সোমবার, ৪ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের রুখতে হবে

খায়রুল কবীর খোকন

কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের রুখতে হবে

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে এ দেশে এখন এমন অবস্থা দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের বেঁচে থাকার যেন কোনো উপায় নেই। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের নাভিশ্বাস চলছে অযৌক্তিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দুর্গতিতে। এ শ্রেণির মানুষের নিয়মিত আয় বা বাড়তি পরিশ্রমের আয়, অতি কষ্টের সঞ্চয়ের অর্থ সবকিছু খেয়ে ফেলছে কালোবাজারি, মুনাফাখোর আর মজুতদারদের ভয়ংকর মাফিয়া সিন্ডিকেট। অবৈধ আয়ের লালসার উন্মত্ততায় তারা দেশ-মানুষ শোষণের আর আমাদের সমাজের অর্থকাঠামো নিংড়ে খাবার নিষ্ঠুর চক্রান্তে লিপ্ত। গণমানুষের ‘ত্রাহি ত্রাহি রব’ উঠেছে চারদিকে। প্রতিকারহীন দশা, ক্ষমতাবানরা কেবল মিথ্যা আশ্বাসে ভুলিয়ে রাখার অপচেষ্টার মধ্যে স্বান্ত্বনা খুঁজছেন।

এ সংকট পাকিস্তান আমলে ছিল, ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলেও, তবে এ ‘মাফিয়া সিন্ডিকেট’ সবচেয়ে শক্তিধর হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সত্তর ও আশির দশকে। এবং তারপরে তাদের কেউই থামাতে পারেনি, টানা রমরমা কালোবাজারি, মুনাফাখোর ও মজুতদারদের। মাঝেমধ্যে শাকসবজি বা পিঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদের বা মরিচ ইত্যাদির কখনোবা চালের-গমের দাম দেশি কৃষকদের খেতের উৎপাদনের নতুন ফসল ঘরে ওঠার সময়কালে দুই-তিন মাস সাময়িকভাবে কমে আসে। কিন্তু অচিরেই তা আবার বেড়ে যায়।

দরিদ্র, হতদরিদ্র আর মধ্যবিত্তের এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তের এ জীবনযাপনের সংকট নিয়ে কোটি কোটি কথা খরচ হয়, প্রতিটি সরকারই কিছু না কিছু প্রতিরোধমূলক প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু ফলাফল শূন্য। টিসিবির পণ্য সরবরাহ যা চলে তা জোটে খুবই স্বল্প সংখ্যক নিম্নআয়ের মানুষের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে। চাহিদার তুলনায় ১০ শতাংশ নিত্যপণ্যও সরবরাহ করতে পারছে না টিসিবি। কোটি কোটি দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষ নিত্যপণ্য কিনতে না পেরে তাদের কান্নাকাটি, আহাজারি, চিৎকার সবকিছুই যেন দাঁড়ায়-‘মরি অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে।’

কয়েকদিন আগে এক জনসমাবেশে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, যদি অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সক্রিয় না হয় তাহলে দ্রব্যমূল্য অচিরেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে। মন্ত্রীর আশ্বাসের নমুনা দেখে সেই পুরান ঢাকার রসিক ঘোড়া গাড়িচালকের সরস বিদ্রƒপ মনে পড়বে সবার-‘সাব, আস্তে কন, হুনলে ঘোড়ায় বি হাসব।’ (যদিও সেটা ছিল ঘোড়ার গাড়ির ভাড়ার দরদাম করার বিষয়ে)। তবে আমাদের অর্থবিত্তবান ব্যবসায়ী বাণিজ্যমন্ত্রীর এহেন সান্ত্বনার বাণীর পরে যে কেউই এ কথা বলে বসতে পারেন! এ দেশে মজুতদার মুনাফাখোর সিন্ডিকেট সক্রিয় আবার কবে না ছিল? কবে তারা নিষ্ক্রিয় ছিল? মন্ত্রী-আমলাদের হাতজোড় করা কাকুতি-মিনতি কি মুনাফাখোরদের শোনার সময় আছে!

স্বাধীনতা-পরবর্তী বছরগুলোতে ব্যবসায়ীদের মুনাফাখোরী সিন্ডিকেট সব সময়ই সক্রিয় ছিল, মাঝে মাঝে কোনো কোনো সরকারের আমলে তারা নিজেরাই সাময়িকভাবে একটু লাগাম টেনে ধরে দ্রব্যমূল্যের পাগলাঘোড়াটাকে একটু সামলে রাখত, নিজেদের কৌশলগত নিরাপত্তার স্বার্থে। হ্যাঁ, ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে এ মুনাফাখোর, মজুতদার ও কালোবাজারি সিন্ডিকেট, একটু নিয়ন্ত্রিত থেকেছে নিজেদের গরজেই-সে সময়কার সরকার একটু চড়া মেজাজের ছিল এসব অপরাধীর নিয়ন্ত্রণে, সেটা সবারই জানা। তবে ১৯৭৮ সাল থেকে রাজনৈতিক ডামাডোলে বাজারের ওপরে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ায় আবার এসব মজুতদার ও মুনাফাখোর সক্রিয় হয়ে কালোবাজারির সুযোগ নিতে শুরু করে। পরে তা ক্রমে খুবই খারাপ পর্যায়ে যেতে থাকে।

আসল সমস্যাটা হচ্ছে আমাদের ব্যবসায়ীদের মনস্তাত্ত্বি¡ক সংকট-পুরো ব্যবসায়-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত সমগ্র জনগোষ্ঠীর মানসিক সমস্যা। তারা ধরে নিয়েছে ব্যবসায়-বাণিজ্য তারা করেন নিজেদের পুঁজি ও শ্রম বিনিয়োগ করে যথেষ্ট ঝুঁকির বিষয়টি মাথায় নিয়ে, তাই তাদের অবাধ মুনাফা সুযোগ পেতেই হবে। মুনাফার মাত্রাটা কী হবে, কী হলে কতটা যৌক্তিক ও সাধু পন্থার বলে বিবেচিত হতে পারে, সে বিষয়টি তারা যুক্তি দিয়ে মানতে নারাজ। বিশ্বব্যাপী একটা সভ্য সংস্কৃতি হচ্ছে- মূল পুঁজি বিনিয়োগের পরে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার যৌক্তিক সব খরচ (এমনকি উদ্যোক্তার যুক্তিসংগত মাসিক বেতন অবধি ধরে) বাদ দিয়ে বছরে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মুনাফা অর্জন করা বিধিসঙ্গত। কিন্তু আমাদের দেশের ‘মজুতদার, মুনাফাখোর ও কালোবাজারি সিন্ডিকেট’ মনে করে ‘এ মুনাফা যদি ১০০ শতাংশ বা আরও বেশি মাত্রায়ও হয় তা-ও যুক্তিসঙ্গত, এটা তাদের পুঁজি বিনিয়োগ, সরবরাহ সার্ভিস দেওয়া ও ঝুঁকি গ্রহণের বৈধ উপার্জন।’ মজার ব্যাপার হলো-এসব ব্যবসায়ীদের বিশাল অংশই ধর্মআচরণে বেশ ‘ইমানদার ভাবসাব’ প্রদর্শন করে থাকেন। তাই তারা যে পাপকাজ করছেন সেটাও তারা মানতে নারাজ। (তারা বলে থাকেন, মহান সৃষ্টিকর্তা সুদকে হারাম আর ব্যবসা-বাণিজ্যের মুনাফা অর্জনকে হালাল ঘোষণা করেছেন)। তারা বুঝতেই চান না যে, ক্রেতাসাধারণকে ঠকিয়ে, এভাবে তাদের ব্ল্যাকমেলিং করে কালোবাজারি গুরুতর অপরাধ, এ ধরনের মুনাফাখোরী শতভাগ পাপ কাজ।

সাধারণ মানুষ অসংগঠিত। তাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে অসৎ ব্যবসায়ীদের পড়ার আশঙ্কা নেই। আর সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী আর আমলা গোষ্ঠীর বাজারের ওপরে নিয়ন্ত্রণ করার বৃদ্ধিমত্তা বা কৌশল কোনোটাই জানা নেই। আইনের মাধ্যমে মুনাফাখোর, মজুতদার ও কালোবাজারি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। একটা ব্যয়বহুল সরকারি প্রতিষ্ঠান থাকলেও, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার পরেও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের ব্লাকমেলিং প্রক্রিয়া এমনই কঠিন যে, তাদের শাস্তিদানের মাধ্যমে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা একেবারেই অসম্ভব। ব্যবসায়ীদের কাউকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অতি মুনাফাখোরীর শাস্তিদানের লক্ষ্যে জেল-জরিমানা করতে গেলে অথবা আদালতে নিয়ে বিচারের লক্ষ্যে গ্রেফতার করতে গেলে অসাধু সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়। সরবরাহ ব্যবস্থায় নৈরাজ্য সৃষ্টি চক্রান্ত চালায়। ফলে কৃত্রিম সংকট আরও বেড়ে গিয়ে বাজার পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। এমনকি চাল, ডালের সরবরাহ একেবারে বন্ধ করে দিয়ে সংকট সৃষ্টি করতে পারে এ মুনাফাখোর সিন্ডিকেট-সে আতঙ্ক সরকার ও প্রশাসনকে তটস্থ করে রাখে। ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন চেম্বার প্রতিষ্ঠান এমনকি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এ সিন্ডিকেটের পক্ষেই কাজ করতে বাধ্য হয়। এ সিন্ডিকেটের বিপক্ষে যাওয়ার কারও ক্ষমতাই নেই। চেম্বারগুলোতে এমনকি ফেডারেশন বডিতে যারা ভালো মানুষ রয়েছেন যাদের বেশির ভাগই শিল্পোদ্যোক্তা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই, তারা কিছুটা হলেও এসব কালোবাজারি, মুনাফাখোর সিন্ডিকেটের বাইরের লোক, কিন্তু তারা পরবর্তী নির্বাচনে বিভিন্ন চেম্বার সদস্যদের ভোট হারানোর আশঙ্কার কথা ভেবে অনেকেই অপরাধী-ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সপক্ষে জোরালো অবস্থান নিতে ভয় পান, তাই আসল ঘটনা চেপে যান। আর বিভিন্ন দলীয় রাজনৈতিক সরকারের আমলে বিশাল চাঁদা পাওয়ার স্বার্থেও এ বাজার অনাচার বেড়ে যায়। এখন যেমন বিএনপি নেতা প্রফেসর ড. খোন্দকার মোশররফ হোসেন ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বর্তমান সরকারি দলের নেতাদের কালোবাজারিদের সঙ্গে অবৈধ অর্থ-আয়ের আঁতাতের অভিযোগ তুলেছেন। 

অন্য ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একবার ফলদায়ক হয়েছিল বলে আমাদের বাম নেতাদের এক আলোচনা সভার সূত্রে জানা যায়। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আমলে ১৯৭৭-১৯৭৮ বন্যার সময়ের ঘটনা। বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হলো দ্রব্যমূল্য বাড়তে লাগল অস্বাভাবিক হারে। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু নির্দেশ দিলেন তার সিপিআই (এম) দলীয় কর্মীদের-‘আমি পুলিশ দিয়ে সমস্যার সমাধান চাই না, তোমরা দলীয় কর্মীরা বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে প্রতিটি বাজারে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে পড়, ব্যবসায়ীদের বল-‘কেউ বন্যার আগেকার দামের চেয়ে এক পয়সাও বাড়াতে পারবেন না, কোনো পণ্যের, যদি সরবরাহ না থাকে দেশে না পাওয়া যায়, মানুষ না খেয়ে থাকবে।’ আমরা সেই অবধি দেখতে চাই-দাম বাড়ার কোনো যুক্তি নেই।’ কর্মীরা তা-ই করলেন এবং সফল হলেন শতভাগ। ‘কালোবাজারি ঠেকানোর লাঠিধারী কর্মী অ্যাকশন’-এর এ ম্যাজিক অ্যাকশন থেকে আমরা শিক্ষা নিয়ে কি কিছু করতে পারি? 

 

                লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ, সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর