সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

বিএনপির নতুন মুক্তিযুদ্ধ এবং মরা হাতির গল্প

মহিউদ্দিন খান মোহন

বিএনপির নতুন মুক্তিযুদ্ধ এবং মরা হাতির গল্প

নতুন এক মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। চট্টগ্রাম মহানগরীর পলোগ্রাউন্ডে দলীয় সমাবেশে এ ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেছেন, জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম থেকে ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। সেই চট্টগ্রাম থেকেই তারা দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে নতুন মুক্তিযুদ্ধ শুরু করলেন। বিএনপি মহাসচিবের কথাগুলো যথেষ্ট উদ্দীপনাময় সন্দেহ নেই। বিশেষ করে আন্দোলন-সংগ্রামে দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দীপ্ত করতে বা মাঠ গরম করতে এ ধরনের ‘আগুনজ্বালা’ বক্তৃতার গুরুত্ব রয়েছে। তবে আন্দোলন-সংগ্রাম আর যুদ্ধের মধ্যে যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে, সেটা বিবেচনায় আনলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথাগুলো নিয়ে দুবার ভাববার অবকাশ আছে বৈ কী! কেননা, একটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য যে রণসজ্জার দরকার হয়, তার জন্য পোড়াতে হয় অনেক কাঠখড়। সৈন্যসামন্ত জোগাড় করে তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হয়, প্রয়োজনীয় অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ করতে হয়। সর্বোপরি যুদ্ধ যেতে প্রস্তুত সৈনিকদের প্রয়োজনে ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা’ মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে হয়। নতুন মুক্তিযুদ্ধ বলতে বিএনপি মহাসচিব যে অস্ত্র-গোলাবারুদ্ধের যুদ্ধ নয়, বরং একটি রাজনৈতিক যুদ্ধের কথাই বোঝাতে চেয়েছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য কতটুকু প্রস্তুতি এবং সামর্থ্য দলটির রয়েছে তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার অবকাশ আছে।

এটা বুঝতে কারও বাকি থাকার কথা নয়, ‘নতুন মুক্তিযুদ্ধ’ বলতে মির্জা সাহেব ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ‘দুর্বার আন্দোলন’কেই বুঝিয়েছেন। এ ধরনের আন্দোলন শুরুর কথা তারা আরও বহুবার বলেছেন। তবে সে আন্দোলন শুরু করার জন্য উপযুক্ত ঈদের দেখা তারা সম্ভবত এখনো পর্যন্ত পাননি। রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা অনেকবার বলেছেন, দিন-তারিখ নির্ধারণ করে কখনো আন্দোলন গড়ে তোলা যায় না। কিন্তু বিএনপি শুধু দিন-তারিখই দিয়ে গেছে, আন্দোলন করতে পারেনি। কারও কারও মতে, আমাদের দেশে নতুন জেগে ওঠা চর দখলের জন্য জমিদার-জোতদাররা পূর্বাহ্নে দিন-তারিখ ঘোষণা দিয়ে মার-ফৌজদারিতে লিপ্ত হওয়ার নজির আছে। রাজনৈতিক আন্দোলনের বেলায় সে ধরনের উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আগেকার দিনে রাজা-বাদশাহ, জমিদার-জোতদাররা রাজ্য বা চরদখলের জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগে গণক ঠাকুরদের দিয়ে ঠিকুজি গুনিয়ে শুভদিন বেছে নিয়ে তারপর যুদ্ধযাত্রা করতেন। বিএনপিও বোধকরি এখন জ্যোতিষীর পরামর্শ নিয়ে যুদ্ধ তথা আন্দোলনে নামার দিনক্ষণ ঠিক করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

সরকার পতনের দুর্বার বা সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বিএনপি বলে আসছে গত এক দশক ধরেই। সেই সঙ্গে তাদের মুখে একটি কমন কথা (বিক্রমপুরের ভাষায় ‘লব্জ’) ছিল আলটিমেটাম। কতবার যে সরকারকে এরা আলটিমেটাম দিয়েছে, তার হিসাব রাখাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। ওই সময় আমি আমার এক সাবেক সহকর্মীকে বলেছিলাম, এরপর হয়তো ম্যাডাম এই বলে আলটিমেটাম দেবেন-‘আমাদের দাবি না মানলে আমরা ঘরে গিয়ে বসে থাকব। দেখি সরকার কীভাবে আমাদের বের করে।’ তারপর যখন ২০১৫ সালের পেট্রোল বোমার আন্দোলনের সময় খালেদা জিয়া গুলশানস্থ তাঁর কার্যালয়ে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে রইলেন, তখন আমার সে সাবেক সহকর্মী (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক) বলেছিলেন, ‘মোহন ভাই, আপনার কথাই তো সত্যি হয়ে গেল। ম্যাডামসহ বিএনপির সব নেতাই তো ঘরে উঠে গেলেন!’ যদিও ওটা সিরিয়াস কোনো রাজনৈতিক কথা ছিল না, হাসি-ঠাট্টার ছলে বলা হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে বিএনপির কর্মকান্ডের সঙ্গে ওই হাস্যরসের অদ্ভুত সাজুয্য খোদ আমাকেই বিস্মিত করেছে। এখন আর বিএনপি আলটিমেটামের কথা বলে না। তবে, তারা এমন ভাব প্রদর্শন করেন, যেন যে কোনো মুহূর্তে তারা সরকারের গদিকে কালবৈশাখী ঝড়ে কলাগাছের মতো উপড়ে ফেলতে পারেন। না, এটা বলছি না যে, প্রচন্ড শক্তিধর সরকারকে আন্দোলনের মাধ্যমে গদিচ্যুত করার নজির বিশ্ব-ইতিহাসে নেই। আমাদের দেশেই তো দুটি সরকারের গণআন্দোলনে পতনের সাক্ষী আমরা। পাকিস্তান আমলে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বলা হতো লৌহমানব। সেই আইয়ুব খানের শক্তপোক্ত গদিও তৃণ-কূটোর মতো উড়ে গিয়েছিল ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের প্রবল ঝড়ে। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরশাসক এরশাদকে নিয়ে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন, তাকে গদিচ্যুত করা সম্ভব হবে কি না। তিনিও টিকতে পারেননি জনতার আন্দোলনের মুখে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এসব আন্দোলন দিনক্ষণ তারিখ দিয়ে হয়নি। রাজনৈতিক দাবিকে জনগণের দাবিতে রূপান্তরের ফলেই আন্দোলনের সফলতা এসেছিল। আজকের অবস্থাটা কী? বিএনপি এবং তাদের সঙ্গে থাকা কিছু সিকি-আধুলি রাজনৈতিক দল সরকার পতনের কথা বলে বলে নিজেদের কলেবরকে ঘর্মাক্ত করে চলেছে। কিন্তু তাদের সে আন্দোলনের দেখা এখন পর্যন্ত মেলেনি। আর এ নিয়ে সরকারি দলের বড়-মাঝারি নেতারা ‘বিএনপির আন্দোলনের মরা গাঙে জোয়ার আসবে না’, ‘বিএনপির আন্দোলন সূর্যের মুখ দেখবে না’ ইত্যাদি ঠাট্টা-মশকরা করে চলেছেন। তাদের এসব ঠাট্টাকে নিষ্ঠুর মনে হতে পারে। তবে একেবারে অযৌক্তিক বলা যাবে না। কেননা, সরকার পতনের লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা তো দূরের কথা, বিএনপি নিজেদের দলের ঐক্যই এখন ধরে রাখতে পারছে না। সংগঠনকে মজবুত করার জন্য যে পুনর্গঠন কর্মসূচি দলটি পুনঃ পুনঃ ঘোষণা করেছে, তা এখন তাদের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। সারা দেশে জেলা-উপজেলা কমিটি ভেঙে দিয়ে গঠন করা হয়েছে আহ্বায়ক কমিটি, যেসব কমিটির মেয়াদ তিন মাস। এই তিন মাসের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল দলটির হাইকমান্ড। কিন্তু পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে, দলটির এ কর্মসূচির সফলতার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। সবখানেই চলছে কোন্দল-রেষারেষি। পাশাপাশি নানা কারণে শীর্ষনেতার বিরাগভাজন হয়ে দল থেকে ছিটকে পড়ছেন অভিজ্ঞ, প্রবীণ এবং দলের জন্য জীবনের মূল্যবান সময় ও সম্পদ ব্যয় করা নেতারা। সম্প্রতি সিলেট জেলা বিএনপির কাউন্সিল হয়ে গেল। পত্রিকার খবর অনুযায়ী উপজেলা কমিটির সদস্যদের ভোটে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচন হয়েছে। সে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশন মেয়র এবং প্রবীণ বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। দলের ভিতরে বিপুল জনপ্রিয় আরিফুল হক চৌধুরী চেয়েছিলেন সিলেট মহানগরের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে জেলার নেতৃত্বে অংশ নিতে। কিন্তু শীর্ষনেতা চাননি আরিফুল হক বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হোন। তাই তার নির্দেশে কাউন্সিলের দুই দিন আগে আরিফুল হক প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। গণতন্ত্রের জন্য তারস্বরে চিৎকার করা বিএনপির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের কী দারুণ অবস্থা! আরিফুল হককে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করে বিএনপি নেতৃত্ব প্রমাণ করে দিলেন, তারা গণতন্ত্র বলতে শুধু তাদের সভা-সমাবেশের অধিকার এবং জাতীয় নির্বাচন অবাধ হওয়াকেই মনে করেন। ‘চ্যারিটি বিগেন্স অ্যাট হোম’ অর্থাৎ ভালো দৃষ্টান্ত ঘর থেকেই শুরু করতে হয়-এ কথাটি হয় তারা ভুলে গেছেন, না হয় বিশ্বাস করেন না। কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত চাঁদপুর জেলা বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশনে স্থাপিত হয়েছে এক ‘অনন্য নজির’। সভাপতি পদে ভোট পড়েছে মোট ভোটারের চেয়ে প্রায় দেড় শ বেশি। কোত্থেকে এলো এই অতিরিক্ত ভোট? এ নিয়ে ওই জেলার বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে তুলেছেন নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড়। বলা হচ্ছে, দলের শীর্ষনেতার পছন্দের লোকটিকে সভাপতি পদে জিতিয়ে আনতে এই কারচুপি করা হয়েছে। এ বিষয়ে একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির মন্তব্য, এরপর বিএনপি আর ভোট কারচুপির জন্য আওয়ামী লীগের সমালোচনা করবে কোন মুখে? আমার পার্শ্ববর্তী উপজেলা সিরাজদিখানে (মুন্সীগঞ্জ) ঘটেছে আরও ন্যক্কারজনক ঘটনা। গত ৭ ফেব্রুয়ারি পুরনো কমিটি ভেঙে যে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল, নির্দিষ্ট কোনো কারণ এবং কারণ দর্শানোর নোটিস ছাড়াই তা ভেঙে দিয়ে নতুন আরেকটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে গত ৩০ মার্চ। কেন কী কারণে মাত্র এক মাস একুশ দিনের মাথায় একটি কমিটি ভেঙে আরেকটি কমিটি করা হলো, তার অন্তর্নিহিত কারণ কেউ জানে না। অভিযোগ রয়েছে, নতুন আহ্বায়ক যিনি হয়েছেন, তিনি একজন বিত্তশালী লোক এবং ‘যথা দরগায় যথা শিরণি’ দিয়েই তিনি পদটি বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। এখন ওই উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা নানা ভাগে বিভক্ত। অনেকে নিষ্ক্রিয় হওয়ার কথা ভাবছেন। ফলে ঐক্য সেখানে দূর-অস্ত হয়ে পড়েছে।

ঘটনাগুলো উল্লেখ করলাম এ জন্য যে, বিএনপি তাদের আন্দোলনকে সফল করার জন্য বারবার বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার কথা বলছে। কিন্তু অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তের দ্বারা তারা আপন ঘরেই জন্ম দিচ্ছে অনৈক্য-কোন্দল। আর এর মূলে রয়েছে পদ-বাণিজ্য, কমিটি-বাণিজ্য। শীর্ষ থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত এই বাণিজ্য বেশ প্রসার লাভ করেছে, অনেকটা মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির মতো। সচেতন মহলের মতে, এমন ঘোরতর দুর্দিনেও যে দলে পদ আর কমিটি নিয়ে রমরমা বাণিজ্য চলে এবং সে বাণিজ্যে ছোট-বড় অনেকেই শামিল থাকে, সে দলের নেতার মুখে তথাকথিত নতুন মুক্তিযুদ্ধের হুঙ্কার ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে বিল গেটস’ বনে যাওয়ার স্বপ্নেরই নামান্তর।

বিএনপির বিদ্যমান হালহকিকত সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলাম দলটির শুভানুধ্যায়ী এক প্রবীণ ব্যক্তির কাছে। এক সময় বাম ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা ভদ্রলোক সরাসরি জবাব না দিয়ে একটি গল্প শোনালেন। বললেন, ‘একটি ভারতীয় হিন্দি সিনেমা দেখেছিলাম পরিবেশ বিষয়ভিত্তিক। একটি বনে হাতি ছিল। বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব ছিল কাঠ পাচারকারীদের হাত থেকে বনকে রক্ষার পাশাপাশি হাতিগুলোকেও শিকারিদের হাত থেকে রক্ষা করা। দীর্ঘদিন একই স্থানে বসবাসের সুবাদে হাতিগুলোর সঙ্গে বন-কর্মচারীদের এক ধরনের সখ্য গড়ে ওঠে। অন্যদিকে দুর্বৃত্তদের চেষ্টা থাকে হাতি মেরে এর দাঁত, হাড়গোর নিয়ে যাওয়ার। একদিন একটি হাতিকে শিকারিরা মেরে ফলল। বন-কর্মচারীরা অনেক চেষ্টা করেও সেটাকে বাঁচাতে পারল না। বন-কর্মচারীদের মন খারাপ। কারও চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। তারা সবাই মরা হাতিটির পাশে দাঁড়িয়ে দুঃখ প্রকাশ করছে। এ সময় ভিড়ের মধ্যে থাকা পাচারকারীদের একজন বলল, ‘হাতিটি যখন মরেই গেল, কী আর করা! এখন এর দাঁত-হাড়গোর নিয়ে কাজে লাগানোই উত্তম।’ গল্পটি শেষ করে ভদ্রলোক বললেন, যারা এখন বিএনপি চালায় তাদের একটি বড় অংশের কাছে দলটি ‘মরা হাতি’। তারা মনে করছে যেহেতু এর আর বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা নেই, তাই যে যেভাবে পারছে এর দাঁত-হাড়গোর খুলে নিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করছে।

                লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর