রবিবার, ২৭ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে অস্ত্র লুটের ঘটনা

এ কে এম লুৎফুল করিম

মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে অস্ত্র লুটের ঘটনা

ইঞ্জিনিয়ার মো. সামছুল করিম, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীর যোদ্ধা। ছিলেন নৈতিকতার দিক থেকে একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। সম্পর্কে আমার খালাতো ভাই এবং একই বয়সের হওয়ায় দুজনে ছিলাম আমরা বন্ধুর মতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগরের জিন্নাহ গ্রুপের একজন সক্রিয় গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের আগে আমি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক (বর্তমান নাম রূপালী ব্যাংক লি.) চট্টগ্রাম লালদীঘির পাড় জোনাল অফিসের কর্মকর্তা ছিলাম। যুদ্ধ শুরুর মাসখানেক আগে ব্যাংকের একটি বিশেষ কাজে কক্সবাজারের রামুতে বেশ কিছুদিন থাকি এবং ২৩ মার্চ চট্টগ্রাম শহরে ফিরে আসি। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকের দুঃসাহসিক একটি ঘটনার কথা বর্ণনা করছি। ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারের পর বাঙালির মধ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি কেবল শুরু। তবে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে জ্বালাময়ী ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণই মুক্তিযুদ্ধের জন্য সাহস ও শক্তি জুগিয়েছিল এবং ৭ মার্চের ভাষণ বীর বাঙালির মনে স্বাধীনতা স্বাদের সঞ্চার ঘটিয়েছিল। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার এক দিন পর অর্থাৎ ২৭ মার্চ ঘড়ির কাঁটা দুপুর ১২টার কাছাকাছি। চট্টগ্রাম শহরের ব্যাংক-অফিস সব বন্ধ, মানুষ আতঙ্কে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তখনো চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করেনি। ২৭ মার্চ সকাল বেলা ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিমের কাছে আমি পাঠাই লালদীঘির পাড়ে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের স্ট্রং রুমে বিদেশ থেকে এলসির মাধ্যমে আসা আন্দরকিল্লার আবদুর রহিম আর্মস কোম্পানির আমদানিকৃত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মজুদ আছে। আমি ও ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিম প্রথমে একত্রে ইপিআর সদস্যদের বিষয়টি জানাই। তারপর ব্যাংকের দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার পি আর চক্রবর্তী ও সাব ম্যানেজার এম এ গফুরের বাসায় ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিম ও ইপিআর সদস্য ছয়-সাত জন যান। পি আর চক্রবর্তী ও এম এ গফুরের বাসা আমি ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিমকে দেখিয়ে দিই। ব্যাংকের ভল্ট, স্ট্রং রুম ও লকারের দায়িত্ব এ দুই কর্মকর্তার ওপরই ছিল। এ দুই কর্মকর্তাকে বাসা থেকে ধরে এনে ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিম ও ইপিআর সদস্যরা ব্যাংকের তালা খুলে স্ট্রং রুমে ঢুকে অস্ত্রগুলো বের করেন। ব্যাংকের ভল্টের চাবি সে মুহূর্ত্বে ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিমের হাতে ছিল। উল্লেখ্য, ওই সময় ব্যাংক ভল্টে কমপক্ষে ৫-৬ কোটি টাকা রক্ষিত ছিল। চাইলে ভল্টের ভিতর রক্ষিত সব টাকা ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিম ইপিআর সদস্যদের সহায়তায় নিয়ে যেতে পারতেন কিন্তু তাঁর ন্যায় ও সততা ছিল বিধায় কেউ সেদিন টাকার ওপর লোভ করেনি। তা ছাড়া ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিম ব্যাংকে প্রবেশের আগে ইপিআর সদস্যদের সবাইকে প্রথমেই বলেছিলেন, ‘আমরা শুধু অস্ত্র নেব অন্য কোনো কিছু নয়।’ ১৯৭১ সালে লালদীঘির পাড়ে এ ব্যাংকের শাখাটি আঞ্চলিক অফিস ছিল বিধায় চট্টগ্রামের অন্যান্য ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত টাকা এ শাখায় জমা হতো। এটা ছিল ওই সময়কার আঞ্চলিক অফিস। চাবি নিজের হাতে থাকা সত্ত্বেও ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিম ভল্টের টাকা স্পর্শ করেননি এবং কাউকে ধরবার সুযোগও দেননি। সেদিন ওই ব্যাংকে অন্যান্য ব্রাঞ্চের টাকাও জমা ছিল। সেদিন অস্ত্রের পাশাপাশি ব্যাংকের সব টাকা নিয়ে গেলে কারও কিছু করার থাকত না। কারণ যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেশে আইন-কানুন বলে কিছুই ছিল না। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিমের সততা ও দেশপ্রেমের কারণে ভল্টের টাকার দিকে ইপিআর সদস্যরা লোভ করেননি। হয়তো ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিম বয়সে বড় ছিলেন বিধায় ইপিআর সদস্যরা সবাই তাঁকে এ দুঃসাহসিক ঘটনার সময় মান্য করেছিলেন। শুধু একজন ইপিআর সদস্য ব্যাংকের ছোট একটি টেবিল ফ্যান হাতে করে নিয়ে যেতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিম সেটি না নেওয়ার অনুরোধ করেন এবং ইপিআর সদস্যদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে তাই আমাদের অস্ত্রের দরকার, অস্ত্র ছাড়া অন্য কোনো কিছুর মধ্যে আমরা কেউ হাত দেব না।’ ইপিআর সদস্যটি তাঁর কথা সম্মান করে টেবিল ফ্যানটি না নিয়ে রেখে দেন। এ কথা আমি ব্যাংকের কর্মকর্তা পি আর চক্রবর্তীর থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জানতে পারি। ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিমের ন্যায় ও সততা ওইদিন ইপিআর সদস্যরা অবাক দৃষ্টিতে অনুধাবন করেন। ইপিআর সদস্যরা সব অস্ত্র নেওয়ার পর ভল্টের ও ব্যাংকের চাবি পি আর চক্রবর্তীকে ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিম নিজে বুঝিয়ে দেন এবং পি আর চক্রবর্তীকে বলেন, ‘দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, বাঙালির অস্ত্রের প্রয়োজন। ব্যাংকের ভল্টের টাকায় আমরা কেউ হাত দিইনি, যুদ্ধ করার জন্য শুধু অস্ত্র নিয়েছি।’ এ ঘটনার সময় আমি ব্যাংকে প্রবেশ করিনি। আমি মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সেহেতু সেই অপারেশন বা ঘটনার সময় আমার ব্যাংকে প্রবেশ করা ও উপস্থিত থাকাটা সমীচীন হবে না ভেবে লালদীঘির অদূরে কোতোয়ালির মোড়ে অবস্থান করছিলাম। সর্বোপরি আমি এ দুঃসাহসিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলাম, তা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি। দেশ স্বাধীন হলে এ ঘটনায় আমার জড়িত থাকার বিষয়টি ব্যাংকের সবাই জানতে পারেন। বিষয়টি ছিল অনেক সম্মানের ও গৌরবের। তবে এ ঘটনার সময় ব্যাংকের নিরাপত্তায় নিয়োজিত দুজন পাহারাদার তাদের বেশি বাড়াবাড়ি ও ব্যাংকে প্রবেশে বাধা দেওয়ার কারণে ইপিআর সদস্যদের গুলিতে নিহত হন। নিহত এ দুই পাহারাদার ছিল অবাঙালি বিহারি। অস্ত্র লুটের পর কোতোয়ালির মোড়ে ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিমের সঙ্গে ইপিআর সদস্যরা এলে আমি আবার তাদের সঙ্গে একত্রিত হই। পরে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক (সাবেক মন্ত্রী) তৎকালীন মুজিব বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম এম এ মান্নানের কাছে নগরীর স্টেশন রোডের একটি রেস্ট হাউসে আমি, ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিম ও ইপিআর সদস্যরা একটি ভ্যানগাড়ির মাধ্যমে অস্ত্রগুলো পৌঁছে দিয়ে আসি। মুক্তিযুদ্ধে ইঞ্জিনিয়ার সামছুল করিম প্রথমে মুজিব বাহিনীর ও পরে গেরিলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে জিন্নাহ গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দেশপ্রেম ও সততার প্রতীক ছিলেন। ২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতের বেঙ্গালুরুতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। দেশে এনে তাঁর লাশ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।

লেখক : সাবেক এজিএম, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড; লালদীঘি শাখা, চট্টগ্রাম।

 

সর্বশেষ খবর