রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

মাহে রমজানে আত্মশুদ্ধির সাধনা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

মাহে রমজানে আত্মশুদ্ধির সাধনা

আত্মশুদ্ধি আর খোদার নৈকট্য অর্জনের অসীম রহমত ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে মাহে রমজান আমাদের মধ্যে সমুপস্থিত। সুস্বাগত মাহে রমজান। আল কোরআনে আল্লাহ রব্বুল আলামিন মাহে রমজানে রোজা পালন বা সিয়াম সাধনাকে পরহেজগারী অর্জনের জন্য ফরজ বা অবশ্যপালনীয় বলে বিধান দিয়েছেন। বলা হয়েছে, ‘পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের জন্যও একই বিধান ছিল’। অর্থাৎ রোজা পালন শুধু কোরআনের বিধান ঘোষিত হওয়ার পর প্রবর্তিত হয়নি। আত্মশুদ্ধি ও বিধাতার নৈকট্য লাভের জন্য কৃচ্ছ্রসাধন ইবাদত হিসেবে শুধু ইসলামে পরিপালনীয় নয়, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মিক নির্বাণ লাভের এ সাধনা বিদ্যমান।

সিয়াম সাধনায় আত্মশুদ্ধির চেতনা জাগ্রত হয়। কর্মফলের দ্বারা আল্লাহ-প্রদত্ত নিয়ামতের স্থায়িত্বের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে- আল কোরআনের এ ঘোষণা উপলব্ধি থেকেই আত্ম তাগিদ অনুভূত হয়। সুরা আনফালের ৫৩ আয়াতে ঘোষিত হয়েছে, ‘যদি কোনো সম্প্রদায় নিজের অবস্থার পরিবর্তন না করে তবে আল্লাহ এমন নন যে তিনি তাদের যে সম্পদ দান করেন তা পরিবর্তন করবেন।’ সুরা আর রাদের ১১ আয়াতে আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘মানুষের জন্য তার সামনে ও পেছনে একের পর এক প্রহরী থাকে; তারা আল্লাহর আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।’

আল্লাহর নিয়ামত স্থায়িত্বের যে নিয়ম বা মূলনীতি তা হলো কোনো ব্যক্তি বা জাতিকে যে নিয়ামত দান করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা ফিরিয়ে নেওয়া হয় না যে পর্যন্ত না নিজের বা নিজেদের অবস্থা ও কার্যকলাপকে পরিবর্তিত করে আল্লাহর আজাবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সুতরাং নিয়ামত প্রাপ্তির পর তার জন্য শুকরিয়া আদায় করা, সচেতন দায়িত্ব পালনের দ্বারা এর মর্যাদা রক্ষা করা এবং নিজেদের মধ্যে সংশোধনীয় বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়।

কোনো কোনো সময় আল্লাহ তাঁর নিয়ামত এমন কোনো কোনো লোক বা সম্প্রদায়কে দান করেন যে তার নিজের বা নিজেদের আমল বা কর্মের দ্বারা তার যোগ্য নয়, কিন্তু প্রদত্ত হওয়ার পর যদি সে নিজের আমল বা কর্মধারা সংশোধন করে কল্যাণের দিকে ফেরানোর পরিবর্তে মন্দ কাজের দিকে আরও বেশি উৎসাহী হয়ে পড়ে, তখন প্রদত্ত নিয়ামত তার বা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

আল্লাহ মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি, ভালোমন্দ জ্ঞানসহ সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর প্রিয় বান্দা বিপথগামী হয়ে তাঁর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হোক তা তিনি চান না, তা সত্ত্বেও কেউ সঠিক ও কল্যাণের পরিবর্তে মন্দ ও অভিশপ্ত পথ নির্বাচন এবং তথায় অনড় অবস্থান করলে; আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও তাঁর আনুগত্য ত্যাগ করে কুকর্ম, কুচরিত্র ও অবাধ্যতার পথ বেছে নিলে তার পরিণতি হয় দুঃখজনক। যে গজব নেমে আসে তা থেকে আত্মরক্ষার কোনো উপায় থাকে না। কোনো ব্যক্তি বা জাতির জীবনে কল্যাণকর পরিবর্তন ততক্ষণ পর্যন্ত সূচিত হয় না, যতক্ষণ এ কল্যাণকর পরিবর্তনের জন্য নিজেদের অবস্থা সংশোধন করে নিজেদের তার যোগ্য করে না তোলা হয়।

সুরা আল ফোরকানের ৬৩ থেকে ৭৭ আয়াতে আত্মশুদ্ধি লাভের কয়েকটি গুণ ও দোষের লক্ষণ বর্ণিত হয়েছে। প্রথম ছয়টি গুণের মধ্যে আনুগত্যের মূলনীতি এবং পরবর্তী গুণগুলো গুনাহ ও অবাধ্যতা থেকে পরিত্রাণ প্রত্যাশার/ প্রচেষ্টার নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে।

এক. নিজের বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা, আচার-আচরণ ও স্থিরতাকে সৃষ্টিকর্তার আদেশ ও অভিপ্রায়ের অনুগামী রেখে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালনের জন্য সদাসচেষ্ট থাকা।

দুই. নম্রতাসহকারে চলাফেরা, চলন-বলন, আচার-আচরণে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। যে পালনকর্তার ভরসা করে না এবং সব সময় দুনিয়ার লাভ-লোকসানের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকে সে সব সময় বিভ্রান্তিতে থাকে, দুঃখই ভোগ করে।

তিন. কথাবার্তায় নিরাপত্তার সঙ্গে সব সময় সচেতন থাকা উচিত। সালামের জবাব দেওয়া, কারও মনে আঘাত লাগতে পারে, বিরূপ ভাব ও সংক্ষোভের উদ্রেক করতে পারে এমন সংলাপ পরিহার করা। সুবচন ও সুশীল আচরণ কখনই বিতণ্ডার জন্ম দেয় না।

চার. ইবাদতে রাত্রি জাগরণ। যে সময় নিদ্রা ও বিশ্রামের সে সময়ে কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও নামাজে দাঁড়ানোর মতো উত্তম কিছুই নেই। এ ইবাদত লোক দেখানোর জন্য নয় এবং এখানে নাম-যশের আশঙ্কা নেই।

পাঁচ. দিনরাতে ইবাদতে মশগুল হয়েও নিশ্চিন্ত হয়ে বসে না থাকা। আল্লাহকে ভয় করা, জীবিকা অন্বেষণ ও তাঁর সাহায্য কামনা করা।

ছয়. ব্যয় করার সময় অপব্যয় না করা, আয়-ব্যয়ের মধ্যে সমতা বজায় রাখা। বৈধ ও অনুমোদিত কাজে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করাও অন্যায়-অপব্যয়। রসুলে করিম (সা.) বলেছেন, ব্যয় করতে গিয়ে মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করা মানুষের বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। যে ব্যক্তি ব্যয়ের সময় মধ্যবর্তিতা ও সমতার ওপর কায়েম থাকে, সে কখনো ফকির ও অভাবগ্রস্ত হয় না।

সাত. শিরক সর্ববৃহৎ গুনাহ। দুনিয়ার ভালোমন্দে কাউকে নিয়ন্ত্রক ভাবাও শিরক।

আট. কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা না করা এবং ব্যভিচারের নিকটবর্তী না হওয়া।

নয়. তওবা করা। কঠোর অপরাধী যদি তওবা করে এবং বিশ্বাস স্থাপন করে সৎকর্ম করতে থাকে তবে আল্লাহ তার মন্দ কর্মগুলোকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন।

দশ. মিথ্যা ও বাতিল মজলিসে যোগ না দেওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়া।  যদি কেউ মিথ্যা ও বাতিল মজলিসের নিকটবর্তী হয়ে পড়ে তবে গাম্ভীর্য ও ভদ্রতা সহকারে তা এড়িয়ে বা পরিহার করে চলে যাওয়া উচিত।

এগারো. আল্লাহর আয়াত ও শরিয়তের বিধানাবলি শুধু পাঠ করা যথেষ্ট নয়, শ্রবণশক্তি ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের উচিত এগুলো সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা।

বারো. নিজ সন্তান-সন্ততি ও স্ত্রীর জন্য আল্লার কাছে দোয়া করা। তাদের আল্লার আনুগত্যে মশগুল দেখা।

কোনো কিছুর বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকা উচিত। মাত্রা অতিক্রম করলে অনেক ভালো জিনিস মন্দ রূপ বা আকার ধারণ করতে পারে। যেমন মাত্রা অতিক্রম করলেই সাহস হঠকারিতায়, আত্মোৎসর্গ আত্মহত্যায়, প্রতিযোগিতা হিংসায়, ধর্মভীরুতা ধর্মান্ধতায় পরিণত হতে পারে। অবস্থাবিশেষ সমালোচনা পরচর্চায়, প্রশংসা চাটুবাদে, তেজ ক্রোধে, দেশপ্রেম দেশদ্রোহিতার স্তরে নেমে আসতে পারে। সব দেশ, সমাজ-সংসারে রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতির অবকাঠামোয় এটি প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়।

নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রা যেমন সবার পছন্দ তেমনি সুরের মধ্যে পঞ্চম-স্বরই মিষ্ট ও শ্রেষ্ঠ। আল কোরআনে আল্লাহ রব্বুল আলামিন বারবার বলেছেন, ‘তোমরা কোনো কিছুতেই সীমালঙ্ঘন কোরো না। আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না।’ লোকমান হাকিম তার ছেলেকে উপদেশাচ্ছলে বলেছেন, ‘মাটিতে হাঁটবে মধ্যম মেজাজে আর তোমার স্বর হওয়া উচিত মোলায়েম, স্বরের মধ্যে গাধার স্বরই নিকৃষ্ট।’

করোনাকালে এ শিক্ষা সবাই পেয়েছে যে স্বাস্থ্যবিধি মানা মানে খাওয়া-দাওয়া, চলাচল, চাওয়া-পাওয়া, মেলামেশা, আগ্রহ-আকাক্সক্ষার ক্ষেত্রে একটা পরিমিতিবোধ মেনে চলা। নিয়ম-নিষ্ঠা পালন ও সহনশীলতা প্রকাশ যে কোনো বিশৃঙ্খল পরিবেশে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারে। অধিক ভোজনই অধিকাংশ রোগবালাইয়ের কারণ। মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা সরবরাহে সমস্যা সৃষ্টি করে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। অধিক পরিশ্রমে মন ও শরীর ভেঙে পড়ে। অতিকথনে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। অতিরিক্ত সবকিছু খারাপ। অতিভক্তি চোরের লক্ষণ- এর চেয়ে সত্যবাক্য আর নেই।

লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ খবর