বুধবার, ২০ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকুক বাংলাদেশ

নূরে আলম সিদ্দিকী

মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকুক বাংলাদেশ

দেশ আজ একেবারেই নিদ্রিত। রাজনৈতিকভাবে নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ; অনেকটাই শ্মশানের মতো। এখন আর রাজপথে মিছিল থেকে বজ্রনির্ঘোষে আওয়াজ ওঠে না। মুষ্টিবদ্ধ উত্তোলিত হাতগুলো উৎসারিত কণ্ঠের প্রতিনিধিত্বও করে না। সবই যেন কেমন নিষ্প্রাণ, নিরুত্তেজিত, নির্জীব ও প্রাণহীন। এ প্রাণহীন নির্জীব পরিবেশ যাঁরা ক্ষমতায় আছেন তাঁদের জন্য খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। তাঁরা ভাবছেন, অনাদি-অনন্তকাল এ রাজনৈতিক নিথর পরিবেশ বজায় থাকবে আর তাঁরা বগল বাজিয়ে মহা আনন্দে শাসনকার্য চালিয়ে যাবেন। এর জন্য এককভাবে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে দায়ী করা যাবে না। এর অনেকটা দায়ই বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপির ওপর বর্তায়। সংবাদমাধ্যমে জেনেছি, খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে প্রচন্ড অসুস্থ। অন্যদিকে বিএনপি সংগঠনের রাজনৈতিক ক্ষমতা পদাধিকারবলে যাঁর ওপর অর্পণ করেছে সেই প্রবাসী নেতা তারেক রহমানের কোনো জনভিত্তি নেই। গণমানুষের সমর্থনের যে শিকড় তা একেবারেই তিনি ধারণ করতে পারেননি। তাঁর কিছু মোসাহেব রয়েছে, সেটিই তারেক রহমানের রাজনৈতিক পরিচর্চার আঙ্গিক- দেশ উদ্ধারের নিমিত্ত। বাস্তবে এটি যতই হাস্যকর মনে হোক না কেন, এ স্রোতধারায়ই বিএনপি চলছে।

বিএনপির দেশজ দু-এক জন নেতা আপাতদৃষ্টিতে সরকার-বিরোধী জনমত গঠন ও আন্দোলনের পথ বিনির্মাণের প্রচেষ্টায় উজ্জীবিত আছেন কিন্তু জনগণের ওপর তাঁদের প্রভাব নিতান্তই অপ্রতুল ও ক্ষীণ। শত সহস্র প্রচেষ্টায়ও তাঁরা একটা ঐক্যবদ্ধ সফল গণআন্দোলন সৃষ্টি করতে পারবেন বলে প্রতীয়মান হয় না। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে, একটি সফল গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হলে একজন সমুজ্জ্বল প্রদীপ্ত ব্যক্তিত্বকে সামনে থাকতে হয়। সেই ব্যক্তিত্ব হবেন দিগন্তবিস্তৃত আকাশের বুকে প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মির মতো। যাঁর বিকীর্ণ অগ্নিকণায় স্নাত হয়ে শুচিশুদ্ধ মানসিকতায় আন্দোলনের সুদীর্ঘ পথ-পরিক্রমণে এগিয়ে যাওয়া যাবে। বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থতার কারণে অনেকটাই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আজ তাঁর বিকল্প কোনো নেতৃত্ব বিরোধী অঙ্গনে তৈরি হয়নি। বিরোধী দলের কর্মকান্ডশূন্য একটি ভাবলেশহীন পরিবেশে বাংলাদেশ আজ পরিচালিত হচ্ছে।

২৩ বছর সংগ্রাম করে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক সুষ্ঠু পরিবেশ ও রাজনীতির পরিচ্ছন্নতা এবং সহনশীলভাবে একটি উদগ্র ও বিশৃঙ্খল পরিবেশকে মোকাবিলা করে দেশ পরিচালনা করেছেন। সিরাজ সিকদার ও জাসদের যুগপৎ উ™£ান্ত উচ্ছৃঙ্খল সশস্ত্র রাজনীতি বঙ্গবন্ধুকে অনেকটাই বিপদগ্রস্ত করেছে। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে থানা লুট ও খাদ্যভান্ডারে অগ্নিসংযোগ, ঈদের জামাতে সংসদ সদস্য খুনের নির্মমতা অবলোকন করে বঙ্গবন্ধু ভিতরে ভিতরে অনেকটাই মুষড়ে পড়েন। এর মধ্যে তাঁর গলব্লাডারের স্টোন অপারেশনের অনিবার্যতা দেখা দিলে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আমেরিকায় বঙ্গবন্ধুর অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমাকে আমেরিকায় পাঠান। আমেরিকায় গিয়ে সিনেটর কেনেডি, সিনেটর সেক্সবি, সিনেটর ম্যাকার্থির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা আমেরিকায় বঙ্গবন্ধুর অস্ত্রোপচারের কোনোরকম উদ্যোগ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তাঁদের সাফ জবাব ছিল, তোমরা চিলির আলেন্দেকে নিয়ে যেভাবে মাতামাতি করছ, ঈশ্বর না করুন তোমাদের নেতা আমেরিকায় এলে যদি অপারেশনকালে মৃত্যুবরণ করেন তাহলে তোমরা চিকিৎসাশাস্ত্রের কোনো যুক্তি মানবে না। চিরকালের জন্য আমেরিকার সঙ্গে তোমাদের সম্পর্কের বৈরিতা তৈরি হবে, এমনকি সম্পর্ক ছিন্নও হয়ে যেতে পারে। অবশ্য আল্লাহর অশেষ রহমতে রাশিয়ায় বঙ্গবন্ধুর গলব্লাডারের সফল অস্ত্রোপচার হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক ও সুদৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু অকালে নিষ্ঠুরভাবে নিহত না হলে সফল পররাষ্ট্রনীতির বৈভব ও প্রাচুর্যে বাংলাদেশ প্রস্ফুটিত হতো।

বিনা বিচারে মানুষ হত্যার প্রশ্ন টেনে র‌্যাবপ্রধানসহ ছয়জন কর্মকর্তার আমেরিকা প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আমেরিকা যেভাবেই বিষয়টিকে পর্যালোচনা করুক না কেন বাংলাদেশের সামগ্রিক জনগোষ্ঠী অভিজ্ঞাত, কীভাবে বাংলাদেশে সন্ত্রাস মাথা চাড়া দিচ্ছিল। ওই সময় দুষ্কৃতকারী দমনে র‌্যাবের দুর্দমনীয় অভিযান যদি পরিচালিত না হতো তাহলে এ দেশে নিরীহ আইন মান্যকারী মানুষের বসবাস করা বা টিকে থাকা সম্ভব হতো না। প্রশাসন, আইনের শাসন অবলুপ্ত হয়ে কালা জাহাঙ্গীর, সুইডেন আসলাম, প্রকাশ-বিকাশ, এরশাদ শিকদারদের মতো সন্ত্রাসীদের দ্বারা সন্ত্রস্ত পরিবেশেই আমাদের বাস করতে হতো। জীবনের আশা, ব্যাপ্তি সবটুকুই কচুপাতার ওপরে টলটলায়মান এক ফোঁটা পানির মতো অস্থির ও অনিশ্চিত থাকত। র‌্যাব যে দু-একটি ভুল করেনি তা নয়। ক্ষেত্রবিশেষ ইচ্ছাকৃত কিছু ব্যতিক্রমও হয়তো করেছে। এ বাড়াবাড়িটা কখনই কাম্য নয়, সর্বাবস্থায়ই নিন্দনীয়। তবু আজকের এ শৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের অবদানের কথা নিষ্ঠুর নিন্দুক ও দয়াহীন সমালোচকও অস্বীকার করতে পারবেন না।

কিন্তু যে দেশে এখনো বর্ণবৈষম্যের দাপটে সমাজ বিপর্যস্ত, যে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গের অধিকার অনেকটাই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো, যে আমেরিকায় বারাক ওবামার শাসনামলকে ক্রীতদাস কর্তৃক শাসিত আমেরিকা বলে অভিহিত করার ব্যক্তিবর্গের সমাহারও প্রচুর, যে দেশে এখনো কারণে-অকারণে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়, ইয়াবাসহ মাদক সেবনের অপরাধে বিনা বিচারেই মৃত ব্যক্তিদের পা ঝুলিয়ে অবিশ্রান্ত প্রহার চলে, অথবা যার ফলে অনেকের প্রাণের প্রদীপ অকালেই নিভে যায়, যেখানে হোমলেসদের প্রাণের মূল্য কানাকড়িও নেই- সেখানে তারা অন্য দেশের ওপরে মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন অর্থ, অস্ত্র ও প্রাচুর্যের ক্ষমতাবলে। আমেরিকা সারা পৃথিবীর অর্ধেক প্রাচুর্যের অধিকারী বলে অনুমান করা হয়। দুটি মহাসাগরের মোহনায় অবস্থিত আমেরিকা বিশ্বের মধ্যে বিস্ময়কর প্রাচুর্যের এক দেশ। যদিও ভূখন্ডের সীমানার দিক থেকে আজকের খন্ডিত রাশিয়াও বিশাল বিস্তীর্ণ। তবু প্রযুক্তি ও প্রাচুর্যের প্রশ্নে আমেরিকা থেকে তারা অনেকটাই পিছিয়ে এবং বেশ নি®প্রভ।

আমেরিকা একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পাদপীঠে সগৌরবে অবস্থান করছে। আমেরিকার প্রজাতন্ত্র প্রতিস্থাপনের মহালগ্নে এর প্রতিস্থাপক জর্জ ওয়াশিংটন, জন অ্যাডামস, থমাস জেফারসন, জেমস্ ম্যাডিসন, আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন, জেমস্ মনরু ও বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন। এর মধ্যে ওয়াশিংটন, অ্যাডামস, জেফারসন ও ম্যাডিসন- এ চারজন দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ মহামতিরা এমন সুদৃঢ় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন যা শতাব্দীর পর শতাব্দী একটি নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক অবস্থানকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তাদের দেশের রাষ্ট্রপতি, সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের ক্ষমতা এমন নিখুঁতভাবে ভারসাম্যের মধ্যে রাখা হয়েছে যে রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাচারী হওয়ার কোনো রাজনৈতিক পরিবেশই সেখানে তৈরি হয় না। আর তারা বিশ্বে মোড়লীপনা করে অস্ত্র, অর্থ ও প্রযুক্তির জোরে। আমাদের বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রও পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকারের সৌন্দর্যমন্ডিত। আমাদের দেশের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী সরকার সংসদীয়। রাষ্ট্রপতি ধরনের সরকারের চেয়ে সংসদীয় ধরনের সরকারে একনায়কতান্ত্রিকতার প্রভাব পড়া দুরূহ। এখানে যৌথ নেতৃত্বের অবকাশ বিস্তীর্ণ। তবু দুর্ভাগ্য আমাদের, সংসদীয় ধরনের সরকার হওয়া সত্ত্বেও কখনো কখনো গণতন্ত্র হোঁচট খায়, সরকারও কখনো কখনো সংসদীয় গণতন্ত্রের আবর্তেও একনায়কতান্ত্রিকতার কশাঘাতে জর্জরিত হয়। এটি আমাদের গণতন্ত্রচর্চার ব্যর্থতারই নামান্তর।

সে যাই হোক, আসল কথায় ফিরে আসি। আমাদের দেশের র‌্যাব ভুল করেছে। তাদের অসাবধানতা অথবা উগ্রতার কারণে হয়তো কিছু নিরীহ প্রাণ অকালে ঝরে গেছে। তবু সামাজিক শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। আর সে কারণেই র‌্যাব কর্মকর্তাদের ওপর আমেরিকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জাতি হিসেবে আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। র‌্যাব ও পুলিশের নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত এ কর্মকর্তারা হয়তো এমনিতে আমেরিকা গমনে উৎসাহিতই ছিলেন না। গেলেও পরিভ্রমণে যেতেন। আর পরিভ্রমণে গেলে আমেরিকা ছাড়াও সৌন্দর্যের আবিরমাখা প্রাকৃতিক দৃশ্যের লীলাক্ষেত্র বহু দেশেই রয়েছে। র‌্যাবের কর্মকর্তারা পরিভ্রমণে যাওয়ার পরিকল্পনা করলে ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো দেশেই যেতে পারেন। এখানে ছোট্ট করে একটা কথা বলে রাখি, আমেরিকার প্রায় ২১টি অঙ্গরাজ্য আমি ঘুরেছি। নিউইয়র্ক একটি বিশাল শহর। নিউইয়র্ক জাতিসংঘকে নিজ আঙ্গিকে ধারণ করে। ফ্লোরিডার ম্যাজিক মাউন্টেইন তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদের চোখে নেশা ধরায়। লস অ্যাঞ্জেলেস, সানফ্রান্সিসকোর সমুদ্রের কলতান হৃদয়ে ধড়কানির সৃষ্টি করে। তবু আমার কাছে সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে কাশ্মীরকেই অতুলনীয় মনে হয়েছে। কবির কবিতা তো বটেই, মাতৃক্রোড়ের মতো স্নিগ্ধ মনে হয়েছে কাশ্মীরের অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে।

তবু আমেরিকা বিরাট, বিশাল ও বিস্ময়কর এক দেশ। প্রকৃতি, খনিজ, প্রযুক্তি, সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও পারমাণবিক পরাশক্তির আমেরিকার সঙ্গে আমাদের নিবিড় ও সৌহার্দ্যরে সম্পর্কই সবার কাম্য। এ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র শীতলতা ও টানাপড়েন কারও কাম্য নয়। আমি অনেকবার আমেরিকা পরিভ্রমণ করে সেখানকার মানুষের সঙ্গে খোলামেলা মেলামেশায় অনুধাবন করেছি, তারা মিশুক, বন্ধুত্বপরায়ণ ও উদারচিত্তের একটি জাতি। বন্ধুত্বের জন্য অনেক ক্ষেত্রে তাদের বিপাকেও পড়তে হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ছিল বটে কিন্তু যুদ্ধকে তাদের নিজেদের ত্রিসীমানায় পৌঁছতে দেয়নি। আমরা আমেরিকার আনুগত্য করব না, তবে বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতা চাইব। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যেভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে আমেরিকা সুহৃদ ও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবে- এটিই আমাদের প্রত্যাশা। ছয়জন র‌্যাব কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা সার্বভৌম ও উন্নয়নশীল বাংলাদেশের জন্য একটি নিদারুণ কটাক্ষ। এসব অনভিপ্রেত মোড়লীপনা না করে শুচিশুদ্ধ বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করবে- আমেরিকার কাছে এটি আমাদের প্রত্যাশা। জো বাইডেন পোড়খাওয়া রাজনীতিক। অবশ্যই তাঁর কাছ থেকে নির্মল শুচিশুদ্ধ সিদ্ধান্তই বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে।

এ শীতল সম্পর্ক স্বাভাবিককরণে কেউ কেউ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। কোনো সরব সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিয়েই আমেরিকার সঙ্গে নেগোসিয়েশন করার প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত রয়েছেন। এ লক্ষ্যে বারদুয়েক আমেরিকা পরিভ্রমণও করেছেন। এ প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারকে অনুধাবন করতে হবে আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজন কতখানি।

আমাদের জাতীয় দুর্ভাগ্য যে বিরোধী দলের সরকারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য সংগঠনের অবকাঠামোই অত্যন্ত নাজুক ও স্ববিরোধী। বেগম খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে অসুস্থ সত্ত্বেও তিনি সর্বান্তঃকরণে চাইলে বিরোধীদলীয় ফলপ্রসূ ঐক্য তৈরি হতো এবং সফল ও কার্যকর সরকারবিরোধী গণআন্দোলনও করা যেত। গণসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় খালেদা জিয়া কখনো ভিসুভিয়াসের মতো জ্বলে ওঠেননি। এখানে জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, বেগম খালেদা জিয়া কখনই রাজনৈতিক মননশীলতার অধিকারী ছিলেন না। বরং সমৃদ্ধি, সৌন্দর্যপ্রিয়তা ও বিলাসিতার অনন্ত সাগরে অবগাহন করেছেন। তাই তো তিনি কারাগারের নির্জনতা এড়ানোর জন্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমার অনুগ্রহের আশ্রয় নিতে গিয়ে তাঁর রাজনৈতিক স্বকীয়তা ও সত্তাকেই হারিয়ে ফেলেছেন। দেশে সরকার থাকবে, কার্যকর বিরোধী দল থাকবে না- এটা কেমন করে মানা যায়? শাসনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক অধিকারের তো কোনো অভাব নেই। অথচ সংবাদ সম্মেলন ও দু-একটি প্রাণহীন বিবৃতি ছাড়া আর কিছুই নেই। রাজপথ উদ্গত অঙ্কুরের উদ্ধত পদচারণে স্পর্ধিত স্লোগানে উত্তাল হয় না। এ নিষ্প্রাণ, নিষ্প্রভ ও ম্রিয়মাণ মৃতপ্রায় বিরোধী দলের নেতারা যত কটূক্তি ও উচ্চবাচ্য করুন না কেন, শেখ হাসিনা শুধু মুখ টিপে হাসেন। সরকারের গায়ে তার বিন্দুমাত্র আঁচড়ও লাগে না। সংসদের অবস্থাও তথৈবচ।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে যেখানে গণতন্ত্র সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত, সেখানে রাজপথে মিছিল দেখা না গেলেও ব্রিটেনের কমনসভা এবং আমেরিকার সিনেট ও কংগ্রেস ব্রিটেনের মন্ত্রিসভা এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মুখে লাগাম দিয়ে কষে চেপে ধরে রাখে। এতটুকু নড়চড় করলে ব্রিটেনের সরকার পতনের এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ইমপিচমেন্টের আশঙ্কা তৈরি হয়। আমাদের দেশের শাসনতন্ত্রেও অগাধ গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। কিন্তু তা প্রয়োগের কোনো সাহসী বিরোধী দল নেই। ফলে সংসদীয় গণতন্ত্রেও শেখ হাসিনার শাসনক্ষমতা কেবল অপ্রতিরোধ্যই নয়, তাঁর একক অভিপ্রায়ের আবর্তে আবদ্ধ ও অবরুদ্ধ হয়ে গেছে।

আমরা যখন ষাট দশকে আন্দোলন করতাম, তখন আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন ছিল। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এমন উত্তাল উচ্ছ্বাস তৈরি করতে পেরেছিলাম যে তার উত্তপ্ত প্রভাবে আইয়ুব খান ক্ষমতা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু তাঁর স্থলাভিষিক্ত ইয়াহিয়া খানও পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে ’৭০-এর নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। সে নির্বাচনে ছাত্র আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অবিস্মরণীয় ও কালজয়ী বিজয় অর্জন করে শুধু পাকিস্তানের কায়েমি সেনা গোষ্ঠীকেই নয়, বিশ্বকেই বিস্মিত করে দেয়। আর সে বিস্ময়কর বিজয় অস্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে গোটা বাঙালি জাতি বজ্রনির্ঘোষে গর্জে ওঠে। নয় মাস বুকনিঃসৃত রক্ত দিয়ে পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধ সৃষ্টি করে বাঙালি বিজয়ী হয়। পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার যে সূর্য তারা ছিনিয়ে আনে, সেই আন্দোলনের বিজয়রথে অধিষ্ঠিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর সেই রথটিকে অবিরাম ধারায় অবিশ্রান্ত টেনে নিয়েছিল ছাত্রলীগ।

আন্দোলনবিমুখ ভয়কাতুরে বিএনপি আতঙ্কিত ও উৎকণ্ঠিত হৃদয়ে ঘরে ঢুকে যে অর্গল দিয়েছে, তা বোধগম্যের অসাধ্য। বিগত ষাট দশকে আমরা যে সুদীর্ঘ পথে হেঁটেছি, তা কখনই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ হেঁটে অজস্র দুর্বিষহ নির্যাতন-নিগ্রহের পর্বতমালা ডিঙিয়েই ছাত্রসমাজকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ছাত্রলীগ কর্মীরা দুরন্ত দুঃসাহসী নাবিকের মতো সাফল্যের তরণীটিকে কাক্সিক্ষত সৈকতে নোঙর করিয়েছি। বঙ্গবন্ধুকেও একক নেতৃত্বের পাদপীঠে প্রতিস্থাপিত করেছি। বিস্ময়কর এ সাফল্য বিস্মিত নয়নে অবলোকন করে সমগ্র বিশ্ব বিস্ময়াভিভূত হয়েছে। বিশ্ববাসীর হৃদয়ে অনুরণন উঠেছে উচ্ছ্বসিত জলতরঙ্গের মতো। সেই তরঙ্গের ভাষা ছিল জয়তু বাংলাদেশ, জয় বাংলা।

 লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর