক্তরাষ্ট্রের ওই ভূমিকার জন্য বঙ্গবন্ধু সরকারকে এক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল। ’৭৪-এ খাদ্য ঘাটতিকে দুর্ভিক্ষের মোড়ক দেওয়া হয়েছিল। বহু পরে অমর্ত্য সেন তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে আসলে খাদ্য ঘাটতি ছিল না, ছিল সরবরাহব্যবস্থার মারাত্মক ত্রুটি। ’৭৪-এর কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়েছিল মার্কিন সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির নানা ষড়যন্ত্র। একদিকে মজুদদার, চোরাকারবারিদের তৎপরতা অন্যদিকে গণবাহিনী, সর্বহারাদের সন্ত্রাস। এসব কিছুই ’৭৫-এর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের পটভূমি তৈরি করা করেছিল।

২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ’৭৪-এর মার্কিন সিদ্ধান্তটি মনে পড়ল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিদিনই নানারকম নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা বিশ্বকে বিভক্ত করেছে। পৃথিবী যেন আবার স্নায়ুযুদ্ধের অবস্থানে ফিরে গেছে। বিশ্বে এক নতুন মেরুকরণ ঘটেছে। সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ যুদ্ধে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষ নয়। আশার কথা, বাংলাদেশ সরকার ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই এ নিয়ে সতর্ক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কত দিন এ নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে পারবে? বাংলাদেশকে কি পক্ষভুক্ত করার জন্য চাপ দেওয়া হবে? রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বন্ধের জন্য আহ্বান জানানো হবে? এ প্রশ্ন উঠছে কারণ নানা ইস্যুতে মার্কিন চাপ এখন দৃশ্যমান। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি খুব সোজাসাপ্টা এবং স্পষ্ট। এটি বঙ্গবন্ধু নির্ধারণ করে দিয়েছেন- ‘কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’। কিন্তু কারও সঙ্গে বৈরিতা না করলে কী হবে বাংলাদেশ  বিভিন্ন সময় বৈরিতার শিকার হয়েছে। ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন বাংলাদেশবিরোধিতা করেছে তা সবারই জানা। বিজয়ের পর বাংলাদেশ যেন জাতিসংঘের সদস্য পদ না পায় সেজন্য চীন ভেটো দিয়েছিল। জাতির পিতা এ নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন। ১৯৭৪-এর ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিপক্ষীয় কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যখন চীনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ভেটো দেওয়া হতো তখন এই বাংলার মানুষই বিক্ষোভ করত। আমি নিজে ভেটোর বিরুদ্ধে বহুবার কথা বলেছি। যে ভেটোর জন্য চীন ২৫ বছর জাতিসংঘে যেতে পারেনি। দুঃখের বিষয় সেই চীন আজ ভেটো “পাওয়ার” হয়ে প্রথম ভেটো দিল আমার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তবু আমি কামনা করি তাদের বন্ধুত্ব। অনেক বড় দেশ। দুশমনি করতে চাই না। বন্ধুত্ব কামনা করি। কারণ আমি সবার বন্ধুত্ব চাই।’ (সূত্র : শেখ মুজিব বাংলাদেশের আরেক নাম; আতিউর রহমান পৃষ্ঠা : ২৫৯)

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বন্ধুত্বের উদাত্ত আহ্বান অনেকেই শোনেনি। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দেশগুলোই ’৭৫ পর্যন্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে অসহযোগিতা করেছে। ’৭৫ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়নি অনেক রাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ মানবাধিকারের কথা বলে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট যখন জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো তখন কেন যুক্তরাষ্ট্র নীরব ছিল? শিশু রাসেলকে যখন হত্যা করা হলো তখন মানবতার পতাকা কোথায় ছিল? অন্তঃসত্ত্বা নারীকে যখন হত্যা করা হলো মার্কিন প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নেয়নি। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ। তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করল সেনাবাহিনীর কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল বিপথগামী সদস্য। তাদের ওপর কি কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল? হয়নি। এসব খুনির বিচার হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দণ্ডিত ঘোষিত ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছে বলে খবর পাওয়া যায়। কোথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার, কোথায় নিষেধাজ্ঞা? এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। মাঝেমধ্যেই সুশীলসমাজের পরামর্শে এ আইন বাতিলের আহ্বানও জানানো হয়। কিন্তু ১৯৭৫ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো একটি কালো আইন বাংলাদেশের কলঙ্ক তিলক হয়ে ছিল। মানবাধিকারের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ছিল। তার বিরুদ্ধে কটা দেশ উদ্বেগ জানিয়েছে? কটা দেশ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো কালো আইন বাতিল করার জন্য বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের সরকারগুলোকে চাপ দিয়েছে? ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এলো। ১ অক্টোবরের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হতে না হতেই সারা দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর তাণ্ডব শুরু হয়। হত্যা, ধর্ষণ, সন্ত্রাসে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। মুহূর্তেই সর্বস্বান্ত হয়ে যান অনেকে। ১ অক্টোবর ২০০১ থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে কোনো আইন ছিল না। বিএনপি-জামায়াত প্রতিপক্ষ নিধনের এক উন্মত্ত খেলায় মেতে ছিল। তখন বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে কোনো আহাজারি-আর্তনাদ দেখা যায়নি পশ্চিমা বিশ্বে। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর ‘অপারেশন ক্লিনহাট’ শুরু করে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের নামে শুরু হয় বিচারবহির্ভূত হত্যা, গ্রেফতারের স্বেচ্ছাচারিতা। তখনো পশ্চিমা বিশ্বে এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয়নি। এমনকি আইন করে অপারেশন ক্লিনহার্টের বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে যখন বৈধতা দেওয়া হয় তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ নিয়ে মৌনব্রত পালন করেছিল। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে এ সরকার বলেছিল তারা একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে এসেছে। কিন্তু দায়িত্ব নিয়েই রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারের উৎসব শুরু হয়। বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে যে পৈশাচিক নির্যাতন করা হয়েছিল তার কিছু কিছু বিবরণ প্রকাশ পাচ্ছে। এগুলো ভয়ংকর। ড. ফখরুদ্দীন-জেনারেল মইন উ সরকার ব্যবসায়ীদের থেকে জোর করে টাকা নিয়েছে। যাকে খুশি গ্রেফতার করেছে। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে এটি ছিল শুদ্ধি অভিযান। এ সময় বিনা বিচারে আটক, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো অস্বস্তি দেখা যায়নি পশ্চিমাদের মধ্যে। এমনকি আজকের প্রধানমন্ত্রীকে যখন দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো, তখন ব্রিটেনের কয়েকজন এমপি ছাড়া ইউরোপ-আমেরিকার কাছে বিষয়টি ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ’ কিংবা মৌলিক অধিকারের চরম লঙ্ঘন মনে হয়নি। দুই নেত্রীকে গ্রেফতার করা, ক্যাঙ্গারু ট্রায়ালের মাধ্যমে তাঁদের প্রহসনের বিচার- এসব কিছুই যুক্তরাষ্ট্র কেবল পর্যবেক্ষণ করেছে। এসব মানবাধিকার লঙ্ঘন কাণ্ডে জড়িতদের অনেকে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বসবাস করছেন বহাল তবিয়তে। তাঁদের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এসব প্রসঙ্গ এলো এ কারণে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের চোখে মানবাধিকারের সংজ্ঞা একেক সময় একেক রকম। একই ঘটনা কখনো মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় আবার কখনো হয় সুশাসন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তাই পশ্চিমা বিশ্বের এক অনবদ্য অস্ত্র। এটা তখনই তারা প্রয়োগ করে যখন তারা মনে করে একটি বিশেষ দেশে তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ইরাকে অনুগত সাদ্দাম যখন স্বেচ্ছাচারিতা করেছেন, তখন তা ছিল মার্কিনি পোষা বিড়ালের দুষ্টুমি। সে সাদ্দামই যখন মার্কিন আনুগত্যে একনিষ্ঠ থাকেননি তখন তা হয়েছে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন। মুজাহিদরা যতক্ষণ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে ততক্ষণ তারা মার্কিনিদের প্রিয়পাত্র ছিল। যখনই তারা আসল রূপে আবির্ভূত হয়েছে তখনই হয়েছে সন্ত্রাসী। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যে কোনো বিবেচনাতেই যুদ্ধ অন্যায়। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনে যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র অহরহ বিভিন্ন দেশে তা করে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত লাগলেই তারা মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা হয়ে যায়। কিছুদিন ধরে মার্কিন চাপ বাংলাদেশ ভালোভাবেই অনুভব করেছে। বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানায়নি। র‌্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সংশোধিত লেহি আইনে সম্মতি স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। এসবের কারণ যে শুধু মানবাধিকার ইস্যু নয় তা অনুধাবন করার জন্যই আগের ঘটনাগুলো একটু সামনে আনলাম। ১৯৭৫, ২০০১, ২০০৭ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়। কিন্তু এখন বাংলাদেশের সবকিছুতেই মানবাধিকার লঙ্ঘন খোঁজা হয়। এর কারণ কয়েকটি। একটি অন্যতম কারণ বৈশি^ক প্রেক্ষাপট। বিশ্বরাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ।

১৯৯১-এর ২৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘটে। এর মাধ্যমে শীতল যুদ্ধের অবসান ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্ব ক্রমে দুই ভাগে বিভক্ত হতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক বিশ্ব। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। একদিকে পুঁজিবাদী দেশগুলোর ‘ন্যাটো’ সামরিক জোট। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ‘ওয়ারশ’ সামরিক জোট। স্নায়ুযুদ্ধের এ সময়টায় বিশ্বে এক ধরনের ভারসাম্য ছিল। এ স্নায়ুযুদ্ধের বিভক্ত বিশ্বেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভূমিষ্ঠ হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়েও ছিল বৈশ্বিক বিভক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল। ১৯৬৪ সালে ‘সমাজতন্ত্র’ বাস্তবায়নের কৌশল নিয়ে মতাদর্শিক বিরোধ হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের। দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বিভক্ত হয়ে যায়। সোভিয়েতবিরোধিতা করতে গিয়ে এ যুদ্ধে চীনও ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের চৈনিক বামেরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ অভিহিত করেছিল। স্নায়ুযুদ্ধে বিভক্ত বিশ্বে বাংলাদেশের বিজয় সহজ হয়েছে। আবার বিভক্ত বিশ্বের কারণেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ষড়যন্ত্র হয়েছে। এ ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত পরিণতি ছিল ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট। যারা বাংলাদেশের বিজয় চায়নি তারা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পরও আমাদের স্বাধীনতাহরণের ষড়যন্ত্র করেছে। আবার বাংলাদেশকে একটা পাকিস্তান বানাতে চেয়েছে। ’৭৫-পরবর্তী জিয়া-এরশাদ পাকিস্তানি ধারা ফিরিয়ে আনার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা সফল হতেন যদি শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের হাল না ধরতেন। মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতা যথার্থভাবে ‘সমাজতন্ত্র’কে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি করেছিলেন। জাতির পিতা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গেই তিনি ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতের পাশাপাশি যেসব দেশ বাংলাদেশ বিনির্মাণে অবদান রেখেছিল তার বেশির ভাগই সমাজতান্ত্রিক দেশ। জাতির পিতা ‘বাকশাল’ গঠনের মাধ্যমে শোষণমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ‘বাকশাল’ গঠনের সাত মাসের মধ্যে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড যে শুধু দেশি ষড়যন্ত্র তা আমি মোটেও বিশ্বাস করি না। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও বৈশি^ক রাজনীতি ওতপ্রোত জড়িত। আওয়ামী লীগ বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তা খুব ভালো করেই জানেন। আর এ কারণেই ’৮১ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে শেখ হাসিনা একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করে আসছেন। ’৮১ থেকে ’৯১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ তার ঘোষণা, কর্মসূচি এবং নীতি অনেক পরিবর্তন করে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতি, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ থেকে ব্যক্তিমালিকানাকে স্বীকৃতি দেওয়া- এসবই আওয়ামী লীগ করেছে পশ্চিমা বিশ্বের আস্থা অর্জনের জন্য। ’৭৫-এর পর থেকে ’৯৬ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে বারবার প্রমাণ করতে হয়েছে তারা মুক্ত অর্থনীতিতে বিশ্বাসী একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দল। কিন্তু শেখ হাসিনা একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক। পশ্চিমাদের আস্থা অর্জন করতে গিয়ে তিনি দুঃসময়ের বন্ধুদের ভুলে যাননি। বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গেও নানা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়িয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনকে কাছে টেনে নিয়েছে। অনেকের ধারণা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর খানিকটা নাখোশ চীনের জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন কেবল বাংলাদেশকে বিভিন্ন ব্যাপারে চাপ দেওয়া শুরু করেছে তখনই বাংলাদেশ রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করেই রাশিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২-এর চুক্তি করেছে।

গত এক দশকে বাংলাদেশ অনেকটাই ভারত-চীন-রাশিয়ার দিকে ঝুঁকেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা থেকেও বেশ খানিকটা সরে এসেছে বাংলাদেশ। এ সময়ই আবার বিশ্বে নতুন মেরুকরণ হয়েছে। বৈশ্বিক  এ মেরুকরণ চূড়ান্ত রূপ পেল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে। চীন-রাশিয়া ’৬৪-পরবর্তী বৈরিতা ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। বলা হচ্ছে, বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী শাসকরা এক হয়েছেন। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের মতোই এখন বিশ্বে একটি জোটনিরপেক্ষ মধ্যপন্থার জোট তৈরি হচ্ছে। যারা দুই পক্ষের কারও সঙ্গেই নেই। এদের নেতৃত্ব দিচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। নিরাপত্তা পরিষদে ভারত রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটদানে বিরত থেকেছে। আবার ভারত যুদ্ধ বন্ধের দাবিও করেছে। পুতিনের সঙ্গে দুই দফা কথা বলেছেন নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার যেমন দীর্ঘদিনের সম্পর্ক তেমনি ভারতেরও ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া। ভারত বৈশি^ক মেরুকরণে একটা স্বাতন্ত্র্য এবং গ্রহণযোগ্য অবস্থান দৃশ্যমান করেছে। এটা বাংলাদেশের জন্যও শিক্ষণীয়। কারও পক্ষে-বিপক্ষে না গিয়ে একটি নিরপেক্ষ অবস্থানই বাংলাদেশের জন্য নিরাপদ। কিন্তু যারা বাংলাদেশকে এখন কথায় কথায় নানা ইস্যুতে চাপ দেয় তারা কি এ নিরপেক্ষতা মেনে নেবে? তারা রাশিয়ার ইস্যুতে কি নতুন কোনো চাপ দেবে?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

[email protected]

সর্বশেষ খবর