রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আরও কয়েকটি অপ্রচলিত পদক্ষেপ

মেজর আখতার (অব.)

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আরও কয়েকটি অপ্রচলিত পদক্ষেপ

তিন কারণে দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়ছে বলে মনে করে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। প্রথমত, স্থানীয় বাজারে কেরোসিন, ডিজেলসহ বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি; দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং তৃতীয়ত, কভিডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে। তার মানে সরকার যদি কেরোসিন, ডিজেলসহ বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেলের দাম না বাড়াত তাহলে প্রথম কারণটির কারণে মূল্যস্ফীতি হতো না বলে ধরে নেওয়া যায়। সরকার তিনটি কারণে কেরোসিন, ডিজেলসহ বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করতে সম্ভবত বাধ্য হয়েছিল। যেমন উচ্চ সংগ্রহমূল্য, পর্যাপ্ত মজুদের অক্ষমতা এবং বিদেশি মুদ্রার উচ্চ বিনিময় হার। সরকার যদি দ্বিপক্ষীয় জি টু জি সম্পর্কের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে অগ্রিম কেনা বা সংগ্রহের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা আগেই নিয়ে রাখতে পারত তাহলে এখন উচ্চমূল্যে কেরোসিন, ডিজেলসহ বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল সংগ্রহ বা ক্রয় করতে হতো না। আমরা প্রতি বছর ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের জ্বালানি তেল আমদানি করি। জ্বালানি তেল মূলত মাসিক চাহিদার ভিত্তিতে কিনি বা সংগ্রহ করি। ফলে যে মাসে জ্বালানি তেলের যে মূল্য থাকে আমরা সে মূল্যেই কিনি। কিন্তু যদি আমাদের বার্ষিক চাহিদা নিরূপণ করে তিন থেকে ছয় মাসের চাহিদা পূরণ করার জ্বালানি তেল একসঙ্গে সংগ্রহ করে দেশে মজুদ গড়ে তুলে রাখি তাহলে এডিবির যে মূল্যায়ন তথা ‘স্থানীয় বাজারে কেরোসিন, ডিজেলসহ বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি’জনিত মূল্যস্ফীতি হওয়ার সম্ভাবনা হয়তো থাকত না।

জ্বালানি তেলের মজুদ রাখতে পারলে এডিবির দ্বিতীয় মূল্যায়ন ‘আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির’ কারণে যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে তা অন্তত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে হতো না। বার্ষিক জ্বালানি তেলের চাহিদা ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্ধেক দিয়ে যদি আমরা আমাদের মুদ্রার রিজার্ভের পরিবর্তে জ্বালানি তেলের রিজার্ভ গড়ে তুলতে পারতাম তাহলে উচ্চমূল্য দিয়ে জ্বালানি তেল কিনতে হতো না। একইভাবে খাদ্য তেলের ছয় মাসের মজুদ গড়ে তুলতে পারলে তৎঘটিত মূল্যস্ফীতিও ঘটত না। কারণ বছরে আমরা ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিভিন্ন রকমের খাদ্য বা ভোজ্য তেল আমদানি করি। ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের খাদ্য বা ভোজ্য তেলের রিজার্ভ গড়ে তুলতে পারলে অবশ্যই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে এত পেরেশান হতে হতো না।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত মজুদ ভান্ডার গড়ে তুলতে পারলে অনেক স্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারত যার সুফল জনগণ ভোগ করত। আমাদের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর। চাহিদার বৃহদাংশ আমদানি করে মেটাতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজার সব সময় স্থিতিশীল থাকে না যার ভোগান্তি আমাদের পোহাতে হয়। প্রচলিত নিয়ম ও ঐতিহ্য অনুযায়ী আমদানি মূল্য পরিশোধের সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য আমরা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তুলি। এটাই চলে আসছে চিরন্তনভাবে। কিন্তু এ নিয়মের বাইরে গিয়ে এখন যদি ডলার, সোনা বা বৈদেশিক মুদ্রায় সব রিজার্ভ না রেখে কিছু অত্যাবশ্যক পণ্যের ছয় বা নয় মাসের রিজার্ভ দেশেই গড়ে তোলা হয় তাহলে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে বলে আমার বিশ্বাস। এজন্য জেলায় জেলায় যদি জ্বালানি ও খাদ্য তেল, গম, ভুট্টা, সয়াবিনসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্য, ইস্পাত ও লোহা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন রাখিমালের বড় আকারের বন্ডেড ওয়ারহাউস গড়ে তোলা যায় তাহলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেক সহায়ক হতে পারে। বন্ডেড ওয়ারহাউস নিয়ে আলাদাভাবে বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে। অনেক কৃষি ও শিল্প পণ্য সরাসরি উৎপাদকের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারলে মূল্যে অনেক সাশ্রয়ী হয়। রাষ্ট্র যদি কায়েমি স্বার্থবাদী তথা শুধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থই বিবেচনায় না রেখে জনকল্যাণের দিকে গুরুত্ব দেয় তাহলে দ্রব্যমূল্যে সহজেই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব।

পরিবহন খরচ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বহুমাত্রিক ভূমিকা রাখে। যেমন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। পরিবহন খরচ বাড়া মাত্রই আমদানিকৃত দ্রব্যের শুল্ক বেড়ে গিয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। এ এক ত্রিশঙ্কু অবস্থা। সব আমদানিকৃত দ্রব্যের পরিবহন খরচ তথা সামুদ্রিক জাহাজ ভাড়া লাগবেই। জাহাজ ভাড়া সাধারণত তিনটি কারণে বেশি ওঠানামা করে। তা হলো- আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, মালামালের পরিমাণ ও জাহাজের প্রাপ্যতা। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি যদিও আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে তবে মালামালের পরিমাণ ও সামুদ্রিক জাহাজের প্রাপ্যতা অবশ্যই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব। সমুদ্রপথে মূলত দুই ধরনের জাহাজ চলে। একটি হলো বিশালাকার মালামাল পরিবহনের জাহাজ যে জাহাজে বাল্ক বা স্তূপাকারে বা বিশাল আয়তনে মালামাল সামুদ্রিক জাহাজে আনা-নেওয়া করা হয়। অন্যটি কনটেইনার ভেসেল যাতে দুই আকারের ছোট ছোট কনটেইনারে মালামাল সমুদ্রপথে আনা-নেওয়া করা হয়। কনটেইনার ভেসেলে মালামাল পরিবহন করা সহজ ও সময় কম লাগে এবং সড়কপথেও আনা-নেওয়া করা যায় কিন্তু কনটেইনারে মালামাল সমুদ্র বা সড়ক পথে পরিবহন ব্যয়বহুল। বাল্ক শিপে অনেক বেশি মালামাল সমুদ্রপথে আনা-নেওয়া করা যায়। তবে কনটেইনার ভেসেল থেকে সময় বেশি লাগে কিন্তু ভাড়া কম। দূর বন্দর থেকে বাল্ক শিপে মালামাল পরিবহন অনেক সাশ্রয়ী ও নিরাপদ। তা ছাড়া নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে দূর বন্দর থেকে জাহাজে ভরা এবং নিজ বন্দরে মালামাল খালাস করা যায়। বাল্ক শিপ সাধারণত ১২ হাজার টন থেকে লক্ষাধিক টনের হয়। ছোট জাহাজের টনপ্রতি ভাড়া বেশি এবং বড় জাহাজের টনপ্রতি ভাড়া ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে।

আমাদের আমদানিতে দুটিই বিপরীতমুখী অবস্থান। আমরা অল্প অল্প মালামাল এবং খুব তাড়াতাড়ি মালামাল আমদানি করি। ফলে বেশি ভাড়া দিয়ে কনটেইনারে মালামাল সমুদ্রপথে নিয়ে আসি। এতে পরিবহন খরচ বেশি পড়ে এবং শুল্কের পরিমাণও বেড়ে যায় যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সরাসরি সহায়তা করে। তা ছাড়া তাড়াতাড়ি ও স্বল্প পরিমাণে মালামাল আমদানি করার ফলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে দালালদের মাধ্যমে মালামাল সংগ্রহ করা হয় যার ফলে সংগ্রহমূল্য বেড়ে গিয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। আমরা সাধারণত দুবাই ও সিঙ্গাপুর থেকে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করি। কিন্তু সরাসরি উৎপাদনকারীর দেশ থেকে সংগ্রহ করা হলে দ্রব্যমূল্য আরও সাশ্রয়ী হতো। যেসব দেশে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বেশি পরিমাণে উৎপাদিত হয় বা উৎপাদন করতে সক্ষম, সেসব দেশের সঙ্গে জি টু জি সম্পর্কের ভিত্তিতে সংগ্রহ করার ব্যবস্থা নিতে পারলে অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করা সম্ভব। যার ফলে দ্রব্যমূল্যও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতো। সেই সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির বাফার স্টক গড়ে তুলতে পারলে দ্রব্যমূল্য যখন তখন বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকে জাতি মুক্তি পেত। সবকিছুর বাফার স্টক বা মজুদ থাকলে রিজার্ভের ওপরও চাপ কমে যাবে। এতে টাকার অবমূল্যায়ন করার প্রয়োজনীয়তাও কমে যাবে। যেহেতু আমাদের সাধানুযায়ী সাধ্য নেই। তাই হয়তো সবকিছুর বাফার স্টক গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। তার জন্য বিকল্প বা অন্য ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আমাদের মোটামুটি কাছে দুবাই ও সিঙ্গাপুর বন্দর। যেখানে সবকিছু একটু বেশি দামে পাওয়া যায়। কিন্তু সব সময় কনটেইনার ভেসেল না পাওয়ার কারণে দ্রব্যাদি আনয়ন ব্যয়বহুল হয়ে যায়। চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দরের সঙ্গে দুবাই ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে প্রতিদিনের কনটেইনার ভেসেলের লাইন না থাকায় মালামাল শিপমেন্টে দেরি হয় এবং বেশি ভাড়া গুনতে হয়। এ সমস্যাগুলোর সমাধানকল্পে সরকার নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপ নিতে পারে। বাংলাদেশ থেকে দুবাই ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে প্রতিদিন একটি করে কনটেইনার ভেসেল সরাসরি যাবে এবং আসবে। আবার সপ্তাহে দুই বা তিন দিন চট্টগ্রাম-কলম্বো (শ্রীলঙ্কা)-পেনাঙ্গ (মালয়েশিয়া) আসা-যাওয়া করবে। এতে দ্রুত আমদানি ও রপ্তানির শিপমেন্ট করা যাবে এবং অনেক সাশ্রয়ী হবে। এ ব্যবস্থা করতে পারলে রপ্তানিতেও ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে এবং রপ্তানি খরচ কমবে এবং অনেক বেশি সহজ হবে। প্রতিদিন দুবাই ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে চট্টগ্রাম বা মোংলার নৌ-যোগাযোগ স্থাপন হলে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়াসহ বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের যাতায়াতে অভাবনীয় বিপ্লব সাধিত হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম -সিঙ্গাপুরের শিপমেন্ট টাইম হলো সাত দিন। এর মধ্যে ভয়েজ টাইম তিন দিন। মালয়েশিয়ার পোর্ট ক্ল্যাঙ্গ থেকেও লাগে সাত দিন। এখানে ভয়েজ টাইম হবে দুই দিন। আবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাবেল আলী বন্দর থেকে চট্টগ্রামের শিপমেন্ট টাইম ২৩ দিন যার সরাসরি ভয়েজ টাইম হবে ১০ দিন।

কনটেইনার শিপমেন্টের পাশাপাশি বাল্ক শিপমেন্ট করেও খরচ কমাতে হবে যাতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। গভীর সমুদ্রে সরাসরি মালামাল ছোট জাহাজে খালাস করা হলে একসঙ্গে লক্ষাধিক টন ধারণক্ষমতার জাহাজে গম, চিনি, ভোজ্য তেল, কয়লা, লোহা, ক্লিঙ্কার বা পাথর ইত্যাদি আলাদা আমদানি করার সামর্থ্য তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে গভীর সমুদ্র থেকে সরাসরি মালামাল খালাস করে পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত অভ্যন্তরীণ জাহাজের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি চিরাচরিত সমুদ্রবন্দরের বদলে উপকূল ও নদীতে ব্যাপকহারে নৌবন্দর ও ওয়ারহাউস নির্মাণের ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি বড় বড় বাল্ক শিপে একসঙ্গে লক্ষাধিক পরিমাণে পণ্য আমদানি, খালাস, মজুদ ও বাজারজাত করার সক্ষমতা গড়ে তোলা যায় তাহলে সরাসরি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে অনেক পণ্য সাশ্রয়ী মূল্যে আমদানি করা সম্ভব হবে যা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে যুগান্তকারী অবদান রাখবে। তা ছাড়া বড় বাল্ক শিপে পণ্য আমদানি করলে তা সরাসরি মহাসাগর দিয়ে চলে আসতে পারবে তাতে যেমন পথে কোনো দেশকে ভাড়া দিতে হবে না, জলদস্যুদের খপ্পরে পড়বে না এবং সুয়েজ খাল দিয়ে আসতে হবে না ফলে সুয়েজ টোলও দিতে হবে না। যা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। এর ফলে বড় বড় মহাসাগরগামী জাহাজ থেকে মালামাল খালাস করার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, দেশে মজুদ বাড়বে যা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাবে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখবে, টাকার অবমূল্যায়নের প্রয়োজন পড়বে না। দেশে পর্যাপ্ত মজুদ থাকলে দ্রব্যমূল্যও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বড় বড় মহাসাগরবাহী জাহাজে বাল্ক পরিমাণ মালামাল আমদানির ব্যবস্থা নিলে বিনিয়োগের সুযোগ বাড়বে, ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, জিডিপি তথা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে।

ব্যক্তির খুশি ও ইচ্ছামতো আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে দ্রব্য নির্দিষ্ট করে দিতে পারলে পণ্যের অপচয় কমবে যা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকতে সহায়তা করবে। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশে আমাদের দূতাবাসের বাণিজ্যিক কর্মকর্তাদের কর্মকান্ড বৃদ্ধি করে জি টু জি সম্পর্ক আরও নিবিড় করে যদি সরাসরি বিদেশি উৎপাদন ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সুসম্পর্ক গড়ে তোলা যায় তাহলে অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে অনেক পণ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। যা অবশ্যই পণ্যের মান নিশ্চিত করবে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরাসরি ভূমিকা রাখবে। কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণে উৎপাদনের সময় একটি বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং মূল্য স্বাভাবিকভাবে কম থাকে। ওই সময় পণ্য সংগ্রহ করতে পারলে অনেক সাশ্রয়ী হয়। আবার খনিজ পণ্য একসঙ্গে বেশি পরিমাণ সংগ্রহ করতে পারলে সাশ্রয়ী মূল্যে তা সংগ্রহ করা যায়। তা ছাড়া বিভিন্ন পণ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করলে ভালো একটি সাশ্রয়ী মূল্যে তা সংগ্রহ করা যায়। নিবিড় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও সূক্ষ্ম তদারকির মাধ্যমে যদি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন উৎপাদন বা রপ্তানিকারকদের অগ্রিম প্রদান করে সাশ্রয়ী মূল্য পাওয়া যায় তাহলে তা একটি চমৎকার ব্যবস্থা হবে। এমনিতেই আমরা এলসির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করি যা এক ধরনের অগ্রিম পরিশোধের মতোই। কারণ এলসি করতে গেলেও ব্যাংকে অগ্রিম টাকা দিতে হয় অথবা সুদ দিয়ে ঋণ নিতে হয়। এতেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু রপ্তানি বা উৎপাদনকারীকে অগ্রিম পরিশোধ করতে পারলে পণ্যের মূল্য কম হয় যা অবশ্যই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। বিশাল অঙ্কের রিজার্ভ ঘুম পাড়িয়ে না রেখে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্যের মূল্য নগদ বা অগ্রিম পরিশোধ করলে রিজার্ভের ওপর চাপ ও নিরাপত্তা হুমকি কমবে। তেমনি সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কেনা সহায়ক হবে যা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরাসরি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

আমদানিকৃত পণ্যের ওপর স্থায়ী শুল্কহার নির্ধারণ সরাসরি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কারণ আমদানিকৃত দ্রব্যের যে কোনো মূল্যবৃদ্ধিতে নির্দিষ্ট শুল্কহার থাকায় শুল্কের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে দ্রব্যমূল্য আরও বাড়িয়ে দেয়। শুল্ক বিভাগ সব পণ্যের ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণ করে তার ওপর শুল্কহার প্রয়োগ করে শুল্ক নির্ধারণ করে। বিভিন্ন কারণে শুল্ক বিভাগ সময়ে সময়ে ট্যারিফ হার বাড়াতে থাকে ফলে পণ্যের শুল্ক বেড়ে গিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে। কিন্তু শুল্ক বিভাগ যদি পণ্যের ট্যারিফ মূল্যের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শুল্কহার হারাহারিভাবে কমিয়ে দেয় তাহলে শুল্কের পরিমাণ বাড়ার সুযোগ থাকে না এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ সৃষ্টি হয় না।

মানুষের সঙ্গে প্রথমেই ন্যায়সংগত ও দুর্নীতিমুক্ত আচরণ করতে হবে। যদি কেউ অপরাধ করে তার সঙ্গেও ন্যায়সংগত ও দুর্নীতিমুক্ত আচরণ করে তাকে শাস্তির আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কোনো কারণ বা বাহানায় একজনের অপরাধের কারণে অন্য সবার সঙ্গে আইনবহির্ভূত আচরণ করা কাম্য হতে পারে না। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত আচরণ ও ব্যবহার সরাসরি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সব ধরনের আইনবহির্ভূত কার্যক্রম কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তাহলে অবশ্যই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

আমাদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে জনসংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে একশ্রেণির মানুষের বাড়তি আয়। দেশে দুর্নীতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একশ্রেণির মানুষের বাড়তি আয়ও হুহু করে বাড়ছে। সরকারের মাটি কামড়ে ক্ষমতা ধরে রাখার তীব্র আকাক্সক্ষার কারণে সরকার দুর্নীতির টুঁটি চেপে ধরতে পারছে না। উল্টো সরকার দুর্নীতিবাজদের কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে দুর্বল বিরোধী শক্তির কারণে সাধারণ মানুষ স্পষ্টভাবে পক্ষ নিতে পারছে না। আবার সরকারবিরোধী নেতৃত্বের অভাব ও দুর্বলতার কারণে জনগণও রাস্তায় নামতে ভরসা পাচ্ছে না। এসব নানাবিধ কারণে সরকার যদি জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত না করে লুটেরা ও শোষণমূলক অর্থনীতি অব্যাহত রাখে তাহলে দ্রব্যমূল্য কোনো দিনই নিয়ন্ত্রণে আসবে না। তখন শাসক পরিবর্তনের কামনা করা ছাড়া জনগণের কাছে বিকল্প থাকবে না। তাই সরকারের কাছে আমার বিনীত আহ্বান থাকবে- দেশ ও জনগণের স্বার্থে তারা যেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে চিন্তা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। সবাই ভালো থাকুন। দেশ ভালো থাকুক।        

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর