সোমবার, ১৪ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

ভাষাসৈনিক দবিরুল ইসলামের জন্মশতবার্ষিকী

আহসান উল্লাহ ফিলিপ

ভাষাসৈনিক দবিরুল ইসলামের জন্মশতবার্ষিকী

বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এ নাম দুটো একে অপরের পরিপূরক। চিরঞ্জীব এ নাম দুটোর সঙ্গে আরও প্রজ্জ্বল, আরও ভাস্বর যে সংগঠনটি আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনহ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সবকটি আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত সেই সংগঠনের নাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। তারুণ্য নির্ভর ও স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত এই ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর হাত দিয়ে গড়া এই ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতিও তিনি বানিয়েছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত সহচর, সহপাঠী, তৎকালীন আরেক তুখোড় ছাত্রনেতা ঠাকুরগাঁওয়ের দবিরুল ইসালামকে। বঙ্গবন্ধু এ ব্যাপারে তাঁর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন  “...দবিরুল ইসলাম তখন জেলে ছিল। তাকে সভাপতি ও খালেক নেওয়াজ খানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল। দবিরুলের ব্যাপারে কারো কোন ধরনের আপত্তি ছিল না’’। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর পাশেই থাকতেন দবিরুল ইসলাম। তাঁরা দুজনে একে অপরের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল দবিরুল ইসলামের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। হয়তোবা এ কারণেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে ঠাকুরগাঁও সফরে এলে প্রিয় সহযোদ্ধার খবর নিতে ভুলে যাননি। দেশমাতৃকার জন্য দবিরুল ইসলামের অবদানকে চিরস্মরণীয় রাখতে ঠাকুরগাঁওয়ের তৎকালীন এসডিও এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে নির্দেশ দেন ‘দবিরুল ইসলামের স্মরণে স্মৃতি ভাস্কর্য করার’। পরে ঠাকুরগাঁও পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে দবিরুল ইসলাম স্মৃতি ভাস্কর্য স্থাপিত হয়। ভাষাসৈনিক ও ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি দবিরুল ইসলাম এমএলএ এর জন্ম ১৯২২ সালের ১৩ মার্চ ঠাকুরগাঁও মহকুমার বামুনিয়া গ্রামে। শৈশব থেকেই অসম্ভব মেধা ও প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাজশাহী বিভাগীয় মায়াদেবী উন্মুক্ত রচনা প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন। লাহিড়ী এম ই স্কুল থেকে বিভাগীয় বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া দবিরুল ইসলাম ১৯৩৮ সালে ঠাকুরগাঁও হাইস্কুল (বর্তমানে জিলা স্কুল) থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। রাজশাহী কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেন। রাজশাহী কলেজে পড়াশোনার সময় আবুল হাশিমের রাজনীতির ক্লাসে পাঠ নিতে কলকাতায় আসা-যাওয়া এবং ওখানকার ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন মিটিং-মিছিলে অংশ নিতে শুরু করেন দবিরুল ইসলাম। এভাবেই ধীরে-ধীরে তাঁর ছাত্র রাজনীতির বৃহত্তর অঙ্গনে প্রবেশ ঘটে। ১৯৪০ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান লাভ করে আইএ পাস করেন তিনি। পরবর্তীতে শারীরিক অসুস্থতা, ছাত্ররাজনীতি ও ভূমিহীন কৃষক আন্দোলনসহ অন্যান্য আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পড়ালেখায় কিছুটা ছেদ পড়ে। কিন্তু ততদিনে এসব আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য তাঁর মেধাশক্তি, নেতৃস্থানীয় কর্মকান্ড ও জোরালো বক্তব্যের কারণে অনলবর্ষী বক্তা হিসেবে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে উত্তরাঞ্চলে। ১৯৪৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তির আগেই ১৯৪৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলনে ডাক পড়েছিল দবিরুল ইসলামের। সেই সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে দিনাজপুর থেকে আরও যোগ দিয়েছিলেন মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল, আবদুর রহমান চৌধুরী, রিয়াজুল ইসলাম প্রমুখ। সেদিন গণতান্ত্রিক যুবলীগের ওই কর্মী সম্মেলনে এক আগুনঝরা বক্তব্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তৎকালীন ছাত্রনেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন এবং ছাত্রনেতা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীকালে তৎকালীন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় একঝাঁক সূর্যবিজয়ী, স্বাধীনতাপ্রেমী তারুণ্যের উদ্যোগে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হলে অন্য ছাত্রনেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত করেন দবিরুল ইসলামকে; এবং ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনিই সভাপতি ছিলেন।

ছাত্রলীগ গঠনের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেতাদের অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা, মেধা আর পরিশ্রম পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ গঠনের প্রক্রিয়াকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নেয়। চলতে থাকে পাকিস্তানবিরোধী ও রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার দুর্বার আন্দোলন। সারা দেশের মতো দিনাজপুরেও ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলনের উত্তাপ। তখন ঢাকার পাশাপাশি দিনাজপুরেও দবিরুল ইসলাম নুরুল হুদা, কাদের বক্স (ছোটি ভাই), এম আর আখতার মুকুলদেরকে নিয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে ১৯৪৯ সালের ১৩ মার্চ দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজের (বর্তমানে সরকারি মহিলা কলেজ) এক ছাত্র জনসভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে রাষ্ট্র বিরোধিতার নামে জবরদস্তিমূলকভাবে কালো নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন দবিরুল ইসলাম। দিনাজপুর জেলখানায় তাঁকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। ছাত্রলীগের অন্য নেতাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও পরবর্তী পরিকল্পনা জানার জন্য বেয়নেট দিয়ে তাঁর বুকে আঘাত করা হয়। তবুও একবারের জন্যও মুখ খুলেননি এই তেজোদ্দীপ্ত ছাত্রনেতা। পরে এ ব্যাপারে হেবিয়াস কর্পাস মামলা হলে দবিরুল ইসলামকে মুক্ত করতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এ মামলা পরিচালনা করেন এবং ২১ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে তিনি মুক্তি পান। দিনাজপুর জেলখানায় নির্মম নির্যাতন ও অত্যাচারের কারণে তাঁর স্বাস্থ্য চিরতরে ভেঙে যায়। বঙ্গবন্ধুসহ বেশ কয়েকজন নেতা দবিরুল ইসলাম ও অন্য ছাত্রনেতাদের প্রতি এ রকম নির্যাতনের খবর শুনে দিনাজপুরে ছুটে যান। যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যদের সঙ্গে দবিরুল ইসলামও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কৃত হন। ১৯৫০ থেকে ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য ঢাকার বিভিন্ন সভা, সমাবেশে অংশগ্রহণ করতে থাকেন; এবং বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়ে কারাবরণও করতে হয় দবিরুল ইসলামকে। পাকিস্তান সরকারের রোষানল কখনো পিছু ছাড়েনি তার। এখানে উল্লেখ্য, যে ১৯৪৯ সালের ৪ জানুয়ারি জুলুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমাবেশ হয় এবং সেখানে শেখ মুজিব, দবিরুল ইসলাম ও নাদিরা বেগম অগ্নিঝরা বক্তব্য রেখেছিলেন, যা ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত করতে দারুণভাবে বেগবান করেছিল।

লেখক : ভাষাসৈনিক দবিরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্র, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।

সর্বশেষ খবর