বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

ইসলামের দৃষ্টিতে হত্যা ও ধর্ষণ কবিরা গুনাহ

এম এ মান্নান

ইসলামের দৃষ্টিতে হত্যা ও ধর্ষণ কবিরা গুনাহ

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদাররা জেনোসাইড বা জাতিগত নিধন চালিয়েছে বাংলাদেশে। ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে বিশ্ব ইতিহাসের এ বর্বরতম হত্যাকাণ্ডে। পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে ধর্মের ভেকধারী কিছু অপরাধী। ইসলামে মানুষ হত্যাকে জঘন্য অপরাধ বা কবিরা গুনাহ বলা হয়েছে। যারা বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করে কোরআন-হাদিসের দৃষ্টিতে তারা জঘন্য অপরাধী। গণহত্যা আরও বড় অপরাধ। নারীর সম্ভ্রমহানিও কবিরা গুনাহ। আল্লাহর যত সৃষ্টি রয়েছে এর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে মানুষ। মানব সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ ফেরেশতাদের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করেছেন এবং মানুষকে এ জমিনে তাঁর প্রতিনিধি ঘোষণা দিয়েছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদের বললেন আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন তারা বলল তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা প্রতিনিয়ত তোমার গুণকীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জানো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ৩০)। মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই আল্লাহ মানুষকে দান করেছেন সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আকৃতি। ইরশাদ করা হয়েছে, ‘আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে।’ সুরা ত্বিন, আয়াত ৪)। শুধু তাই নয়, আল্লাহর সুস্পষ্ট বাণী হচ্ছে, ‘এ বিশ্বজগতের সবকিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন কেবল মানুষেরই জন্য।’ আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য জমিনের সবকিছু।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ২৯)। আল্লাহ যেমন ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি মানব জাতির সুরক্ষা ও নিরাপত্তাও নিশ্চিত করেছেন। একজন মানুষের জীবন, সম্পদ, মানসম্মান আল্লাহর কাছে এত দামি যে কোরআন-হাদিসে এসব বিষয়ের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আল কোরআনে একজন মানুষ হত্যাকে গোটা মানব জাতিকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত ৩২)। যেহেতু একজন মানুষের জীবনের দাম এত বেশি তাই এর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্যও প্রয়োজন কঠোর আইন ও বিধান। আর তাই আল্লাহ মানুষের জীবনের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য কিসাসের মতো কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছেন। কিসাস হচ্ছে কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে এর শাস্তিস্বরূপ ঘাতককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে কিসাস গ্রহণ করা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৭৮)। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বুদ্ধিমানগণ! কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন রয়েছে, যাতে তোমরা সাবধান হতে পার।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৭৯)। আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যখন কোনো ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা করে তখন সে এতটাই অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যায় যে সে পৃথিবীতে থাকার, মনুষ্যসমাজে বাস করার অধিকার হারায়। সে হয়ে পড়ে মানব সমাজের এক মরণঘাতী ব্যাধি, মানব সমাজ টিকে থাকার জন্য যার অপসারণ অপরিহার্য। আর অপসারণের কাজটিই হয় কিসাস তথা ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাধ্যমে। ফলত এ কথা সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে কোনো ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর মানেই অন্যান্য মানুষের নিরাপদ জীবন লাভ।

ইসলামে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনো মুসলমান যাতে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের জানমালের জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ায় সেজন্য সতর্ক করে রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে খুন করবে, সে বেহেশতের ঘ্রাণও পাবে না, যদিও জান্নাতের ঘ্রাণ ৪০ বছরের পথের দূরে থেকে পাওয়া যাবে।’ বুখারি)। ভিন্নধর্মাবলম্বীদের ইলাহ তথা উপাস্যদের গালি দিতে তিনি নিষেধ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ছেড়ে যাদের তারা ডাকে তাদের তোমরা গালি দিও না। কারণ তারা সীমা লঙ্ঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকে গালি দিয়ে বসবে।’ (সুরা আনয়াম, আয়াত ১০৮)।

মূলত অন্য সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর প্রতি মহানবী (সা.) যে সহিষ্ণুতা ও উদারতা প্রদর্শন করেছেন, বিশ্বের ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে অন্য ধর্মাবলম্বীদের জানমাল, ইজ্জত-আব্র“র হেফাজত করা মুসলমানদের কর্তব্য বলে তিনি ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘তাদের রক্ত আমাদের রক্তের মতো, তাদের সম্পদ আমাদের সম্পদের মতো এবং তাদের ইজ্জত- আব্র“ আমাদের ইজ্জত-আব্র“র মতো হেফাজতযোগ্য। ইসলাম শান্তির ধর্ম। হানাহানি ও অকারণ রক্তপাতকে ইসলামে কঠিন ভাষায় ধিক্কার দেওয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ড ও অকারণ রক্তপাতকে ইসলামে গুরুতর অপরাধ বা কবিরা গুনাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুমিনের হত্যাকাণ্ড আল্লাহর কাছে সারা দুনিয়া ধ্বংসের চেয়েও বেশি মারাত্মক।’ তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘জঘন্য কবিরা গুনাহ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, কাউকে হত্যা করা, জাহান্নাম অনিবার্য হয় এমন মিথ্যা শপথ করা।’ বুখারি, মুসলিম, নাসায়ি।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর