বৃহস্পতিবার, ৩১ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক

মাজহারুল ইসলাম

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছর পূর্তি উপলক্ষে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, বর্তমানে দুই দেশের অংশীদারি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের পরিসর বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র বদ্ধপরিকর, যাতে উভয় দেশই যৌথভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুভেচ্ছাবার্তায় বলেছেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং উভয় দেশ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে বাঁচতে মরিয়া। অর্থনৈতিক উৎকর্ষতা, উন্নয়নমূলক অর্জন ও শান্তিরক্ষা মিশনের সবচেয়ে বড় অংশীদার হিসেবে নিরাপদ পৃথিবী গড়ায় বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির প্রশংসা করে ব্লিনকেন বলেন, ‘পাঁচ দশক ধরে আমরা নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে অংশীদারি বজায় রেখে চলেছি। আমাদের প্রতিরক্ষা, উন্নয়নমূলক, বাণিজ্যিক ও মানুষে মানুষে অংশীদারি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। আগামীতে সম্পর্কের ভিত্তি আরও জোরালো হবে।’ মানবাধিকার প্রশ্নে দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন হলেও এ মাসে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারি সংলাপের মাধ্যমে সম্পর্ক নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। সংলাপে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব ও এর কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে সংলাপে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়েছে, গত তিন মাসে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশের সম্পর্কের নাজুক পরিস্থিতিতে  অষ্টম পার্টনারশিপ ডায়ালগে যোগ দিতে ১৯ মার্চ ঢাকায় আসেন রাজনীতিবিষয়ক মার্কিন আন্ডার-সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। রবিবার সকালে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সংলাপে বসে দুই দেশ। এ আলোচনায় পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। আর ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড নেতৃত্ব দেন মার্কিন দলের। সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব এবং মার্কিন আন্ডার-সেক্রেটারি। দ্বিপক্ষীয় অংশীদারি সংলাপে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ ইস্যুতে বাংলাদেশকে কাছে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশি নাবিকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার চুক্তি সম্পাদনে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন মার্কিন আন্ডার-সেক্রেটারি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। করোনার কারণে দুই বছর ধরে অংশীদারি সংলাপ বন্ধ ছিল। নতুন করে সংলাপ শুরু হওয়ায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে তা অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়। র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও জিএসপি সুবিধা প্রবর্তনেও সংলাপ আলোর মুখ দেখবে এমনটিও প্রত্যাশিত। এর আগে ৩১ জানুয়ারি একই দিন দেশে মানবাধিকার সমুন্নত করার ক্ষেত্রে দুটি ইতিবাচক ঘটনা ঘটে। এর একটি হলো অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার রায়। আরেকটি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি মানবাধিকার সেল গঠনের সিদ্ধান্ত। ওই দিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ তথ্যটি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ড ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক মহা অপরাধ। কক্সবাজারের টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা দীর্ঘদিন ধরে ঘরের শত্রু বিভীষণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মাদক চোরাচালানে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছিলেন। শুরু করেছিলেন ক্রসফায়ারের নামে অবৈধ অর্থ আয়ের রমরমা ব্যবসা। তার এ পাপের রাজত্ব অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। ধরাকে সরা জ্ঞান শুরু করেছিলেন প্রদীপ। কিন্তু কথায় বলে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। টেকনাফের দাপটওয়ালা ওসি প্রদীপের পক্ষেও শেষ পর্যন্ত ছাড় পাওয়া সম্ভব হয়নি। কক্সবাজারের চাঞ্চল্যকর সিনহা হত্যার রায়ে দুই আসামির ফাঁসি ও ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে বিচারিক আদালত। ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ওসি লিয়াকতের ফাঁসির আদেশের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে অপরাধীদের অনেকে দৃশ্যমানভাবে মহাশক্তিশালী হলেও আইনের হাত আরও শক্তিশালী। টেকনাফের ওসিকে দেশবাসীর ট্যাক্সের টাকায় বেতন দেওয়া হতো। কিন্তু দেশবাসীর স্বার্থরক্ষার বদলে মাদক ব্যবসার প্রহরী হিসেবেই দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সিনহা হত্যায় জড়িত থাকার দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত প্রদীপ ও লিয়াকত পুলিশের দুজন বিপথগামী সদস্য। দেশের পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তির জন্য তারা যে বিড়ম্বনা ডেকে এনেছেন তা অপূরণীয় এক ক্ষতি। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ অপরাধের দ্রুত বিচার জনমনে আশা জাগিয়েছে। অপরাধী যে-ই হোক তাকে আইনের আওতায় আনাই সভ্য সমাজে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় বলে বিবেচিত হয়। সিনহা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত যথাসময়ে সম্পন্ন এবং অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করার ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো যে তৎপর ভূমিকা রেখেছে তা সবার জন্য অনুকরণীয়। যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাদের দেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তা দৃশ্যত বড় কোনো খবর নয়। তবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যেহেতু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে সেহেতু তা দেশের সুনামের জন্য প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। যে প্রশ্নের ইতি ঘটাতে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার সেল বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা সৃষ্টিতে অবদান রাখবে এমনটিই আশা করা যায়। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে অভিযোগ উঠেছে তার একাংশের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। পশ্চিমা দেশগুলোর অভিবাসী হওয়ার প্রত্যাশায় অনেকে কল্পকথার আশ্রয় নেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবেও মানবাধিকার ইস্যু ব্যবহার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রদীপ কুমার দাশ কিংবা লিয়াকতদের অপকর্মও দেশের সুনামে বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবাধিকার সেল দেশের অভ্যন্তরের বেপরোয়া চক্রগুলোকে সামাল দিতে সক্ষম হবে। একইভাবে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে যারা কল্পিত অভিযোগ তুলে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করছে তাদের কারসাজিও মার খাবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক।

সর্বশেষ খবর