রবিবার, ১৩ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

মনে রাখবেন ক্ষুধার্ত মানুষ, ক্রোধান্ধ মানুষ

মোফাজ্জল করিম

মনে রাখবেন ক্ষুধার্ত মানুষ, ক্রোধান্ধ মানুষ

এ করোনাকালেও মুখে মাস্ক পরে যে মুষ্টিমেয় দুঃসাহসী ‘ভদ্দরনোক’ ক্রেতা গত দুই বছর প্রায় নিয়মিত বাজার করে আসছেন আমি তাঁদেরই একজন। আর তা বাজারের হালহকিকত জানার জন্য সামরিক বাহিনীর ভাষায় শুধু ‘রেকি’ (্ইংরেজি ‘রিকনিসেন্স’ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ, অর্থ- শত্রুপক্ষের অবস্থান, শক্তি ইত্যাদি জানার জন্য পরিচালিত অভিযান) করার জন্য নয়, রীতিমতো ‘কমব্যাট’ বা যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। ‘রেকি’ করেন সরকারি, আধাসরকারি, নিমসরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। তাঁরা চাল-ডাল-মাছ-মাংস-মসলাপাতি-শাকসবজি ইত্যাদির সরেজমিন রিপোর্ট তৈরি করেন বিভিন্ন বাজার ‘রেকি’ করে। অবশ্য দুষ্ট লোকে বলে, ‘রেকি’র কাজটা নাকি তাঁরা ঘরে বসেই সেরে ফেলেন বিভিন্ন জনকে ফোন-টোন করে, নিজের বাসার গৃহকর্মী ‘আবদুলকে’ জিজ্ঞাসাবাদ করে। আর টিভি চ্যানেলের কর্মীরা যখন ক্রেতা-বিক্রেতাদের ইন্টারভিউ নেন বাজারে ঘুরে ঘুরে, তখন দেখা যায় তাঁরা ভালোই সাড়া পান। এর প্রধান কারণ টিভিতে চেহারা মুবারক প্রদর্শন। অবশ্য এটা ঠিক, টিভিতে বিক্রেতা ও হাটুরেদের কথাবার্তায় মোটামুটি সঠিক চিত্রটি উঠে আসে।

২. বাজারের অভিজ্ঞতা বলতে গেলে আমার সারা জীবনের। তবে দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফন দেখে আসছি স্বাধীনতার পর থেকে। স্বাধীনতার আগে দ্রব্যমূল্য একলাফে মগডালে উঠে যাওয়ার কোনো ঘটনা মনে পড়ে না। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের ১৭ দিনের (৬ সেপ্টেম্বর-২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫) যুদ্ধের সময় কিংবা ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসকালে পণ্য সরবরাহ বা দ্রব্যমূল্য নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ-অনুযোগের কথা শুনেছি বলে মনে পড়ে না। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ অবশ্য বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তানের) ভূখণ্ডে হয়নি, হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসই তো যেন কিয়ামত নাজিল হয়েছিল বাংলাদেশে। সে সময় পুরো জাতি মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস করেছে। মৃত্যুর বাজপাখি সারাক্ষণ ছো মেরেছে প্রতিটি জনপদে। মানুষ তখন বেঁচেছে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফ্রম মোমেন্ট টু মোমেন্ট’। বছর নয়, মাস নয়, দিন নয়- মানুষ জীবন গুনেছে প্রতিটি লহমা বেঁচে বেঁচে। তখনো কিন্তু তৈলতণ্ডুলের হিসাব নিয়ে দুশ্চিন্তিত হতে হয়নি বাঙালিকে। অথচ যুদ্ধকালীন বা দুর্ভিক্ষাবস্থায় মজুদদার-মুনাফাখোর শ্রেণির মানুষরূপী পশুরা ফোকটে দুই হাতে পয়সা লোটে। এ কথা সত্যি, একাত্তরে স্বল্পসংখ্যক নরপশু ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে মানবতাবোধের পরাকাষ্ঠাই পরিলক্ষিত হয়েছে। চালের দাম, ডালের দাম, নুনের দাম, তেলের দাম কৃত্রিম উপায়ে বাড়িয়ে মানুষের গাঁট কেটে ওই দুঃখের দিনে তার কষ্ট বাড়ানোর কথা চিন্তা করেনি ব্যবসায়ী মহল। মানুষ মেরেছে খানসেনারা, রাজাকার, আলবদররা- আর বাকি সাড়ে ৭ কোটি চেষ্টা করেছে একে অন্যকে বাঁচাতে। এজন্যই তো বলা হয়, বাঙালি তার সবচেয়ে দুঃখের পাশাপাশি সবচেয়ে মহৎ কাল অতিক্রম করেছে ওই নয় মাস।

৩. আর এই ফেরেশতাতুল্য চরিত্রের মানুষ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের পর দ্রুতই ভুলে গেল ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের কথা, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানির কথা। আদর্শ হিসেবে তাদের অনেকেই বেছে নিল পাকিস্তানি লুটেরাদের ২৪ বছরের কলাকৌশল। একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তারা সিঁড়ি বেয়ে ২০ তলা ভবনের শীর্ষতলায় না পৌঁছে কী করে পাকিস্তানি কায়দায় ‘হপ, স্টেপ অ্যান্ড জাম্প’ এবং পোলভল্টের সাহায্যে একলাফে ছাদে ওঠা যায় সেই ফন্দিফিকির রপ্ত করতে সঁপে দিল নিজেকে। এর ছাপ পড়ল সবখানে। এবং অবশ্যই বাজারে। মজুদদারি, মুনাফাখোরি, ভেজাল, চোরাচালানি এসব যে পাকিস্তানি জমানায় বা ব্রিটিশ আমলে এ ভূখণ্ডে ছিল না এ রকম ডাহা মিথ্যা কথা কেউই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না। তবে স্বাধীনতার আগে যা ছিল সহনীয় পর্যায়ে তা-ই অতিদ্রুত হয়ে গেল মাত্রাতিরিক্ত। কারণ? কারণ ওই একটাই- পাকিস্তান আমলে বাঙালি সুযোগ পায়নি, যা কিছু লুটেপুটে খাওয়ার ছিল তা খেয়েছে পাকিস্তানিরা। হয়তো স্বল্পসংখ্যক তলপিবাহক ছিটেফোঁটা সামান্য উচ্ছিষ্ট পেয়েছে তাদের প্রভুদের থেকে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। শত শত কোটি টাকার প্রজেক্টটা, টেন্ডারটা, আমদানি-রপ্তানির লাইসেন্স-পারমিটটা, শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমতিটা, ব্যাংকঋণটা ১১০০ মাইল দূরের ‘প্রভুরাই’ কুক্ষিগত করে রেখেছিল। মোসাহেব বাঙালিপুঙ্গবরা এসবের মাজেজা বুঝত না। তারা শুধু হুজুরদের কাণ্ডকারখানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে ২৪ বছর। একাত্তরের পর তারা একলাফে প্রভুদের ফেলে যাওয়া কুরসিতে সমাসীন হয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু করল ২৪ বছর ধরে শেখা সব অপকৌশলের প্রয়োগ। ফলে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে যে চালের মণ (৩৭.৫ কেজি) ছিল বড়জোর ২০ টাকা, তা-ই দেখতে দেখতে হয়ে গেল ২০০ টাকা। পাল্লা দিয়ে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের বাজারেও আগুন লেগে গেল- চাল-ডাল, তরিতরকারি, তেল-মসলা কোনো কিছুই বাদ রইল না। এর সঙ্গে সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে শুরু হলো বিশ্বব্যাপী তেলসংকট ও মন্দা। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ওপর পড়ল মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা : মূলত ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে ও দীর্ঘমেয়াদি খরার ফলে ১৯৭৩-৭৪ সালে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে। সরকারি হিসাবেই মারা গেল ৩০ হাজার মানুষ। সমস্যাকীর্ণ নতুন দেশের নতুন সরকার বলতে গেলে প্রায় অনভিজ্ঞ একটি প্রশাসনযন্ত্র নিয়ে তখন পরিস্থিতি মোটামুটি ভালোই সামাল দিতে সক্ষম হয়েছিল। এর পরপরই ঘটে গেল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ড।

৪. এ ধরনের টালমাটাল পরিস্থিতিতে অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের আসন পাকাপোক্ত করে নতুন নতুন টেকনিক চালু করল। এরই একটা ‘সিন্ডিকেট’ গঠন। স্বাধীনতার আগে আমরা এর নামও শুনিনি। রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতিতে ‘অলিগারকি’, অলিওগপলি বা গোষ্ঠী-শাসন, গোষ্ঠী-নিয়ন্ত্রণের কথা বলা আছে। সমমনা বা সমনীতির কিছু কিছু শক্তিশালী উৎপাদনকারী বা সরবরাহকারী জোট গঠন করে কোনো পণ্যের বাজার কুক্ষিগত করে রাখার গোষ্ঠী-শাসন থেকে এখন উত্তরণ ঘটেছে ‘সিন্ডিকেশন’-এ। বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে এ সিন্ডিকেটের খেলা। বিশেষ করে বিদেশ থেকে ভোজ্য তেল আমদানিকারক কিছু বৃহৎ প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট গঠন করে তেলের বাজার ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। মওকা বুঝে চাল, পিঁয়াজ, চিনির মতো অপরিহার্য ভোগ্যপণ্যের বেলায়ও প্রয়োগ করা হয় এ অস্ত্র। এবং এটা নাকি ওপেন সিক্রেট। যেহেতু বাঙালির রন্ধনশালায় ভোজ্য তেল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বস্তু এবং যেহেতু সয়াবিন ও পাম তেলের চাহিদার পুরোটাই আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে, অতএব পণ্যটির সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে ইচ্ছামতো ‘খেলানো’ যায় সরকার ও দেশবাসীকে। সরকার নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে পণ্যটির বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টার ত্রুটি করে না বটে; কিন্তু তারা যদি চলে ডালে ডালে, তো সিন্ডিকেট চলে পাতায় পাতায়। তারা নানা কায়দায় সরকারি প্রচেষ্টাকে কলা দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণটা নিজেদের মুঠোয় রাখে ঠিকই। মাঝখান থেকে ভোক্তা পাবলিকের প্রাণ হয় ওষ্ঠাগত। একই অবস্থা পিঁয়াজ, চিনি বা অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের বেলায়ও।

সিন্ডিকেট নিয়ে বড় অভিযোগ, এরা নাকি কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়েই তাদের কায়কারবার চালায় এবং সে কারণেই নাকি বারবার এদের অশুভ চক্র ভেঙে দেওয়ার দাবি উঠলেও এরা এখনো বেশ বহাল তবিয়তেই আছে। বিভিন্ন পণ্যের আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়-বিতরণ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণকারী মাসলম্যানরা হচ্ছে সিন্ডিকটের সদস্য। এদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের একটি ‘আনহলি অ্যালায়েন্স’ (বাংলা করলে বোধহয় অশুভ বন্ধন বা মৈত্রীজাতীয় কিছু হবে) আছে বলে পাবলিকের ধারণা। পাবলিক এও মনে করে- এ বন্ধন ছিন্ন এবং অপকর্মের জন্য অ্যালায়েন্সের রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব অপকর্ম দমনের জন্য হামেশা অনেক বড় বড় বুলি উচ্চারিত হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। কর্তৃপক্ষ বোধহয় মনে করেন শুধু কথার কামান দাগিয়ে সব বাঘ-ভালুক বধ করে ফেলবেন। কিন্তু বিষয়টা যে মোটেই সে রকম নয়, এ চৈতন্যোদয় কবে তাদের হবে জানি না। শুধু কথায় যদি চিঁড়া ভিজত তবে বাংলাদেশের শহর-বন্দর-গ্রামে সংরক্ষিত লাখ লাখ বস্তা চিঁড়ার একটাও শুকনো থাকত না। চিঁড়া ভেজাতে হলে ওটাকে অবশ্যই পানিতে চোবাতে হবে। তেমনি মজুদদার-মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে অবশ্যই তাদের চাঁইগুলোকে আইনের আওতায় আনতে হবে। দেখাতে হবে দেশে আইন আছে, যথাস্থানে তার প্রয়োগও আছে। আর মুশকিল তো ওখানেই। মাঝেমধ্যে মনে হয় দেশে আইন আছে, বিশ্বমানের সুন্দর সুন্দর আইন, কিন্তু তার সময়োচিত সঠিক প্রয়োগ নেই।

৫. শেষ করব একটি কথা বলে। ভোগ্যপণ্যের মূল্যের অবিরাম ঊর্ধ্বগতিকে কর্তৃপক্ষ অতিদ্রুত সিরিয়াসলি নিয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি অচিরেই তাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। পদ্মা সেতু, রূপপুর প্রকল্প, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল ইত্যাদি নয়নসুখ কীর্তি নিঃসন্দেহে মানুষের প্রশংসা কুড়ায় কিন্তু জঠরের জ্বালা মেটায় না। ছোট-বড় অসংখ্য সামাজিক, অর্থনৈতিক সাফল্যগাথাও একটি ছোট্ট পেটের ক্ষুধা মেটাতে পারে না। ক্ষুধার জ্বালায় পাগলপ্রায় মানুষ করতে পারে না এমন কিছু নেই। খোদা না করুন সেই চরম পরিণতি যেন আমাদের দেখতে না হয়। মাননীয় কর্তৃপক্ষ, পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে চেষ্টা করুন। আপাতত কিছুদিন আগামী নির্বাচনের রঙিন খোয়াব দেখা বন্ধ করে, পরস্পর পরস্পরের প্রতি আবোল-তাবোল বাক্যবাণ ছোড়া স্থগিত ঘোষণা করে ক্ষুধার রাজ্যে গদ্যময় পৃথিবীর বাস্তবতাটা সঠিকভাবে অনুধাবন করুন, মানুষকে বাঁচান। আর মাত্র কয়েক দিন পর আসছে মাহে রমজান। তখন মানুষকে শুধু সাফল্যগাথা শুনিয়ে এবং কেবল পানি খেয়ে (সেখানেও ওয়াসা পাঁয়তারা করছে মূল্যবৃদ্ধির!) রোজা রাখতে বলবেন না নিশ্চয়ই। ক্ষুধা নিয়ে মশকরা করলে জনগণ কে জানে প্রমাণ দিয়ে ফেলতে পারে সেই আপ্তবাক্যটির যথার্থতা : আ হাংরি ম্যান ইজ অ্যান অ্যাংরি ম্যান। অমন চরম পরিস্থিতি থেকে আল্লাহ আমাদের সবাইকে রক্ষা করুন। আর বিশ্বাস করুন, বাংলাদেশের মানুষ আরেকটা সত্তরের দশকের দুর্ভিক্ষ দেখতে চায় না।

লেখক : সাবেক সচিব, কবি।

[email protected]

সর্বশেষ খবর