শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

ভায়োলেন্স কোনও সমস্যার সমাধান নয়

তসলিমা নাসরিন

ভায়োলেন্স কোনও সমস্যার সমাধান নয়

শেষ পর্যন্ত কিন্তু উইল স্মিথকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। অ্যাকাডেমির পুরস্কার হাতে নিয়ে অ্যাকাডেমির কর্তৃপক্ষের কাছে, নমিনেশান পাওয়া আর সব অভিনেতার কাছে, উইলিয়ামস পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইলেও ক্রিস রকের কাছে ক্ষমা না চাওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন, কিন্তু তাতে যে পার পাওয়া যাবে না তা টের পেয়ে ক্রিসের কাছে পরদিন ক্ষমা চেয়েছেন। ক্রিস ক্ষমা করে দিয়েছেন, তিনি উইলের বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনের কোনও মামলা করেননি। কিন্তু অ্যাকাডেমি তাঁকে ক্ষমা করবে না। কিছু না কিছু শাস্তির ব্যবস্থা তো নেবেই। মঞ্চে উঠে অ্যাকাডেমির নিয়ম ভাঙার পর উইল স্মিথকে বলা হয়েছিল ডলবি থিয়েটার থেকে বেরিয়ে যেতে, তিনি তাঁদের আদেশ-অনুরোধ অমান্য করে ঠায় বসে থেকেছেন, বসে থেকে চেঁচিয়ে ক্রিসকে গালি দিয়েছেন, আবারও অ্যাকাডেমির নিয়ম ভঙ্গ করেছেন।

আমি অবাক হই, ডলবি থিয়েটার এবং টেলিভিশনের কোটি দর্শকের সামনে একটি প্রেস্টিজিয়াস পুরস্কারের লাইভ অনুষ্ঠানে উইল স্মিথ ওই অভদ্র, অশালীন, অশ্লীল, অন্যায় আচরণটি করার কিছুক্ষণ পরই সেরা অভিনেতার পুরস্কার নিতে যখন মঞ্চে উঠলেন, দর্শকরা তাঁকে স্ট্যান্ডিং ওভেশান দিলেন! নিজের চোখকে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। দর্শকের সারিতে তাহলে কি ভায়োলেন্সে বিশ্বাসী মানুষ বসে ছিলেন! কিন্তু থিয়েটারের কয়েকশ’ বা কয়েক হাজার লোকই তো শুধু দর্শক নন। সারা বিশ্বের লক্ষ কোটি দর্শক ভায়োলেন্সে বিশ্বাস করেন না। তাঁরা বিস্মিত হয়েছেন থিয়েটারের দর্শকরা সদ্য ভায়োলেন্স করে আসা একজনকে এতটা সম্মান প্রদর্শন করায়। হ্যাঁ সম্মান প্রদর্শন তাঁরা হয়তো করেছেন অভিনেতা উইল স্মিথকে। কিন্তু বর্বর স্মিথ থেকে অভিনেতা স্মিথে সুইচ করে এত শীঘ্র কী করে যেতে পারলেন দর্শকবৃন্দ, জানিনা। উইল স্মিথ ওই নৃশংস কাণ্ডটি না করে পুরস্কার পাওয়ার ভাষণে ক্রিসের নিষ্ঠুর কৌতুকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারতেন, বলতে পারতেন জেডা পিংকেটের এলোপেশিয়া রোগের কথা, যে রোগের কারণে তাঁর চুল পড়ে যাচ্ছে, তাঁকে নিয়ে কৌতুক করা কোনও সংবেদনশীল মানুষের উচিত নয়। সেটি মানুষকে বেশি স্পর্শ করতো। সেটি হলে উইলকে নয়, সেদিন চোখের জল ফেলতে হতো ক্রিসকে। ক্রিস যখন জি আই জেন ২ তে জেডাকে আবার দেখা যাবে বলে কৌতুক করলেন, উইল কিন্তু হাসছিলেন। তিনি নিজেও তো ১৯৯১ সালে আর্সেনিও হল’-এর শোতে এক ব্যান্ডের লোকের টাক নিয়ে কৌতুক করেছিলেন, বলেছিলেন ওর মাথায় ও প্রতিদিন সকালে ওয়েক্সিং করে, আবার হেসে বলেছিলেন, এটা কৌতুক ছিল। তাঁর কৌতুক নিয়ে ব্যান্ডের লোকটি কিন্তু সেদিন উইল স্মিথকে অপমান করেনি, চড়ও কষায়নি, বরং হেসেছিল। কারণ কৌতুক তো এমনই, মানুষের সবকিছু নিয়ে হাস্যরস করা। হাস্যরস সকলে পছন্দ করে বলেই তো বিলি ক্রিস্টাল, এলেন ডিজেনেরেস, বব হোপের মতো কমেডিয়ানকে ডাকা হয় সঞ্চালকের দায়িত্ব নিতে। সেদিন যদি রিকি জারভেইস সঞ্চালক থাকতেন, তাহলে কী হতো তাই ভাবি। এই ব্রিটিশ কৌতুকাভিনেতা গোল্ডেন গ্লোবের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন পাঁচবার। তাঁর কাজই হচ্ছে অভিনেতা অভিনেত্রীদের নিয়ে হুল ফোঁটানো কৌতুক করা। তিনি বলেই নেন, দুদিন পর সবাই মরে যাবো, চলো প্রাণ খুলে মজা করি। এলোপেশিয়া নিয়ে রিকি জারভেইসের লেখা টিভি সিরিজ দ্য অফিসের আমেরিকান ভারসানেই আছে কৌতুক। এলোপেশিয়া নিয়ে কৌতুক করায় রিকি রীতিমতো বিশারদ। সেদিন রিকি জারভেইস যদি জেডার এলোপেশিয়া নিয়ে কৌতুক করতেন, তাহলে মঞ্চে উঠে তাঁকে চড় নয়, দাম্ভিক এবং রাগী উইল স্মিথ তাঁর হাড়গোড় ভেঙে দিতেন। আসলেই কি দিতেন? একজন কালো ছেলের কালো ছেলেকে সজোরে চড় মারা যত সহজ, সাদা ছেলেকে চড় মারা, তার ওপর সেই সাদা যদি হয় তাঁর মতোই রিচ অ্যান্ড ফেমাস, হয়তো তত সহজ নয়।

সবকিছুর পর প্রশ্ন থেকে যায়, জেডা পিংকেটের অপমানের শোধ যদি নিতেই হয়, নেবেন জেডা পিংকেট, উইল কেন নিলেন? জেডা তো কম সাহসী মেয়ে নন। নিজের সম্মান কী করে বজায় রাখতে হয়, তা তিনি হাজারো মেয়ের চেয়ে বেশি বোঝেন। স্বামীর দায়িত্ব স্ত্রীকে রক্ষা করা, কারণ স্ত্রীরা অবলা অসহায়, উইল কি সে কারণেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বামীর রোল প্লে করতে মঞ্চে উঠেছিলেন? বর্বরতার সঙ্গে পুরুষতন্ত্র বেশ অঙ্গাঙ্গী জড়িত। সেটিই তিনি প্রমাণ করলেন। ক্রিস রকের সফিস্টিকেডের জোক্সের উত্তর তিনি সফিস্টিকেটেড কোনও জোক্স দিয়ে দিতে পারতেন। ওতে বরং তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যেত। কিন্তু তিনি রাস্তার বখাটে গুণ্ডাদের মতো আচরণ করলেন। অনেকে ভেবেছেন উইল স্মিথ তাঁর স্ত্রী জেডাকে এত ভালোবাসেন যে তাঁর কোনও অপমান তিনি সহ্য করতে পারেননি। রিয়েলি? উইল আর জেডা কিন্তু মুক্ত দাম্পত্যে বিশ্বাস করেন। উইল তো বিয়েকে কারাগারও বলেন। তাঁরা দুজন দুজনকে নিয়ে সুখী নন, তাই স্থির করেছিলেন দু’জনে আলাদা করে সুখী হবেন, তারপর দু’জন সুখী মানুষ পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হবেন। তাই সুখী হওয়ার জন্য জেডা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক করেছিলেন গায়ক অগস্ট আলসিনার সঙ্গে, উইল করেছিলেন হ্যালি বেরির সঙ্গে। এসব তাঁরা নিজেরাই দুনিয়াসুদ্ধ সবাইকে জানিয়েছেন। উইল কি অন্য কোনও মেয়েকে অপমান করা হলে মঞ্চে এভাবে প্রতিবাদ করতেন? নাকি জেডা তাঁর স্ত্রী বলেই করেছেন? তাঁর স্ত্রীকে নিশ্চয়ই তিনি তাঁর সম্পত্তি বলে মনে করেন! এ তো পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ।

সেদিন অনুষ্ঠানে আলোচনা হতে পারতো ভিনাস আর সেরেনা উইলিয়ামসের বেড়ে ওঠার অসাধারণ কাহিনী নিয়ে, আলোচনা হতে পারতো কোডা, পাওয়ার অব দ্য ডগ, কিং রিচার্ড, ওয়েস্ট সাইড স্টোরি, বেলফাস্ট ইত্যাদি সব অসাধারণ চলচ্চিত্র নিয়ে, আলোচনা হতে পারতো সেরা অভিনেতা অভিনেত্রীর অভিনয় নিয়ে, আলোচনা হতে পারতো অসাধারণ সব ডকুফিল্মের নির্মাতাদের কাজ নিয়ে। কিন্তু সব কিছু ভেস্তে দিলেন উইল স্মিথ। কারণ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনিই সব মনোযোগ কেড়ে নেবেন, কেড়ে নিয়েছেন নিপুণ এবং নিখুঁত শিল্পকর্মের জন্য প্রাপ্য সে রাতের সমস্ত মনোযোগ। তিনি সফল। সকলে সেদিন, এবং তার পরদিন এবং তার পরদিন, এবং তার পরদিন শুধু উইল স্মিথের চড়কাণ্ড নিয়েই ডুবে রইলো।

যে যতই অপমান যাকেই করুক, কারও অধিকার নেই ভায়োলেন্স করার, কাউকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করার। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অপমান সইতে জানে। ভায়োলেন্স দিয়ে অপমানের প্রতিশোধ নেয় না। মৌখিক হেনস্থার জবাব মৌখিকভাবেই দিতে হয়। অনেক সময় গালির জবাব কিন্তু গালিতে যথার্থ হয় না। হাসিতে হয়, বা উপেক্ষায় হয়, বা ভদ্র আচরণে হয়। ক্রিস রক কিন্তু সেদিন চড়ের উত্তরে লাথি বা চড় কষাননি, তিনি বলেছেন টেলিভিশনের ইতিহাসে এই দিনটি মহান হয়ে রইলো। আমি বাইবেলের মতো বলছি না, কেউ তোমার এক গালে চড় কষালে তুমি আরেক গাল পেতে দাও দ্বিতীয় চড়ের জন্য। বাইবেলের মতো আমি এও বলছি না, দাঁতের বদলে দাঁত নাও, চোখের বদলে চোখ। কোনওটিরই দরকার নেই, অত ম্যাসোকিস্ট হওয়ার দরকার নেই, অত স্যাডিস্ট হওয়ারও দরকার নেই। মনে আঘাত লাগাকে সামলে নিতে শিখতে হয়, ভায়োলেন্স কোনও মনোকষ্টের ওষুধ নয়। কোনও সমস্যার সমাধান নয়। এই শিক্ষাটি চর্চা করাই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার লক্ষণ। উইল সেদিন যে অন্যায় করেছিলেন, সেই অন্যায়ের জন্য আরও বহুকাল আরও বহু মানুষের কাছে তাঁকে ক্ষমা চেয়ে বেড়াতে হবে। শুধু ধন সম্পদের মধ্যে ডুবে থাকলেই সুখী হওয়া যায় না। মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা পেতে হয় সুখী হওয়ার জন্য। ইগো কাউকে সত্যিকার সুখী করে না। নিজেকে বিশাল কিছু ভেবে ফেলা, নিজেকে সভ্য নিয়ম-নীতির ঊর্ধ্বে ভেবে ফেলা-এও সুখী হওয়ার ভুল কৌশল। উইল স্মিথ সুখী হওয়ার জন্য মরিয়া। সুখী হওয়ার পথ, আমার ধারণা, তিনি বরাবরই ভুল নিয়েছেন।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর