সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

সড়ক দুর্ঘটনা এবং জীবনের গল্প

হোসেন আবদুল মান্নান

ইঞ্জিনচালিত যানবাহন আবিষ্কারের পর দুর্ঘটনায় পৃথিবীতে কত মানুষের অকালমৃত্যু হয়েছে এর সঠিক হিসাব পাওয়া কখনো সম্ভব নয়। তবু অনুমান করা যায় লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। মন্ত্রী, এমপি, রাজনীতিবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, লেখক, ছাত্র-ছাত্রী, সাংবাদিক চালকসহ সব পেশাজীবীই এ মিছিলে আছেন। এখন সারা পৃথিবীই উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং এ নিয়ে ভাবনার সীমা নেই। সড়ক- মহাসড়কগুলোয় ডিভাইডার, সম্প্রসারণ, গতিরোধক, ফ্লাইওভার, ক্যামেরা সংযোজনসহ কত শত প্রযুক্তির নির্দেশিকা ব্যবহার হচ্ছে এরও কোনো ইয়ত্তা নেই। তবে দুর্ঘটনা থেমে নেই। সে চলছে এবং দুনিয়ার বহির্মুখী মানুষের একান্ত সহচর হয়ে থাকবে অনাগত কালের যাত্রাপথেও। বলা যায়, মানুষের সৃষ্ট যন্ত্রের চালকের দায়িত্বে যত দিন মানুষ থাকবে তত দিন দুর্ঘটনাও সঙ্গী হবে। ২. সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বব্যাপীই সংঘটিত হচ্ছে। যেসব উন্নত দেশে মাথাপিছু হিসেবে যাত্রী এবং যানবাহনে যৌক্তিক ভারসাম্য রয়েছে, সেখানেও দুর্ঘটনা আছে। তবে তা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তিকৃত। যা আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি। মনে হয় ভবিষ্যৎ পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের আপাতত কিছু করার নেই। একটি বিশ্বসংস্থার পরিসংখ্যানের বরাতে দেখা যায়, অধিক হারে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে বিশ্বের এমন ১৮৩ রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম এবং এশিয়ায় সপ্তম। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের মোট যানবাহনের মাত্র ০.৫ শতাংশ বাংলাদেশে থাকা সত্ত্বেও ২০১৯ সালে দেশে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ সড়ক দর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। তবে সড়কে মৃত্যুর হিসাবে গরমিল আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বছরে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মতে ৮ হাজার ৫০০ এবং সরকারি তথ্যমতে ২ হাজার ৫০০। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে সে বছর বাংলাদেশের জিডিপির ৫.৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিআরটিএ বলছে, দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ২৮ লাখের কাছাকাছি। এর ৪ লাখের ফিটনেস সনদ নেই। দেশে ৬০ লাখ চালকের মধ্যে ১৬ লাখ লাইসেন্সধারী। বাকিরা অবৈধভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন। প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মৃত্যুবরণকারীর ৫৪ শতাংশ নাকি পথচারী। অন্যরা মুখোমুখি সংঘর্ষ, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, বেপরোয়া গাড়ি চালাতে গিয়ে বা পেছন থেকে ধাক্কা লেগে প্রাণ হারায়। তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকদের দেওয়া তথ্যমতে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। দুর্ঘটনার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চালকরাই দায়ী।

৩. আমার নিজের চোখে দেখা একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার কথা বলি। ২০১১ সালের রমজানের ঘটনা। ইফতার শেষে আমি জেলা প্রশাসকের বাংলো, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করি। পরদিন সকালে বাংলাদেশ সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে একটি সভা ছিল। ঢাকার কাছাকাছি এসে ডেমরার সুলতানা কামাল ব্রিজ অতিক্রম করে কিছুক্ষণ আসতেই হঠাৎ আর্তচিৎকার শুনি। আমার গাড়ির সামান্য আগে চলে যাওয়া একটি বেপরোয়া পিকআপের চাকায় পিষ্ট হয়ে গেলেন একজন মধ্যবয়সী মানুষ। তাঁর পরনে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি ও মাথায় টুপি। শরীরটা তাৎক্ষণিক থেঁতলে গেলেও প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দেহে টুপিটা লেপ্টে ছিল। রক্তে তলিয়ে যাচ্ছিল সড়কে পড়ে থাকা তার শরীরের মাংসপি-। সবাই বলাবলি করছিল, লোকটা তারাবি নামাজ আদায় করে বাসায় ফিরছিলেন। রাস্তা পার হতে চেয়েছিলেন। এক মুহূর্তে জীবন থেকে মৃত্যু। দ্রুতগতিতে চলে গেল পিকআপ। কোন পিকআপ, কার পিকআপ, কোনো সাক্ষী আছে কি? তাঁর পাশে তো একজন মানুষও নেই। সবাই পথচারী। সেদিন রাতের আঁধারে নিকটাত্মীয়-স্বজনবিহীন একজন অসহায় শ্রমজীবী মানুষের আকস্মিক জীবনাবসানের করুণ দৃশ্য দেখলাম। গাড়িতে বসে ভাবছিলাম, লোকটার স্ত্রী-সন্তানরা কি রাতের খাবার নিয়ে তাঁর অপেক্ষায় ছিলেন? তাঁর এমন মৃত্যুর জন্য কেউ বিচার প্রার্থী হবে? এরপর অনেকদিন গত হলেও এ দুর্ঘটনার দৃশ্যকে আমার মনের দৃষ্টির সীমানার বাইরে নিতে পারিনি। কারণে অকারণে সে চোখের সামনে চলে আসত। ৪. এবার নিজের গল্প বলি। দীর্ঘ ৩২ বছরের সরকারি চাকরি। মাঠে ঘাটে অনেক রকম দায়িত্ব পালন করেছি। বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরপুর আমার কর্মজীবন। বলা যায়, শুরু থেকে গাড়ির চাকাতেই জীবন বাঁধা পড়ে যায়। সুদীর্ঘ সময়ে দেশের পাহাড়-পর্বতে, সমতলে, দুর্গম-দুস্তর জনপদেও দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। শতবার ঝুঁকিপূর্ণ বনজঙ্গলও মাড়িয়ে যেতে হয়েছে। কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি। মরতে মরতে বেঁচে গেছি। জীবনের এসব চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে আজকের অবসরে এসে সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে আমার সরাসরি সাক্ষাৎ। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরার পথে নিজ এলাকাতেই এ দুর্ঘটনা। কিশোরগঞ্জ-ভৈরব সড়কে আচমকা প্রায় মুখোমুখি সংঘর্ষের মতন ঘটে গেল। বিপরীত দিক থেকে ৫০ কিমি বেগে আসা একটি সবজির পিকআপ আমার গাড়িকে আঘাত করে। আমার চালকের নৈপুণ্যের কারণেই বোধকরি মুখোমুখি না লেগে গাড়ির ডানপাশের দরজায় হিট করে। গাড়িটি রাস্তার পাশে পড়ে উল্টে যেতে যেতে বেঁচে যাই। চালকসহ আমরা চারজনই অলৌকিকভাবে অক্ষত থাকি। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে পিকআপের দিকে তাকিয়ে দেখি এটা ভারতীয় টাটা কোম্পানির গাড়ি। বাংলাদেশে যার প্রধান আমদানিকারক বিশিষ্ট শিল্পপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ। তাঁর নিজের জনপ্রিয় উক্তি, ‘একটি দুর্ঘটনা, সারা জীবনের কান্না’।

৫. এদিকে আমার গাড়ি ঢাকায় এনে গ্যারেজে পাঠালে তাঁরা যে সম্ভাব্য মেরামত ব্যয় নির্ধারণ করে দেন শুনেছি জব্দকৃত পিকআপের মূল্য নাকি এর চেয়ে অনেক কম হবে। চালক, মালিক কার বিচার হবে? কী বিচার হবে? কে এর পেছনে থাকবে? এসবের শেষ কোথায়? মনে পড়ে, দুর্ঘটনার পর আমি গাড়ির দিকে একবারই তাকিয়েছিলাম। কী মূল্য আছে আমার গাড়ির? তবে বারবার তাকাচ্ছিলাম জীবনের দিকে। আমি বেঁচে আছি তো? আহা! মানুষের জীবনের গল্প বুঝি এমনই হয়!

                লেখক : গবেষক ও গল্পকার।

সর্বশেষ খবর