শনিবার, ৯ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

প্রকৃতির বিচারটা কেউ এড়াতে পারে না

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

প্রকৃতির বিচারটা কেউ এড়াতে পারে না

প্রকৃতির বিচারটা কেউ এড়াতে পারে না। খুব কঠিন হয় সে বিচার। এতটা কঠিন যেটা কঠিনের ভিতরটাকে আরও আহত করে ক্ষতবিক্ষত করে। সেটা দেখার জন্য প্রতীক্ষা করতে হয়। অনেকটা প্রতীক্ষা। যেখানে সময় এসে প্রকৃতির সঙ্গে দাঁড়িয়ে যায়। সে সময়টা এতটাই কঠিন হয় যা কঠিনকে ভেঙে খণ্ডিত বিখণ্ডিত করে দেয়। প্রকৃতির বিচারটা খুব নীরবে, নিঃশব্দে হয়। সব মানুষ সে বিচারের ফলাফলটা বুঝতে পারে না। প্রকৃতি সেটা মানুষকে সঙ্গে সঙ্গে বলতে চায় না।

প্রকৃতি মানুষকে আগে তৈরি করে, সময়কে চেনাতে চেনাতে মানুষকে একটা শূন্যতার জায়গায় টেনে নিয়ে যায়। তারপর সময় সেটা মানুষকে একসময় জানিয়ে দেয়। তখন হয়তো সেটা ইতিহাস কিংবা একখণ্ড মমি। পাপের মুখোশটা মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়, ধসে পড়ে জনপদের পর জনপদের মানবিক মূল্যবোধ। পাপের পরিণতির আগে প্রকৃতি পাপীদের পরীক্ষা নেয়। সে পরীক্ষাটা মানুষের পরীক্ষার চেয়ে অনেক কঠিন হয়। সেটা জীবনের পরীক্ষা, যা তিলে তিলে পাপীদের আঘাত করে। অনুশোচনার কঠিন আগুনে দগ্ধ করে। প্রতিদিন তাদের পুড়িয়ে পুড়িয়ে তাদের বিশ্বাসঘাতকতার নগ্ন দেহটাকে তাদের সামনে ব্যবচ্ছেদ করে। এভাবে অনেক দিন ধরে প্রকৃতি তাদের অবিচারের বিচারটা করতে থাকে, যা একদিন চূড়ান্ত হয়। সেখানে মানুষের পৃথিবীর মতো আইন-আদালত থাকে না। পক্ষ-বিপক্ষ থাকে না। সেখানে ঠায় কংক্রিটের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রকৃতি। ক্রমাগত বোবাকান্না চেপে রাখা প্রকৃতি সরব হয়। প্রকৃতির অদৃশ্য মানসপটে ভেসে ওঠে বিদীর্ণ মহাকাল।

সময়টা ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্ব। এথেন্সের আদালতে হাজির করা হলো সক্রেটিসকে। যুবকদের পথচ্যুত করা ও প্রচলিত ধর্মের অবমাননার অভিযোগ আনা হলো তাঁর বিরুদ্ধে। অথচ এ অভিযোগগুলো ছিল ভিত্তিহীন। একটা অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন তিনি অথচ নিজেকে মাছির সঙ্গে তুলনা করতেন। নিজেকে ছোট করে ভাবতে শিখেছিলেন বলেই হয়তো এত বড় মাপের মানুষ হয়েছেন। গ্রিক দর্শনের জন্মদাতা ছিলেন তিনি। সে দর্শন আর গ্রিক দর্শন থাকেনি বরং তা কালক্রমে বিশ্বজনীন দর্শনে পরিণত হয়েছে। তিনি জানতেন তিনি কোনো অপরাধ করেননি কিন্তু তাঁকে অপরাধী বানানো হয়েছে। কারণ- ঈর্ষা, অহংকার, বিদ্বেষ। তিনি যে তাঁর প্রতিভার শক্তিতে রাজাদের রাজাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। সম্রাটদেরও ছাড়িয়ে গেছেন। সৃজনশীল চিন্তার সঙ্গে ক্ষমতা কি কখনো পেরে উঠেছে। কখনই পারেনি। ক্ষমতাধর মানুষ ইতিহাসে টিকে থাকে না, সৃষ্টিশীল মানুষই টিকে থাকে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতির অমোঘ বিধান। আদালতে দাঁড়িয়ে অসংকোচিত চিত্তে সক্রেটিস বললেন, ‘এথেন্সের মানুষ, আমি তোমাদের শ্রদ্ধা করি ও ভালোবাসি। কিন্তু তার চেয়ে বেশি দায়বদ্ধ ঈশ্বরের প্রতি। যতক্ষণ জীবন ও সামর্থ্য আছে, দর্শনচর্চা এবং শিক্ষাদান থেকে কেউ আমাকে থামাতে পারবে না। কখনো বদলাব না আমার এ পথ। যদি বহুবার মৃত্যুবরণ করতে হয়, তবু না।’ বন্দি করা হলো সক্রেটিসকে। হেমলকপানে মৃত্যুদণ্ডের সাজার ঘোষণা এলো। মানুষের পৃথিবীর প্রহসনের বিচার ছিল সেটা। প্রকৃতি নীরবে কেঁদেছে, গুমরে গুমরে মরেছে। আছারি-বিছারি খেয়েছে। তার পরও কিছু বলেনি সে সময়। কারণ প্রকৃতি অপেক্ষা করে। অপেক্ষার পর অপেক্ষা করে। তারপর সবার অলক্ষ্যে একদিন ফুঁসে ওঠে। প্রকৃতি তার মতো বিচার করে। কারাগার থেকে সক্রেটিস ইচ্ছা করলে পালাতে পারতেন। তা তিনি করেননি। তাহলে যে মিথ্যা সত্য হয়ে যেত, সত্য মিথ্যা হয়ে যেত। কখনো কখনো সত্যের জন্য মরতে হয়। প্রকৃতির বিচারটা খুব অদ্ভুত এখানেই। যারা সেদিন সক্রেটিসকে অপরাধী বানিয়েছিল, সময়কে সঙ্গে নিয়ে প্রকৃতি তাদের অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত করেছে। প্রকৃতি সে অপরাধীদের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলেছে আর মৃত্যুঞ্জয়ী কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে সক্রেটিসকে। ভাবা যায় কত বছর আগের ঘটনা। মানুষ ভাবে সময় যত ক্ষেপণ করা যাবে মানুষ তত বিষয়টিকে ভুলে যাবে। এটা মানুষের ভুল ধারণা। প্রকৃতি সব সময় জেগে থাকে।

মার্কিন লেখক ও ঔপন্যাসিক মার্ক টোয়েন একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ‘যদি তুমি রাস্তা থেকে কোনো ক্ষুধার্ত কুকুরকে বাড়িতে নিয়ে যাও এবং লালনপালন কর, তবে কুকুরটি কখনো তোমাকে কামড়াবে না। এটাই হলো মানুষ ও কুকুরের মধ্যে পার্থক্য।’ মার্ক টোয়েন প্রকৃতিকে খুব গভীর জীবনবোধ থেকে দেখেছিলেন, যা তাঁকে প্রকৃতির মতো ভাবতে শিখিয়েছে। মানুষ তো আর মানুষ নেই। মানুষের এখন দেশের প্রতি মায়া নেই। মমতা, ভালোবাসা নেই। মানুষ এখন প্রকৃতির মতো করে পৃথিবীকে দেখে না। মানুষ পৃথিবীকে দেখে তার স্বার্থের মতো করে। আপনজনের টান মানুষকে কাঁদায় না। কারণ মানুষ যে প্রকৃতির কাছে উদারতার শিক্ষাটা নিতে পারে না। সেটা নেওয়ার মতো যে একটা বড় মন থাকতে হয় তা-ও তো মানুষের নেই। না আছে মানুষের বিবেক, না আবেগ। সব যেন ভেঙেচুরে ওলটপালট হয়ে গেছে। মানুষ ভাবে প্রকৃতিকে তারা ফাঁকি দেবে। প্রকৃতির সঙ্গে লুকোচুরি খেলবে। কানামাছি খেলবে। অথচ মানুষ জানে না প্রকৃতি লুকিয়ে লুকিয়ে সবকিছু দেখে। মানুষ যত না বড় খেলোয়াড় প্রকৃতি তার থেকে আরও অনেক বড় খেলোয়াড়। অথচ বোকা মানুষ নিজেদের চালাক ভেবে প্রকৃতিকে বোকা বানাতে চায়।

আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, ‘প্রকৃতির গভীরে তাকাও তাহলে তুমি সবকিছু আরও ভালো করে বুঝতে পারবে।’ সে তাকানোটা বোধহয় মানুষের আর কোনো দিন হয়ে ওঠে না। মানুষ যদি প্রকৃতির গভীরে ঢুকতে পারত তবে প্রকৃতি মানুষের ভিতর মনুষ্যত্বের রস ভরে দিত। মানুষকে অদেখা পৃথিবীর সন্ধান দিত। তখন মানুষ ছোট থেকে ছোট জীবনের স্পন্দনগুলো খোঁজ পেত। সে বোধটা হয়ে উঠত পৃথিবীর বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলোর মতো।

মানুষ শিল্পী হতো, ছবি আঁকত কল্পনায় প্রকৃতির বুকে, যেখানে প্রকৃতি মানুষকে তার অদেখা জীবনকে দেখানোর জন্য অভূতপূর্ব শক্তি গড়ে দিত। প্রকৃতি, প্রেম ও একাকিত্বের কবি মহাদেব সাহা প্রকৃতিকে উপলব্ধি করেছেন জীবনের মর্মবাণী দিয়ে। যেমন তিনি বলেছেন, ‘আমার জীবন আমি লিখে রেখে যাব, স্বপ্নের খাতায়, সমুদ্রসৈকতে, অশ্রুজলে-ধোয়া প্রেমিকের জীবনপঞ্জিতে।’ প্রকৃতি মানুষকে কেবল তার যাপিত জীবনের সময়কে দেখায় না বরং মৃত্যুর পরের জীবনকেও দেখায়। যারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তারা সে জীবনটাকে কখনো দেখতে পায় না। উইলিয়াম শেকসপিয়র প্রায়ই বলতেন, প্রকৃতির একটা সুর আছে, অনেকেই তা শুনতে পায়। সেটা কান দিয়ে শোনা যায় না, সেটা জীবনের টুকরো টুকরো অন্ধকারের কারাবন্দি মনের ওপর আলো ফেলে শুনতে হয়। জীবনকে সূর্যের তীব্র আলোয় পুড়িয়ে শুনতে হয়। কারণ তখন গিটার, দোতারা আর বেহালার সুর প্রকৃতির সুরের সঙ্গে মিশে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। আর রেখে যায় কিছু প্রশ্ন। যার কোনো উত্তর থাকে না। কারণ সব প্রশ্নের উত্তর থাকতে নেই।

লেখক : শিক্ষাবিদ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

সর্বশেষ খবর