সোমবার, ১৪ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

জগতে কেহ নাই

মাকিদ হায়দার

জগতে কেহ নাই

‘জগতে কেহ নাই, সবাই প্রাণে মোর’ বাংলা ১৩১৯ সালে প্রকাশিত ছিন্নপত্র গ্রন্থে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লিখিত ১৪৫টি পত্র রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে সংক্ষেপণ ও সম্পাদনাপূর্বক সংকলন করেন। সেই ১৪৫ পত্রের বাইরে শ্রীমতী ইন্দিরা দেবীকে আরও ১০৭টি পত্র। কাকু রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বোলপুর থেকে ৫ জ্যৈষ্ঠ মঙ্গলবার ১২৯৯ (১৭-৫-১৮৯২)-এ প্রকাশিত পত্রিকাটির প্রথম লাইনটি হচ্ছে ‘জগতে কেহ নাই সবাই প্রাণে মোর’।

এখনো চোখের পাতা দুটি বন্ধ করলে দেখতে পাই হাজার হাজার মানুষের মুখচ্ছবি। ১৯৭২ সালের জানুয়ারির ১০ তারিখের সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য। সেকালের রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনকের উপস্থিতির দৃশ্য। পিতাকে শুধু একবার চোখে দেখেই সার্থক হয়েছিল জানুয়ারির ১০ তারিখের সেই দিনটি। মানুষের মনেপ্রাণে স্বাধীন হওয়ার আনন্দ ঝরে পড়েছিল শাহবাগের রাজপথে। আমরা নেচে গেয়ে প্রকাশ করেছিলাম আমাদের উচ্ছ্বাস। বয়স কম থাকায় কয়েক বন্ধু মিলে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে সন্ধ্যার অনেক পরে ফিরে গিয়েছিলাম ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে। ভাড়াটিয়া ছিলেন আমার ভগ্নিপতি প্রকৌশলী আবুল মুনছুর। ভগ্নিপতির নিজের একটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ি ছিল শ্যামলীর রিং রোডে। ইছামতি হাউস নামে খ্যাত ডুপ্লেক্স বাড়িটি। বাড়িটি বানিয়েছিলেন ১৯৬৪-৬৫ সালে। তিনি হাউজিং অ্যান্ড সেটেলমেন্টের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। অফিস নিয়েছিলেন ঢাকা স্টেডিয়ামের দোতলায় ২৪ নম্বর কক্ষটি। বেশ কয়েক বছরের ভিতরেই ঠিকাদারি ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি হয়েছিল ‘ট্রফিক্যাল বিল্ডার্স’ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির। প্রায় ৫০-৬০ জন কর্মরত ছিলেন ট্রপিক্যালে। স্বাধীনতার পরে ওই ফার্মে যুক্ত হয়েছিলেন স্থপতি ইয়াফেজ ওসমান, অপরেশ দাশ, গোলাম মুস্তফা এবং বিশিষ্ট অভিনেতা প্রকৌশলী আবুল হায়াতসহ আরও অনেকেই। স্বাধীনতার আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনেকগুলো স্থানে রেসিডেনশিয়াল ক্যাডেট স্কুল এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিল সরকার। ঝিনাইদহ, ফৌজদারহাট, পাবনাসহ অনেকগুলো জেলায়। সেসব স্কুলে একটি মাত্র প্লাস্টিকের মডেল তৈরি হতো, ওই প্লাস্টিক মডেলের অনুকরণে তৈরি হয়েছে ক্যাডেট স্কুল ও কলেজগুলো। সেসব ক্যাডেট স্কুলে ক্লাস সেভেন থেকে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সুযোগ ছিল ছাত্রদের। তবে মেয়েদের জন্য একটি ক্যাডেট স্কুল ও কলেজ আছে ময়মনসিংহ জেলায়। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের সচিবালয় মসজিদ এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসভবনের প্লাস্টিকের মডেল বানাতে পারত একমাত্র ট্রপিক্যাল বিল্ডার্স। সেই সুবাদে বিল্ডার্সের মালিক আবুল মুনছুরকে প্রায়শই করাচি লাহোরে যেতে হতো। মডেলগুলো বিশাল, বিশাল কাঠের ফ্রেমে ভরে চিটাগং থেকে পাঠানো হতো করাচিতে। আমি ১৯৬৮ সালে ১৫০ টাকা বেতনে ভগ্নিপতির ফার্মে যোগ দিয়েছিলাম।

তখনকার দিনে ঢাকা স্টেডিয়ামের দক্ষিণ দিকের খোলা মাঠে অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদ, এমনকি মওলানা ভাসানীকে বক্তৃতা করতে শুনেছিলাম। ’৬৮ সাল পেরিয়ে ’৬৯ সালে শুরু হয়েছিল গণআন্দোলন এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে মুক্ত করা। ’৬৯-এর গণআন্দোলনে আমার মতো তরুণদের মিটিং-মিছিলে প্রায় সারা দিনই কেটে যেত। ’৬৯-৭০ পেরিয়ে এলো ’৭১-এর ৭ মার্চ, দুপুরের আগে থেকেই সেদিন ছিলাম রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে সবাই জেনে গিয়েছিলেন স্বাধীনতা আসন্ন হলেও রক্তপাত, হত্যা, অগ্নিসংযোগ সবকিছুই করবে, না-পাক পাকিস্তান সরকার। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ নেমে এসেছিল নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৭, ২৮ তারিখে কারফিউ কিছুটা শিথিল হলে হাজার হাজার ঢাকাবাসী প্রাণের ভয়ে সপরিবারে সবকিছু ফেলে রেখে যে যেভাবে পারে পালিয়েছিলেন ঢাকা থেকে। ওই একই ধারাবাহিকতায় আবুল মুনছুর গাড়ি বাড়ি ফেলে সামান্য কিছু অর্থ নিয়ে পালিয়েছিলেন ছেলেমেয়েসহ। এ গ্রাম সে গ্রাম করে চার দিন পরে পাবনা শহরের পশ্চিমের মাধপুর গ্রামে এসেছিলেন। পাবনা শহর থেকে ৭-৮ মাইল দূরে সেই প্রত্যন্ত গ্রাম। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে না-পাক পাকিস্তানিদের জ্বালাও পোড়াও হত্যাযজ্ঞ। মাধপুরের একজন ভদ্রলোকের বাড়িতে ছিল একটি ‘মারফি’ রেডিও, সেই রেডিওতে গ্রামবাসী শুনতেন বিবিসি এবং আকাশবাণীর খবর। দাসুনিয়া হাটের মাধপুর এবং আওতাপাড়ার এমনকি চরগড়গড়ির তরুণরা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতিপর্বে-যে কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন আবুল মুনছুরের একটি দোলনা বন্দুক আছে, বন্দুক কীভাবে চালাতে হয়, তারই ট্রেনিং নিতে শুরু করে ওইসব গ্রামের তরুণরা মাধপুরে এসে।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ছিল রবিবার, সেই দিন দুপুরে দিল্লি থেকে আকাশবাণীর বাংলা সংবাদ পাঠিকা নীলিমা সান্যাল সংবাদে জানিয়েছিলেন, আরিচাঘাট পার হয়ে পাকিস্তানি সৈনিকরা নগরবাড়ী হয়ে উত্তরবঙ্গের দিকে রওনা দিয়েছে। আমাদের হায়দার পরিবার কোনো রকমে পালাতে পেরেছিলেন একজন বিহারি ড্রাইভারের ওপর ভরসা করে। আমাদের মেজোভাই রশিদ হায়দার তখন পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন নির্বাহী থাকার সুবাদে ব্যাংক একটি উইলিস জিপ ব্যবহারের জন্য দিয়েছিলেন, সেই জিপের ড্রাইভার ছিল একজন বিহারি। মিরপুর নিবাসী। মেজোভাই তখন থাকতেন খিলগাঁও আনসার অফিসের ঠিক বিপরীতে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান বীনুদের বাড়িতে। মেজোভাই প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে হেমাকে আমাদের একমাত্র ভাতিজি, বয়স বছর দুয়েক তাকে কোলে নিয়ে ওই দুর্বিষহ সময়ে জিপে ওঠার আগে আদর করে চুম দিয়ে, ভাবির কোলে তুলে নিয়ে বলতেন, ফিরি কি-না ফিরি তার তো ঠিক নেই, পরের কথাগুলো বলার আগেই কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে যেত। মেজোভাইয়ের বিহারি ড্রাইভার লক্ষ্য করতেন প্রতিদিন। সেই বিহারি ড্রাইভার নিজেই একদিন রশিদ ভাইকে বললেন, আপনাদের মা, ভাইবোনদের আমি আরিচা পৌঁছে দেব, জিপে আপনিও যাবেন। ড্রাইভারের কথায় থতমতো খেয়ে কিছু বলার আগেই ড্রাইভার মোহাম্মদ আলী তার জামার পকেট থেকে একটি ছোট কোরআন শরিফ মাথায় ঠেকিয়ে আলী মেজোভাই আর ভাবিকে বলেছিলেন, আপনার হেমার বয়সী আমারও একটি মেয়ে আছে। আপনারা যদি আমাকে বিশ্বাস করেন আমি বিশ্বাসঘাতকতা করব না মাথায় কোরআন শরিফ দিয়ে বলছি। আমরা ইতোমধ্যে জেনে গিয়েছিলাম ’৭১-এর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দিকে মিরপুর ব্রিজের আগেই মিরপুর-মোহাম্মদপুরের বিহারিরা উত্তরাঞ্চলগামী ইপিআরটি বাস থামিয়ে সব যাত্রীকে নৃশংসভাবে মিরপুর রোডে হত্যা করেছিল। মেজোভাই যখন তার ড্রাইভার আলীকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলেন, তখন ড্রাইভার আলী জানাল, আমি মিরপুরে থাকি, খুনিরা জানে, আমি পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ড্রাইভার। স্যার আপনার ভাইবোন, মা-আমি সবাইকে পৌঁছে দেব আরিচাঘাটে। তারিখটা ছিল ৭ এপ্রিল ১৯৭১ বৃহস্পতিবার। ড্রাইভার আলী তার কথা রেখেছিলেন, তবে সাভার যাওয়ার আগেই একজন পাক আর্মি আমাদের জিপ থামালে, ড্রাইভার আলী চোস্ত উর্দুতে জানিয়েছিলেন এরা সবাই পাকিস্তানি। ছাড়া পেয়ে মা কোরআনের আয়াত পাঠ করলেন। শুধু গাড়ির সামনের সিটে রশিদ ভাই ছিলেন, আর আমরা গাদাগাদি করে পিছনের সিটে বসে বিকালের দিকে আরিচাঘাটে গিয়ে একটি গরুটানা নৌকায় কোনোরকমে গিয়ে পৌঁছেছিলাম নগরবাড়ী ঘাটে। রশিদ যথারীতি ফিরে এসেছিলেন খিলগাঁওয়ের বিনুদের বাড়িতে। ড্রাইভার আলীকে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলেন তার সততার জন্য। আলী টাকা গ্রহণ করেননি। নগরবাড়ী থেকে পরদিন, কাশিনাথপুর এসে হ্যান্ডেল মারা বাসে আমরা পাবনার দোহারপাড়া এসেছিলাম। আমার মাকে দেখে মেজোকাকা হাবিবুর রহমান, ছোট কাকা আবুল কাশেম, ভাবি, জিয়া ভাই এবং ভাইবোনদের ফিরে পেয়ে কেঁদে কেঁদে জানিয়েছিল তাদের আকুতি।

আবুল মুনছুর মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই গাড়ি-বাড়ি ফেলে সাত ছেলেমেয়ে নিয়ে রাতের গভীরে নিজ গ্রাম পাবনার মাধপুরের দিকে যাত্রা করেছিলেন। কখনো হেঁটে, নৌকায়, ঘোড়ার গাড়িতে ৩, ৪ দিন ধরে কষ্ট করে শেষ অবধি মাধপুরে পৌঁছতে পেরেছিলেন। এদিকে শ্যামলীতে তার অনুপস্থিতিতে মোহাম্মদপুরের বিহারিরা লুটপাট করেই ক্ষান্ত হয়নি, ইছামতি হাউসের দরজা, জানালা, গোয়ালের দুটি গরু নিয়ে গিয়েছিল, তবে নিতে পারেনি ভগ্নিপতির টয়োটা কারটি যার নম্বর ছিল ঢাকা ক-১২৫১। ভগ্নিপতি তার প্রিয় গাড়িটি ২৬ মার্চের আগেই তার এক বন্ধুর ধানমন্ডির ১৮ নম্বরের একটি বাড়িতে রেখে ঢাকা ছেড়েছিলেন। সেই ১৯৭১ সালের ২৭-২৮ তারিখে। তখনকার দিনে কল্যাণপুরের পরে জনবসতি ছিল না একদমই। শুধু বিহারি এবং কয়েক ঘর বাঙালি থাকত মিরপুরে। বাঙালিদের ভিতরে ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক আবু তালেব, তাকেও হত্যা করেছিল বিহারিরা।

মাধপুরে গিয়ে আবুল মুনছুর একান্ত প্রচেষ্টায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একত্রে বন্দুক পরিচালনার দায়ভার নিয়েছিলেন। এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিনি নিজ গ্রামে থাকাকালীন একদিন গোপন সূত্রে জানতে পারলেন, স্থানীয় নকশালরা আবুল মুনছুরকে হত্যার ঘোষণা দিয়েছে দাসুনিয়া হাটে। মাধপুরের প্রাইমারি স্কুলে এবং আওতাপাড়া হাটে চোঙা ফুঁকে বলা হয়েছিল আবুল মুনছুরকে যে হত্যা করতে পারবে তাকে নগদ ২০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। ভগ্নিপতি তাই ভরা বর্ষায় ইছামতি নদী সাঁতরিয়ে অনুকূল ঠাকুরের ঘাটে উঠে মধ্যরাতে এসেছিলেন আমাদের দোহারপাড়ার বাড়িতে। পরবর্তী কয়েক রাত ওনাকে কাটাতে হয়েছিল কালু মিস্ত্রির একটি আলোহীন অন্ধকার ঘরে। দিন কয়েক থাকার পরে কালাচাঁদপাড়ার মনি বসাকের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন আমার কাছে। আমি তখন ওই বাড়িতে রেশনের দোকান দিয়েছিলাম।

দিনকয়েক থাকার পর দেশে একটু শান্তি এলে, ভগ্নিপতি একদিন ইপিআরটি বাসে ঢাকায় ফিরে এসে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের বন্ধুর সেই বাড়িটিই ভাড়া নিয়েছিলেন। সেই বাড়ি থেকে কয়েকটি বাড়ি পরেই গৃহবন্দি অবস্থায় ছিলেন শেখ মুজিবের সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা এবং পুত্র-কন্যারা। বাড়িটির ছাদের ওপরে না-পাক পাকিস্তানি সৈনিকরা পাহারা দিত দিনরাত।

১৯৭১ সালের আগে আমার ভাগ্নি মাহফুজা আকতার আশা ধানমন্ডি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল এবং ওই বালিকা বিদ্যালয়ের একই ক্লাসে পড়ত শেখ রেহানা। রেহানার সহপাঠী হওয়ার সুবাদে আমার যাতায়াত ছিল ওই বাড়িটিতে। ছোট থাকায় না-পাকেরা বাড়িটিতে প্রবেশে বাধা দিত না। বড় দুই ভাগ্নি মাহাবুবা আকতার এবং মারুফা আকতার নীরা। ওদের দুই বোনকে আমার ছোট আপা এবং ভগ্নিপতি যেতে দিতেন না। গৃহবন্দি ফজিলাতুন নেছা আশাকে খুব আদর করতেন রেহানার সহপাঠী হিসেবে। দু-তিনটি বাড়ির পরেই যে বাড়িটি ভগ্নিপতি ভাড়া নিয়েছিলেন সেই বাড়িটি ছিল তিন তলা। তিন তলার ছাদে উঠেই চোখে পড়ত, গৃহবন্দি রেহানাদের বাড়ির সামনে বেশ বড় ফুলের বাগান এবং বাড়ির ভিতরের বড় উঠান। চারদিকে নিস্তব্ধ। সাধারণত ঘর থেকে বের হয়ে রেহানাদের গৃহবন্দি বাড়িটির সামনে দিয়ে যেতেন না কেউ। বাড়ির সামনে এবং ছাদে দাঁড়িয়ে থাকত না-পাক মিলিটারিরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার দিনকয়েক আগে একজন ডাক্তার ও তাঁর স্ত্রী লাল একটি ভক্সওয়াগন গাড়ি চালিয়ে ভুলবশত গৃহবন্দি বাড়িটির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় না-পাকরা স্বামী-স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করেছিল এবং অকারণে সারা দিন, সারা রাত, বন্দুকের গুলি ফুটিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীদের আতঙ্কের ভিতরে রাখত ওই সব নরপশু। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। ভগ্নিপতি সারা রাত জেগে, একটি জাতীয় পতাকা, খুব সুন্দর করে বানিয়েছিলেন। আগে যেভাবে পতাকা বানানো হয়েছিল। তারই আদলে বানিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, পরের দিন ১৭ ডিসেম্বরের সকালে ভগ্নিপতি নিজের গাড়ির মাথায় এই পতাকাটি লাগিয়ে গৃহমুক্ত শেখ ফজিলাতুন নেছার বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় তরুণরা পতাকাটি খুলে গৃহমুক্ত একতলা বাড়ির ছাদে উড়িয়ে দিয়েছিল। গাড়িতে আমার ভাগ্নি আরা, নীরা, আশা, মিতা, কাজল, রেজা, রানা সাত ছেলেমেয়ে নিয়ে তার টয়োটা গাড়িতে নিজেই ড্রাইভার হয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে আমার ভগ্নিপতি।

’৭১-এর ডিসেম্বর পেরিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির পিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি অথবা মার্চ মাসে ভারত থেকে একদল সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেই দলে ছিলেন লতা মুঙ্গেশকর, সুনীল দত্ত, মালা সিনহা, সায়রা বানু, ওয়াহিদা রহমানসহ আরও জনাকয়েক। ইতিপূর্বে অনেকেই জেনে গিয়েছিলেন ভারতীয় সাংস্কৃতিক দলের গায়িকা লতা মুঙ্গেশকর, অভিনেতা অভিনেত্রীরা সবাই ধানমন্ডির ১৮ নম্বরের সেই গৃহমুক্ত বাড়িটিতে শেখ ফজিলাতুন নেছার সঙ্গে দেখা করবেন আগামীকাল। আমাদের মেজোভাই রশীদ হায়দার আগের রাতেই চলে এসেছিলেন খিলগাঁও থেকে, ভগ্নিপতির ১৮ নম্বরের ভাড়াবাসাতে পরের দিন আমরা সদলবলে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম, গৃহমুক্ত শেখ ফজিলাতুন নেছার একতলা বাড়িটির সামনে। বেশ কিছুক্ষণ পরেই ওই বাড়ি থেকে প্রথমে বেরিয়ে এলেন, সুনীল দত্ত, পরে মালা সিনহা, ওয়াহিদা রহমান, আরও দুই একজন বেরোনোর পরে সব শেষে এলেন লতা মুঙ্গেশকর। রশিদ ভাই দৌড়ে লতাজির কাছে গিয়ে লতাজির গাওয়া ‘সাত ভাই চম্পা’ গানটির কথা ইংরেজিতে লতাজিকে জানাতেই তিনি খুশি হয়ে বললেন ধন্যবাদ। সেই লতাজি কিছুদিন আগেই গত হয়েছেন। তার কয়েক দিন পরে প্রখ্যাত সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান তিনিও পাড়ি দিলেন অনন্তে। পীর হাবিবের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেটেছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার দুই সহপাঠী সাংবাদিক দৈনিক সংবাদের হাবিবুর রহমান স্বপন এবং অধ্যাপক আবু দাইয়ান সরকার ছিলেন পীর হাবিবের ঘনিষ্ঠজন।

পীর হাবিবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল নব্বই দশকে। তখন আমি বিসিকের গণসংযোগ বিভাগের প্রধান। তিনি তখন একটি পত্রিকায় কাজ করতেন। বিসিকের খবর নেওয়ার জন্যই সেদিন তার আগমন আমার কাছে। পীর হাবিবের সঙ্গে একাধিকবার দেখা হয়েছে প্রেস ক্লাবে। আমি প্রেস ক্লাবের সদস্য ছিলাম। কার্ড নম্বরটি ছিল ‘৪২০’, পীর রসিকতা করে বলতেন ২০ ভাই কেমন আছেন। তার পরে চা-বিস্কুট। বছর তিনেক আগে গিয়েছিলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনে। পীর হাবিব তার কক্ষে নিয়ে গল্প শুরু করলেন। এমন সময় বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম এসে উপস্থিত। গল্প যখন জমে উঠেছে, ঠিক তখুনি এলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাহিত্য সম্পাদক শেখ মেহেদী হাসান। হাসানকে পীর হাবিব বললেন, রশীদ হায়দারের ওপর সাক্ষাৎকার নিতে। যাই হোক সেই সাক্ষাৎকারটি যে কোনো কারণেই নিতে পারেননি শেখ মেহেদী হাসান। ভগ্নিপতি এবং সেই লতা মুঙ্গেশকর, রশীদ হায়দার, পীর হাবিবুর রহমান এখন আর কেউই নেই। পীর হাবিবকে দেখলেই রসিকতা করে বলতাম, পীর সাহেব একটু ঝাড় ফুঁক দিলে ভালো হয়। তিনি বলতেন, ঠিক আছে। দিলাম। আসলে কেউই থাকে না, থাকে তার কীর্তি। হাবিবের সাংবাদিকতা, কলাম ছিল অসামান্য। যাই হোক ফিরে যাই রবি ঠাকুরের সেই কথায় “জগতে কেহ নাই সবাই প্রাণে মোর।”

                লেখক : কবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর