সোমবার, ৪ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা
আন্তর্জাতিক

এ যুদ্ধ থামাতে হবে

আবুল কালাম আজাদ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। এ যুদ্ধ শুধু অভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দুই প্রতিবেশী দেশ নয়, বিশ্বের সাত শ কোটিরও বেশি মানুষের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব দুনিয়াজুড়ে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের পথ উন্মোচন করেছিল। দুনিয়ায় গত এক শ’ বছরে দেড় শর বেশি স্বাধীন রাষ্ট্রের আবির্ভাবের পিছনে সে বিপ্লবের প্রভাব প্রাতঃস্মরণীয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও সোভিয়েত বাহিনীর লড়াকু প্রতিরোধ মিত্রশক্তির জয় নিশ্চিত করে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত সমর্থন অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে। আজকের রাশিয়া ও ইউক্রেন অভিন্ন সোনালি ঐতিহ্যের উত্তরসূরি বলে নিজেদের দাবি করলেও প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সৃষ্ট হানাহানি কোনোভাবেই কাম্য নয়। রাশিয়া ইউক্রেনের সামরিক ও অর্থনৈতিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে শুরু করেছে। লুটস্ক এবং ইভানো-ফ্রাঙ্কিভস্কের বিমান ঘাঁটিতে আঘাত করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এখান থেকেই ইউক্রেন সেনারা ৮০০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। রুশ সেনারা দক্ষিণ অঞ্চলে ইউক্রেন সেনাদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। ক্রিমিয়া হয়ে রাশিয়ার সেনারা মিকোলেইভ ও ওডেসার দিকে থাবা বিস্তার করেছে। বিভিন্ন দখল করা শহরে রুশপন্থি নতুন মেয়র নিয়োগ শুরু করেছে রাশিয়া। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ইউক্রেনে রুশ সেনারা একের পর এক শহর নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ইউক্রেনের দখল করা শহর মেলিটোপোলে রুশপন্থি নতুন মেয়রও নিযুক্ত করা হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ছয় সপ্তাহ শেষে দেখা যাচ্ছে, পুতিন যেমনটা ভেবেছিলেন তার চেয়েও অনেক শক্তভাবে পাল্টা লড়াই করতে শুরু করেছে ইউক্রেন। কিন্তু এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কী হতে পারে, সেটা বলার মতো সময় এখনো আসেনি।

বিবিসির মতে, পুতিন হয়তো আশা করেছিলেন, রাশিয়ার সৈন্যদের আক্রমণের কয়েকদিনের মধ্যেই কিয়েভের পতন হবে। তিনি হয়তো এটাও ভেবেছিলেন, যে অঞ্চলকে ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ বলে তিনি দাবি করেন, সেটাকে পুনরায় দখলে নেওয়াকে মেনে নেবে দ্বিধাগ্রস্ত এবং বিভক্ত পশ্চিমা দেশগুলো। কিন্তু এর কোনোটাই ঘটেনি। ধারণার চেয়ে অনেক শক্ত বলে ইউক্রেন নিজেকে প্রমাণ করেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবরোধে রাশিয়ার অর্থনীতি বেশ কঠিন আঘাতের মুখোমুখি হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রোধ একদিন এসে তাদের ওপরেও পড়ে কিনা, তা নিয়ে পুতিনের আরেক বড় বন্ধু দেশ, চীনও চিন্তায় পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। সেটা হলে চীনের অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে।

এই আক্রমণ থেকে নিজেদের অনেকটাই দূরে সরিয়ে রেখেছে চীন। অপরদিকে ন্যাটো জোটের আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে হয়তো ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারে। ইউক্রেন যাতে ন্যাটো জোটে যোগ দিতে না পারে, সেই জন্য এই যুদ্ধ শুরু করেছেন পুতিন। কিন্তু এর ফলে হয়তো তার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ন্যাটো জোটের সদস্য সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে।

পুতিন চলেন নিজস্ব স্টাইলে, তিনি খুব কম লোকের পরামর্শই নিয়ে থাকেন। ধারণা করা যায়, তারাও শুধুমাত্র সেসব পরামর্শই তাকে দেন, যা তিনি শুনতে চান। এখন হয়তো তাকে নতুন বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে। পুতিন যখনি কোনো সমস্যায় পড়েন, তিনি পিছিয়ে যেতে অস্বীকার করেন। সুতরাং এখনো তিনি ইউক্রেনে আরও বিধ্বংসী হামলার কথা হয়তো ভাবছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত দাবি করেছেন যে, রাশিয়ার সৈন্যরা এর মধ্যেই থার্মোব্যারিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে- যাকে অনেকে ভ্যাকুয়াম বোমা বলে বর্ণনা করেন। এই বোমাটি আশপাশের অক্সিজেন টেনে নিয়ে উচ্চ তাপমাত্রার বিস্ফোরণ তৈরি করে। রাশিয়া থেকে থার্মোবারিক রকেট লঞ্চার ইউক্রেনের দিকে ছোড়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে।

২০০৮ সালের একটি আন্তর্জাতিক সনদে থার্মোব্যারিক বোমা নিষিদ্ধ করা হয়। তবে রাশিয়া ওই সনদে স্বাক্ষর করেনি। রাশিয়ার দাবি, আন্তর্জাতিক মানবতার রীতি মেনেই তারা ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার করে। কিন্তু ইউক্রেনের ভুক্তভোগী মানুষ সেই দাবির সঙ্গে একমত হবে না।

ভয়ংকর রকমের মারণাস্ত্র ব্যবহার নিয়ে পুতিনের মধ্যে কখনোই কোনো দ্বিধা ছিল না। পুতিন বলেছেন যে, ইউক্রেনের ব্যাপারে কেউ যদি বাইরে থেকে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। তিনি অনেকবার এরকম কথা বলেছেন, যে বিশ্বে রাশিয়ার জায়গা হবে না, সেই বিশ্বের টিকে থাকার দরকারটাই বা কী? তবে এটাও বলা দরকার, একটি পারমাণবিক সংঘর্ষের আশঙ্কা তখনই তৈরি হবে, যখন ন্যাটো তাদের হিসেবে সাংঘাতিক কোনো ভুল করবে। বিবিসির মতে, ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে। ১৯৩৯ সালে জোসেফ স্তালিন ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে আশা করেছিলেন যে, কয়েকদিনের মধ্যেই সেটি দখল করে নেবেন। কিন্তু তারা পাল্টা লড়াই শুরু করে। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। তথাকথিত শীতকালীন যুদ্ধ শেষ হতে এক শ দিনের বেশি লেগে গিয়েছিল। সেই যুদ্ধে ফিনল্যান্ড কিছু এলাকা হারিয়েছে, কিন্তু স্বাধীন দেশ হিসেবেই টিকে গিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রেও সেরকম সম্ভাবনাই দেখা দিয়েছে। ইউক্রেনে রুশ হামলা স্বাধীন একটি দেশের অস্তিত্ব যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তেমন বিশ্বের সাত শ কোটিরও বেশি মানুষকে ফেলেছে সংকটে। যুদ্ধের কারণে দুনিয়াজুড়ে জ্বালানি তেল, গ্যাস, ভোজ্য তেল ও গমের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। দুঃখ-কষ্ট ও অনাহারের সম্মুখীন হচ্ছে কোটি কোটি মানুষ। মানবতার স্বার্থে এ যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হবে।

                লেখক : প্রাবন্ধিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর