বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার এনডিসি (অব.)

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

প্রকৃতিবিদ ও লেখক দ্বিজেন শর্মা ইউক্রেন ভ্রমণ নিয়ে লেখেন, ‘ইউক্রেনের মাঠগুলিতে আছে এক ধরনের মমতাময় হাতছানি। দিগন্তবিসারী সব মাঠ-  গমের ভুট্টার সূর্যমুখীর। গম কাটা হয়ে গেছে। সূর্যমুখীর খেতে সূর্যের শোভা। সন্ধ্যায় মাঠপারে প্রহরীর মতো খাড়া ল্যাম্বার্ডি পপলারের স্তব্ধ সার আর নীড়ে ফেরা ঘুঘুদের ওড়াওড়ি...’ (সমাজতন্ত্রে বসবাস)। সেই সূর্যমুখী খেতের শোভাময় ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণে-আগ্রাসনে বেশ কয়েকটি শহর এখন রীতিমতো ধ্বংসস্তূপ। দিগন্তবিসারী মাঠ ও শহরে এখন মিসাইল, ট্যাংক, কামানের গর্জন। শত শত বছর ধরে প্রায় একত্রে বসবাসকারী আরেক স্লাভিক-ব্রাদারের সৈনিকরা এখন ইউক্রেনীয়দের মৃত্যুদূত। রণাঙ্গন থেকে প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার দূরের বাংলাদেশেও আছড়ে পড়ছে যুদ্ধের ঢেউ। বাংলাদেশ কোনো পক্ষে না থাকলেও ৩ মার্চ ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে আটকে থাকা বাংলাদেশি জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’তে অজ্ঞাত মিসাইল হামলায় নিহত হয়েছেন নৌ-প্রকৌশলী হাদিসুর রহমান। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে এর প্রভাব, করণীয় ও শিক্ষণীয় কিছু বিষয় এখানে সংক্ষেপে আলোকপাত করব। রুশ বাহিনী বিভিন্ন স্থানে ইউক্রেনীয়দের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে রাশিয়ার অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে। ইউক্রেন অভিযানের পর রুশ বাহিনীর প্রধান লক্ষ্য ছিল কিয়েভ দখল। কিন্তু ২৫ মার্চ রুশ সামরিক বাহিনী ঘোষণা দেয়, তাদের এখন মূল অগ্রাধিকার হচ্ছে ইউক্রেনের রুশপন্থি সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল দনবাসকে পুরোপুরি মুক্ত করা। সম্ভবত শক্ত প্রতিরোধের মুখে আগামী দিনগুলোয় রুশ বাহিনী ছোট লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে। স্থলযুদ্ধে গতি না বাড়ালেও রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে শহরগুলোয় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। এরই মধ্যে ২৮ মার্চ দুই পক্ষ পুনরায় তুরস্কে আলোচনায় বসছে।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২ মার্চ রুশ আগ্রাসনের নিন্দা এবং অবিলম্বে ইউক্রেন থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব ১৪১-৫ ভোটে পাস হয়। বাংলাদেশসহ ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। বাংলাদেশের এ অবস্থানের সঠিকতা নিয়ে মতভিন্নতা আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আর্টিক্যাল-২৫-এ স্পষ্ট বলা আছে, বাংলাদেশ যে কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিপক্ষে থাকবে। মনে রাখতে হবে, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আমাদের নৈতিক অবস্থান যেন দুর্বল না হয়। বাংলাদেশ যখন বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ ছিল, তখন বিশ্বের প্রতাপশালী দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ন্যায়সংগত লড়াই ও প্যালেস্টাইন, ভিয়েতনাম ইস্যুতে সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তবে ২৪ মার্চ ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার জেরে সৃষ্ট মানবিক সংকট নিরসনে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্নে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আনা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশ। প্রস্তাবটি ১৪০ ভোটে পাস হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘এ প্রস্তাবে মানবিক কারণে নির্যাতিত ও আহতদের জন্য সব ধরনের সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। সে কারণে আমরা এ প্রস্তাবে সমর্থন করেছি।’ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারত প্রত্যক্ষভাবে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিল। অন্যদিকে পরোক্ষভাবে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করেছিল। পাকিস্তানের পরাজয়ের সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে ১৯৭১-এর ৪ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনলে সোভিয়েত ইউনিয়ন সে প্রস্তাবে ভেটো দেয়। পরবর্তী সময়ে আরও দুবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনা হলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন পুনরায় ভেটো দিয়েছিল। এ ছাড়াও যুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তান বাহিনীকে সহায়তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠায়। এর প্রত্যুত্তরে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ও ১৩ ডিসেম্বর ভ্লাডিভস্টক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রশান্ত মহাসগরীয় নৌবহরের দুই স্কোয়াড্রন ক্রুজার ও ডেস্ট্রয়ার এবং একটি পারমাণবিক ডুবোজাহাজ (সাবমেরিন) পাঠায়। সোভিয়েত নৌবহরের নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাডমিরাল ভ্লাদিমির ক্রুগ্লিয়াকভ। তবে পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও কিসিঞ্জার স্ব স্ব স্মৃতিকথা ও কিছু মার্কিন দলিলে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতকে সতর্ক করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সপ্তম নৌবহর পাঠানো হয়েছিল বলে দাবি করা হয়। কারণ যা-ই হোক, সোভিয়েত উদ্যোগগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে বাঁক পরিবর্তনকারী অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিল। এজন্য বাংলাদেশের জনগণ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে কৃতজ্ঞ।

মুক্তিযুদ্ধকালে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত চট্টগ্রাম বন্দর পুনরায় চালুকরণে সোভিয়েত নৌবাহিনী অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিল। রিয়ার অ্যাডমিরাল সের্গিয়েই পাভলভিচ জুয়েনকোর নেতৃত্বে সোভিয়েত নৌবাহিনীর প্রায় ৮০০ নৌ সেনা এ নৌ-উদ্ধারাভিযানে (এপ্রিল ১৯৭২-জুলাই ১৯৭৪) অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে রুশ নাবিক ইউরি ভিকটোরোভিচ রেডকিন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল। এ স্থানটি অর্থাৎ ‘রেডকিন পয়েন্ট’ বাংলাদেশ নেভাল একাডেমির এলাকাভুক্ত। বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ইউরি রেডকিন। বাংলাদেশ নৌবাহিনী অপরূপ বৃক্ষলতা ও ফুলে ভরা এক স্থানে রেডকিনের জন্য একটি দৃষ্টিনন্দন সমাধি নির্মাণ করেছে। বাংলার মাটি পরম আদরে এ রুশ নাবিককে ধারণ করে আছে। শ্রাবণ ও বসন্তকালের পূর্ণিমারাতে পতেঙ্গা সৈকতে জ্যোৎস্নার প্লাবন হয়। তখন রেডকিনের মায়াবী সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে যে কেউ হয়তো বলবেন, পৃথিবীর সুন্দরতম এক স্থানে ঘুমিয়ে আছেন রেডকিন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরের লালদীঘির পাড়ে ইউরি রেডকিন স্মরণে চমৎকার স্মারক- ভাস্কর্য (রেডকিন মেমোরিয়াল) নির্মিত হয়েছে।

সোভিয়েত নৌবাহিনীর উপরোল্লিখিত দুটি মিশনে কয়েক হাজার সোভিয়েত নৌ সেনা অংশগ্রহণ করেছিলেন। এদের সবাই কিন্তু রুশ ছিলেন না। তাদের মধ্যে হয়তো ইউক্রেনেরও কিছু নৌ সেনা ছিলেন। সে বিচারে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সৃষ্ট রাশিয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউক্রেনেরও আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রয়েছে এবং আমাদের বন্ধু। সর্বোপরি সে সময়ের প্রধান সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেড ছিলেন ইউক্রেনে জন্মগ্রহণকারী। উল্লেখ্য, তাঁর আগের প্রধান সোভিয়েত নেতা ক্রশ্চেভের জীবনের প্রধান সময় কেটেছে ইউক্রেনে।

ইউক্রেনই প্রথম যুদ্ধ যেখানে খুব অল্প সময়ে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধই’ প্রাধান্য পাচ্ছে। যুদ্ধের প্রভাবে পণ্যবাজার উত্তাল। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের পাশাপাশি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। নিষেধাজ্ঞার করলে পড়ে রাশিয়া থেকে আমদানি-নির্ভর পণ্যগুলোর দাম বাড়ছে। দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের আমদানিনির্ভর তেল, সিমেন্ট, গ্যাস, রডসহ সব নিত্যপণ্য। এদিকে পোশাক খাতেও এর নেগেটিভ প্রভাব পড়েছে। করোনা মহামারির অভিঘাত থেকে সেরে উঠতে না উঠতে শুরু হলো এ যুদ্ধ। এর ফলে বিশেষত নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। ইতোমধ্যে এ সংকট মোকাবিলায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ছয়টি সুপারিশ করেছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর। কষ্টে থাকা মানুষের দুর্ভোগ কমাতে এখন সরকারের উচিত সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু করা। এটিই এখন আমাদের যুদ্ধ।

ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটাস্কি বলেছেন, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ হবে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে তাঁদের যেসব প্রকল্প চলমান তাতে নিষেধাজ্ঞার ফলে অর্থায়ন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, এ বিষয়ে বিকল্প চিন্তাভাবনা চলছে। রাশিয়ার প্রকল্পগুলো কীভাবে সম্পন্ন করা যায় তা বাস্তবসম্মতভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত বিষয়ে নতুন নতুন ভাবনা, শিক্ষা ও দুশ্চিন্তার জন্ম দিচ্ছে। বৃহৎ বা শক্তিশালী দেশের পাশে অবস্থিত ক্ষুদ্র দেশের টিকে থাকতে হলে তাকে অবশ্যই ‘ক্রেডিবল ডেটারান্স’ অর্জন করতে হবে। এটি হবে এমন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, যেন সম্ভাব্য আক্রমণকারী বেদম মার খাওয়া বা রক্তাক্ত হওয়ার ভয়ে আক্রমণ থেকে বিরত থাকে। বুদাপেস্ট চুক্তির মাধ্যমে ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা নিশ্চিত করেছিল রাশিয়া ও আমেরিকা। অর্থাৎ অন্য দেশের ঘোষিত ও স্বীকৃত ‘নিরাপত্তা গ্যারান্টি’ শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি ইউক্রেনবাসীর। অবশেষে নিজেদের বুকের রক্ত ঢেলেই তারা দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়ছেন। ১৯৯১ সালের পর বিশ্বের তৃতীয় পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার রাশিয়াকে ফেরত দেওয়া ও একসময়ে নিজের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করার চরম খেসারত এখন ইউক্রেনকে দিতে হচ্ছে।

পশ্চিমা দেশগুলোর জঘন্য আগ্রাসনের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের (রেজিম চেঞ্জ) বিপরীতে রাশিয়ার আগ্রাসনের একটি ভিন্নতা হলো আক্রান্ত দেশটির একাংশ দখল অর্থাৎ মানচিত্র পরিবর্তন। যেমন ইউক্রেনের দনবাস এলাকার দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক দখল। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল ও ২০০৮ সালে জর্জিয়ার আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওসেটিয়া দখল। রাশিয়ার চলমান অনুসৃত নীতি অর্থাৎ আক্রান্ত দেশের মানচিত্র পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার আরও একটি দিক খুবই ভয়াবহ। তা হলো, অন্য দেশের ‘সংখ্যালঘু রুশ নাগরিক বিপন্ন’ অজুহাতে কিছু এলাকা দখল করা। শক্তিশালী দেশগুলো যদি প্রতিবেশী ক্ষুদ্র দেশের জাতীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে এমন ঘটনা ঘটায় তা হবে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত।

ইউক্রেনের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট পুতিন ইতিহাসের অপব্যাখ্যা দিয়েছেন ও ইতিহাসকে বিকৃত করছেন। ইতিহাসের ভূত যেন তাঁকে তাড়া করছে। পুরনো ইতিহাসের এমন জের টানলে অনেক ক্ষুদ্র দেশের মানচিত্রও বদলে যেতে পারে। এও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য চরম বিপৎসংকেত।

এ যুদ্ধে শক্তিশালী রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে অপ্রত্যাশিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ইউক্রেন। ইউক্রেন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষ গণযোদ্ধা হিসেবে রীতিমতো যুদ্ধ করছে। হাজার হাজার প্রবাসী ইউক্রেনীয় বিদেশের তুলনামূলক উন্নত জীবন ছেড়ে দেশে এসে অস্ত্র ধরেছে। সৈনিক-জনতার এক অপূর্ব ঐক্য। ইউক্রেন সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে এবং বিশেষ করে জনগণের কাছ থেকে রাশিয়াকে প্রতিহত করার যে উদ্যম দেখা গেছে তা রাশিয়া আশা করেনি। উল্লেখ্য, জাতীয় ঐক্যই এখন পর্যন্ত ইউক্রেনীয়দের স্বাধীনতা রক্ষা করেছে।

ইউক্রেনে ব্যবসা, চাকরি, পড়াশোনায় নিয়োজিত বাংলাদেশির সংখ্যা দেড় হাজারের কাছাকাছি। পোল্যান্ডে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন সমবর্তী দায়িত্বে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও কাজ করছেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু আগে থেকেই ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশিদের উদ্ধার কর্মসূচি শুরু হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০০ থেকে ১ হাজার বাংলাদেশি পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন। কিছু বাংলাদেশি রোমানিয়া, মলদোভা ও হাঙ্গেরিতে আশ্রয় নিয়েছেন। সার্বিকভাবে যুদ্ধাক্রান্ত ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশিদের উদ্ধার সহায়তায় পোল্যান্ডে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছে। এতে পোল্যান্ডপ্রবাসী বাংলাদেশিরাও এগিয়ে এসেছেন। ইউক্রেনে বাংলাদেশের অনারারি কনসালও বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন। এ ছাড়া ইউক্রেনের বাংলাদেশ কমিউনিটির কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি চমৎকার উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছেন। যুদ্ধের মধ্যে ইউক্রেন থেকে নাগরিকদের সরিয়ে আনতে ‘অপারেশন গঙ্গা’ নামে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে ভারত সরকার। ভারতীয়দের পাশাপাশি ইউক্রেনের সুমি থেকে কয়েকজন বাংলাদেশিকে সরিয়ে এনেছেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। একদা জার্মানির মিউনিখে এসে নিকটবর্তী ভয়াবহ ডাকাও কনসেনট্রেশন ক্যাম্প সফর করেছিলাম। ইহুদিসহ হাজার হাজার ইউরোপীয় নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল দুর্র্ধর্ষ হিটলারের এ মানবসৃষ্ট নরকে। ডাকাওয়ে এসে মনে হয়েছিল ইউরোপে আর কখনো হয়তো যুদ্ধ হবে না। অন্ততপক্ষে জার্মানি আর যুদ্ধের আয়োজন করবে না।

ডাকাও দেখে ট্রেনে চলেছি মিউনিখের পথে। অনেকক্ষণ বৃষ্টির পর ততক্ষণে দুপুরের সূর্যের আলো এসে পড়েছে চারপাশের সবুজাভ বৃক্ষলতায় আর ফুলে। মনটা হালকা হয়ে ওঠে। কিন্তু না...। ইউরোপের দুটি দেশ আবারও ভয়ংকর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। জার্মান সরকার প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ও ছড়িয়ে পড়লে এর ঢেউ প্রবলভাবে এসে পড়বে বাংলাদেশেও। এ এক জটিল সংকট। বাংলাদেশকে তাই সব সময় এ যুদ্ধের খোঁজখবর নিতে হবে। বিশেষত আমাদের পররাষ্ট্রনীতির জন্য এটি এক অগ্নিপরীক্ষা। খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রয়োজন। ব্যাপক ভর্তুকি দিয়ে হলেও সরকারকে কষ্টে থাকা মানুষের পাশে থাকতেই হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যা বা সংকট কিছু সযোগও এনে দিতে পারে। আমাদের জাতীয় প্রতিরক্ষার বিষয়েও সতর্ক ও সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। সদা সতর্ক থাকাই তো স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। ইউক্রেনের যুদ্ধ এ বিষয়টি আবার মনে করিয়ে দিল। শান্তি ফিরুক ইউক্রেনের সবুজ প্রান্তরে।

লেখক : গবেষক, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।

[email protected]

সর্বশেষ খবর