শুক্রবার, ২২ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

মুগ্ধতার শ্রীলঙ্কা থেকে হতাশার শ্রীলঙ্কা

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অব.)

মুগ্ধতার শ্রীলঙ্কা থেকে হতাশার শ্রীলঙ্কা

আগস্ট ২০১৭। ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের (এনডিসি) ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স-২০১৭-এর বহির্দেশীয় শিক্ষা সফর চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কুয়েতের পর আমাদের গন্তব্য শ্রীলঙ্কা। আশ্চর্যের  বিষয় হলো, চোখ ধাঁধানো উন্নত দুটি দেশ সফরের পর দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিও আমাদের রীতিমতো মুগ্ধ করেছিল। উপকূলে নারকেল গাছের সাজানো উদ্যান-রাজি, সবুজাভ ঘাসের গালিচাময় প্রান্তর, সুনীল আকাশের রোদে পাখিদের ওড়াউড়ি। মাটি, বাতাস, আকাশ, বৃক্ষ সব যেন পরিচিত। আসলে যে কোনো বাংলাদেশির কাছে প্রথমে শ্রীলঙ্কাকে মনে হবে কত দিনের যেন চেনা।

বন্দরনায়েক বিমানবন্দর থেকে আমরা কলম্বোয় যাচ্ছি। প্রায় সমুদ্রের কাছে আমাদের হোটেল গালাদারি। শ্রীলঙ্কায় পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় দেশটির উন্নততর জীবনধারার মান। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভদ্রতা, জীবনধারার মান, শহরের যানবাহনের শৃঙ্খলা, পরিষ্কার -পরিচ্ছন্নতা, সামাজিক সূচক ইত্যাদি বিচারে দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে সেই শ্রীলঙ্কা এখন দেউলিয়া। কেন এমন হলো? আমরা কি তখন দেশটির প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারিনি? ডিজিটাল অ্যালবামে শিক্ষা সফরের সেসব রোমান্টিক ছবি দেখে এসব ভাবছিলাম...। শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশ তুলনীয় নয়। তবে শিক্ষণীয়।

২০০৯-এ গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তত দিনে অনেকখানি গুছিয়ে নিয়েছে দেশটি। শ্রীলঙ্কা তখন লাখ লাখ বিদেশি পর্যটকের প্রিয় গন্তব্য। পাঁচ-ছয় দিনের শিক্ষা সফরে অন্তর্র্ভুক্ত হলো সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কা, সেনাবাহিনী সদর দফতর, নৌবাহিনী সদর দফতর, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, লক্ষ্মণ কাদিরগামার ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ ও গলের নৌঘাঁটি সফর।

সামরিক বাহিনীর সদর দফতরগুলো সফরের সময় তামিল বিদ্রোহ বা ইনসারজেন্সি দমন ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ও মতবিনিময় হয়। ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের নেতৃত্বাধীন তামিল টাইগার্স (লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম) ভিয়েতনামের পর সবচেয়ে শক্তিশালী ও দুর্ধর্ষ গেরিলা হিসেবে বিবেচিত ছিল। এমন দুর্ধর্ষ গেরিলা আন্দোলনকে পরাজিত করে শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী অসাধারণ সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেয়।

উল্লেখ্য, সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী) ২০০৫ সালে ক্ষমতায় আসার পরই তামিল ইনসারজেন্সি দমনে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এ সময় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘সচিব’ হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন তাঁর ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষে অর্থাৎ বর্তমান প্রেসিডেন্ট। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর একজন লে. কর্নেল ছিলেন (১৯৭১-১৯৯৮)। তাঁদের দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে (২০০৯) পরিচালিত চূড়ান্ত সামরিক অভিযানে বন্দি তামিল গেরিলাসহ কয়েক হাজার বেসামরিক তামিল নাগরিক হত্যার অভিযোগ উঠেছিল। পশ্চিমা বিশ্বের বিপরীতে চীন সরকার তামিল বিদ্রোহ দমনে রাজাপক্ষে সরকারকে ব্যাপক সাহায্য করেছিল। একই সঙ্গে সে সময় চীন শ্রীলঙ্কাকে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পে সাহায্য করে।

কলম্বোর অত্যন্ত ব্যস্ত কিন্তু গোছানো এলাকা বিজনেস ডিস্ট্র্রিক্টে অবস্থিত ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কা’য় দেশের অর্থনীতির ওপর আমাদের একটি প্রেজেন্টেশন দেওয়া হয়েছিল। সেখানে দেশটির অর্থনীতির একটি গোলাপি চিত্রই আমরা পেয়েছিলাম। প্রবৃদ্ধি কম হলেও অর্থনীতি যথেষ্ট প্রাণবন্ত ছিল। এ বছর শ্রীলঙ্কা সরকার তাদের ‘ভিশন-২০২৫’ ঘোষণা করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল ২০২৫ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কা একটি ধনী দেশে পরিণত হবে।

তবে শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের মতো ব্যাপক শিল্পায়ন চোখে পড়েনি। দেশটির কৃষি খাতও আমাদের মতো এত বৈচিত্র্যময় ও শক্তিশালী নয়। অর্থনীতি মূলত পর্যটন, চা রপ্তানি ও বিদেশি রেমিট্যান্স নির্ভর। শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় তখন ছিল প্রায় ৩ হাজার ৮০০ ডলার। ‘কলম্বো পোর্ট সিটি’ নামে উচ্চাকাক্সক্ষী ও বিশাল প্রকল্পের কিছু ছবি দেখানো হয়েছিল, যা আমাদের বিস্মিত করে। কলম্বোর সবুজ বাণিজ্যিক এলাকার উল্টো দিকে সাগরের বুকে বালু ফেলে যে বিশাল এলাকা জাগিয়ে তোলা হচ্ছে, সেখানে গড়ে তোলা হবে এক হাইটেক নগরী। গল ফেস গ্রিন এলাকার সমুদ্রপাড়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা চীনা কোম্পানির এ কর্মযজ্ঞ দেখছিলাম। ব্রিফিংকালে শ্রীলঙ্কার সপ্রতিভ কর্মকর্তা আরও বলেছিলেন, ‘সাগর ভরাট করে উদ্ধার করা এ জমি শ্রীলঙ্কার মানচিত্র বদলে দেবে। এমন এক বিশ্বমানের নগরী গড়ার সুযোগ দেবে যা কি না দুবাই, হংকং কিংবা সিঙ্গাপুরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে।’

শ্রীলঙ্কার ভৌগোলিক অবস্থান এবং সমুদ্রবন্দরগুলো প্রাচীন সিল্ক রুটের সময় থেকে আধুনিক মেরিটাইম সিল্ক রুট পর্যন্ত একটি দুর্দান্ত কৌশলগত গুরুত্ব দিয়েছে। লক্ষ্মণ কাদিরগামার ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে আমাদের সফরটি খুব ইন্টারেস্টিং ছিল। উল্লেখ্য, এ সময় আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। এনডিসির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সম্পর্কের ওপর সংক্ষিপ্ত প্রেজেন্টেশনও দেওয়া হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সম্পর্ককে অত্যন্ত বন্ধুত্বময় ও আন্তরিক বলে উল্লেখ করেছিলেন। এ সময় শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট ছিলেন মৈত্রীপালা সিরিসেনা, যিনি ২০১৫ সালে মাহিন্দা রাজাপক্ষকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর সরকার ভারত ও চীনের সঙ্গে বেশ ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রেখে চলছিল। থিঙ্কট্যাঙ্কটির ব্রিফিংয়ে শ্রীলঙ্কার কৌশলগত অবস্থান নিয়ে মতবিনিময় হয়েছিল। তখন চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। চীনের ‘ডেব্ট-ট্র্যাপ ডিপ্লোম্যাসি’ তত্ত্বটি তখনো সম্ভবত আলোর মুখ দেখেনি। চোখ ধাঁধানো এক্সপ্রেস হাইওয়ে দিয়ে কলম্বো থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রতীরবর্তী শহর গল-এ যাওয়া ছিল চমৎকার অভিজ্ঞতা। সেখানকার নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে গিয়ে হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর ও মাত্তালা রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্পর্কে জানা হলো। তখনো সমুদ্রবন্দরটি চীনকে ইজারা দেওয়া হয়নি। তবে সে বন্দর থেকে কাক্সিক্ষত রিটার্ন আসছিল না। এদিকে প্রার্থিত ফ্লাইট না পেয়ে অরণ্যের মাঝে তৈরি নতুন বিমানবন্দরের এয়ার কার্গো টার্মিনাল লিজ দিয়ে সেখানে ধান-চাল রাখা ও হাতিসহ বন্যপ্রাণী ও পাখিদের বিরুদ্ধে ‘সামরিক অভিযান’ পরিচালনার মজার তথ্যও জানা গেল। তখন শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ। প্রতিশ্রুতিশীল ও দক্ষ এই কূটনীতিকের আমন্ত্রণে একদিন তাঁর বাসভবনে (বাংলাদেশ ভবন) যাওয়া হলো। শ্রীলঙ্কায় ‘একখন্ড বাংলাদেশে’ এসে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সম্পর্ক ও দেশটি সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছিলাম।

বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার কূটনৈতিক সম্পর্ক ১৯৭২ সালে শুরু হলেও দুটি দেশ/অঞ্চল ঐতিহাসিক সম্পর্কে আবদ্ধ। শ্রীলঙ্কায় ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বিজয় সিংহ প্রাচীন বাংলা-ওড়িশা অঞ্চল থেকে সমুদ্রপথে সিংহলে পৌঁছান। এমনি করে হয়তো গোড়াপত্তন হয়েছিল নতুন জাতির। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসা ঢাকায় সার্ক সম্মেলনে (১৯৯২) আনুষ্ঠানিক ভাষণে প্রাচীন বাংলার সন্তান বিজয় সিংহের সিংহল যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন।

শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় সিংহলি ছাত্র আনন্দ সমরকুনের লেখা একটি গান পরে জাতীয় সংগীত হিসেবে (আপা শ্রীলঙ্কা, নম নম মাতা) স্বীকৃতি পায়। তবে একটা মত আছে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় ছাত্রকে তাঁর দেশের জন্য বাংলায় একটি গান লিখে দেন ও সুর করেন। আনন্দ সমরকুন পরে এটি সিংহলি ভাষায় লেখেন। এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে এটুকু বলা যায়, এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কিছু অবদান ও প্রভাব হয়তো আছে।

স্বাধীনতা প্রাপ্তির (১৯৪৮) পর থেকেই ব্যাপক ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে শ্রীলঙ্কা। এবার পড়েছে চরম আর্থিক বিপর্যয়ে। বাংলাদেশ প্রায় প্রতিটি বিপদে সাধ্যমতো দেশটির পাশে থেকেছে। তামিল ইনসারজেন্সি যখন মধ্যগগনে, তখন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে শ্রীলঙ্কান সেনা ক্যাডেটদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শ্রীলঙ্কা সশস্ত্র বাহিনীর অনেক সদস্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন ও করছেন।

২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর সংঘটিত সুনামিতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল শ্রীলঙ্কা। তখন সাহায্যসামগ্রী নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ ‘বিএনএস তুরাগ’ সে দেশে গিয়েছিল। বাংলাদেশের সাহায্য সংস্থা ব্র্যাক এ দুর্যোগে শ্রীলঙ্কার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। ২০১৬ সালের বন্যা ও ভূমিধসে শ্রীলঙ্কা আবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ ‘বিএনএস বঙ্গবন্ধু’ নিয়ে আমাদের নৌসেনারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এবারও ২০২১ সালের আগস্টে অর্থাৎ সংকটের শুরুর দিকে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে ২৫ কোটি ডলার ঋণ দেয়। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ থেকে দ্বিতীয় দফায় আরও ২০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছিল শ্রীলঙ্কা। তবে এবার দেশটিকে ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়নি বাংলাদেশের। এ পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে ভারত। বন্ধুপ্রতিম শ্রীলঙ্কার জনগণের এ মহাবিপদে কিছুটা প্রতীকী হলেও আমাদের উদ্বৃত্ত পণ্য থেকে খাদ্যসামগ্রী, ওষুধ ইত্যাদি পাঠানোর কথা কি আমরা ভাবতে পারি?

শ্রীলঙ্কার বর্তমান দুরবস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি ‘ওয়েক আপ’ কল। ষাট ও সত্তর দশকে লেবানন ছিল (ইসরায়েল ছাড়া) মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শিক্ষিত, সংস্কৃতিমান ও উদ্যোগী জনগণের দেশ। অবকাঠামো, যোগাযোগব্যবস্থা, পর্যটন শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরে শীর্ষে। সেই লেবানন চরম আর্থিক সংকটে পড়ে কয়েকদিন আগে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। প্রাচীন সভ্যতা ও গণতন্ত্রের পাদপীঠ গ্রিস বহু আগেই দেউলিয়া হয়ে গেছে।

দক্ষিণ এশিয়া ও আশপাশের দেশগুলোয় চরম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলছে। ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসে। শ্রীলঙ্কা মুখ থুবড়ে পড়ে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার জেরে এ সপ্তাহেই পাকিস্তানে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। মালদ্বীপ ও নেপালেও সংকট চলছে। পাশের দেশ মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত। এরই মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চমৎকারভাবে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এখন ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে...।

করোনার অভিঘাত আরও কিছুদিন চলবে। সাংহাইয়ে এখন লকডাউন চলছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের তীব্রতা কিছুটা কমলেও ইউক্রেনে পূর্বাঞ্চলভিত্তিক যুদ্ধ হয়তো অনেক দিন চলবে। এর অর্থনৈতিক প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। সব মিলিয়ে আমরা একটা কঠিন সময় পার করছি। করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতি মানুষকে কষ্টে ফেলেছে। জিনিসপত্রের দাম কীভাবে সহনীয় রাখা যায় সেখানেই সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এ পটভূমিতে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ অবশ্যই শ্রীলঙ্কা নয়। আমাদের অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী। বিদেশি ঋণের বিবেচনায়ও এখন পর্যন্ত আমরা ঝুঁকিমুক্ত। তবু শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি থেকে আমরা শিখতে পারি। শ্রীলঙ্কার ব্যর্থতার নির্মোহ বিশ্লেষণ আমাদের উন্নয়নকে বরং টেকসই করতে পারে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের দেখা মুগ্ধতার শ্রীলঙ্কা যেভাবে চরম সংকটে পড়ল তা সত্যিই চিন্তার বিষয়। তাহলে শ্রীলঙ্কার সরকার কি জনগণকে দেশের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা জানতে দেয়নি? শ্রীলঙ্কার কিছু অর্থনীতিবিদ দাবি করছেন বিভিন্ন সময় তাঁরা সরকারকে সতর্ক করেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু ভুল অর্থনৈতিক নীতি, গোষ্ঠীতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ও দুর্নীতি একটি দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার প্রমাণ শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো এমন হতে পারে। এক. বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে অবশ্যই মেগা প্রকল্প প্রয়োজন। তবে সেগুলো যেন অতিপ্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়। বড় বড় প্রকল্পে সুশাসন, স্বচ্ছতা অপরিহার্য। দুর্নীতি, অপচয় বন্ধ ও প্রকল্প সময়মতো সম্পন্ন করা জরুরি। দুই. বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে প্রয়োজন সতর্কতা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ। সতর্ক থাকতে হবে ঋণ পরিশোধের দায় নিয়ে। ঋণ পরিশোধের রোডম্যাপ থাকতে হবে। তিন. আমাদের অর্থনীতি এখন অনেকটা তৈরি পোশাক রপ্তানি ও রেমিট্যান্স নির্ভর। এখানে আমাদের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। রপ্তানি ক্ষেত্রে বহুমুখিতা অর্জন সময়ের দাবি। চার. জনতুষ্টিবাদী বা জনমোহিনী পদক্ষেপ গ্রহণ না করা। পাঁচ. বৈদেশিক রিজার্ভ সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া। শ্রীলঙ্কানরা লড়াকু জাতি। তাদের অন্তর্নিহিত এক ধরনের শক্তি রয়েছে। তারা একদিন হয়তো আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়ানো। আমাদেরও উচিত সাধ্যমতো তাদের পাশে থাকা।

বাংলাদেশকে একটি বিমানের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায় হাজার বছর পর বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের সুনীল আকাশে উড়তে বা টেক অব করতে যাচ্ছে। সুদক্ষ বৈমানিকরা বিমানের টেক অব ও ল্যান্ডিংয়ের সময় সবচেয়ে সতর্ক থাকেন। সদা সতর্ক থেকে এগিয়ে যাক আমাদের ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ। আবার মাথা তুলে দাঁড়াক আমাদের বন্ধুপ্রতিম শ্রীলঙ্কা।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর