শনিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

নতুন মাদক ম্যাজিক মাশরুম ও বাস্তবতা

ড. দিলীপ কুমার সাহা

নতুন মাদক ম্যাজিক মাশরুম ও বাস্তবতা

এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড), ডিএমটি (এন এনডাইমিথাইল ট্রিপটামিন) ব্রাউনি বা গাঁজার কেক (টেট্রাহাইড্রো ক্যানাবিনল), ক্রিস্টাল মেথ বা আইস (মিথাইল এম্পেফিটামিন), খাট [ক্যাথিনোন ও ক্যাথিন (নরসিডোইফিড্রিন)] নামের মাদকের পর এবার নতুন মাদক ‘ম্যাজিক মাশরুম’-এর সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ম্যাজিক মাশরুম মাদকটি সাধারণ মাশরুম থেকে একেবারে আলাদা। এ মাশরুমটি ভাঙার পর বিভিন্ন রং ধারণ করে। কখনো লাল, কখনো নীল এভাবে বিভিন্ন রং হয়। যেটি সাধারণ মাশরুমে হয় না। শারীরবৃত্তীয় প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে, মাদককের চারটি ভাগের মধ্যে ম্যাজিক মাশরুম হলো সাইকেলেডিক হ্যালুসিনোজেন ড্রাগের অন্তর্ভুক্ত। অন্য হ্যালুসিনোজেনিক ওষুধের মতোই ম্যাজিক মাশরুম তাদের প্রভাব তৈরি করে মস্তিষ্কের নিউরাল হাইওয়ের ওপর নিউরোট্রান্সমিটার সেরেটোনিন ব্যবহারের মাধ্যমে। আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায় ম্যাজিক মাশরুম মস্তিষ্কের সম্মুখভাগের বহিরাবরণের (প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স) ওপর প্রভাব বিস্তার করে।

মস্তিষ্কের এ অংশটি অবাস্তব চিন্তা ও চিন্তার বিষণ্ণতা নিয়ন্ত্রণ করে এবং মেজাজ ও উপলব্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ম্যাজিক মাশরুমে হ্যালুসিনোজেনের মূল উপাদান সিলোসাইবিন, অন্য একটি সক্রিয় উপাদান হলো সিলোসিন। সিলোসাইবিন নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁদের মতে সিলোসাইবিন মস্তিষ্কের কাজের ধরনের পরিবর্তন করে, যেখানে মস্তিষ্কের কিছু অংশ অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে আর কিছু অংশ অস্পষ্ট থেকে যায়। বিশেজ্ঞদের মতে বিষণ্ণতাগ্রস্ত মানুষের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের অনুভূতির অঞ্চলে সার্কিটগুলোর মধ্যে যোগাযোগ অনেক বেশি শক্তিশালী থাকে। যাদের চিন্তা-চেতনা বিষণ্ণতাগ্রস্ত তাদের মস্তিষ্ক ওভারকানেকটেড থাকে। কিন্তু এ সংযোগগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা গেলে এবং নতুন সংযোগ তৈরি করা হলে চিন্তা দূর হয় এবং এর থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে বিষণ্ণতাগ্রস্ত রোগীকে স্বল্পমাত্রায় ম্যাজিক মাশরুম তথা সিলোসাইবিনের এক ডোজ দেওয়া হলে ৮০ শতাংশেরই বিষণ্ণœতা ও উদ্বিগ্নতার উপসর্গ তাৎপর্যপূর্ণভাবেই কমতে থাকে, যা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড মানসিক মূল্যায়ন নামে পরিচিত। এতে পরামর্শ দেওয়া হয় যে এ ওষুধের একটি মাত্র ডোজই হতে পারে বিষণ্ণতা ও উদ্বিগ্নতা উপশমের শক্তিশালী অস্ত্র।

জীবনের সমাপ্তির সম্মুখীন বিষণ্ণতা ও মর্মপীড়ায় ভোগা মানুষের ওপর সিলোসাইবিনের প্রভাব লক্ষ্য করে গবেষকরা দেখেন যে স্বল্পমেয়াদিভাবে এর সফলতা মিললেও হ্যালুসিনোজেন পারসিস্টিং পারসেপশন ডিজঅর্ডারের কারণে দীর্ঘদিন হ্যালুসিনোজেনিক ওষুধ ম্যাজিক মাশরুম ব্যবহারের ফলে সাইকোডেলিক প্রভাব দেখা যায়, যার ফলে সৃষ্টি হয় নানা ধরনের অস¦াভাবিক সমস্যা। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে মানসিক রোগ যেমন সাইকোসিস ছাড়াও অবিরাম হ্যালুসিনেশন হয়। এভাবে এসব ব্যক্তি ড্রাগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তদুপরি ম্যাজিক মাশরুম দেহের এনডোক্রাইন সিস্টেম বা শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এর কারণে দেহে হরমোন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে কিংবা হরমোন নিঃসরণের প্যাটার্ন বা ধরন বদলে যেতে পারে, যা দেহের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এ মাদক দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে এটি দেহের স্নায়ুতন্ত্রের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। স্নায়ুতন্ত্রের সঠিকভাবে কাজ না করার কারণে ব্যবহারকারীর ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া ক্ষুধামান্দ্য, স্মৃতিভ্রম পায়খানা-প্রসাব ঠিকভাবে না হওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সাধারণত এ ড্রাগটি বিভিন্ন খাবারে যেমন কেক ও চকলেট মিক্স অবস্থায় সেবন করা হয়। এ ছাড়া পাউডার ক্যাপসুল হিসেবেও পাওয়া যায়। এ মাদক যদি কেউ ৫ থেকে ১০ মিলিগ্রাম সেবন করে তাহলে হ্যালুসিনেশন শুরু হয় এবং এর প্রতিক্রিয়া ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে। এ ড্রাগ ব্যবহারে সাইকোডেলিক প্রভাবের কারণে সেবনকারীর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন সে যে কোনো ধরনের অঘটন ঘটাতে পারে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৫০ ধরনের ম্যাজিক মাশরুম রয়েছে যার বেশির ভাগ পাওয়া যায় ইউরোপ ও আমেরিকায়। ইউরোপ, আমেরিকা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ধনীর দুলালদের কিছু অংশ মাদকে আসক্ত হয়। পরে এসব শিক্ষার্থীর হাত ধরেই দেশে আসে নতুন এসব মাদক। তাদের মধ্যে বেশির ভাগেরই ভয়ংকরভাবে সাইডেলিক আসক্তি থাকে এবং ব্যবহৃত চলমান মাদক বা ড্রাগ তাদের জন্য রেজিস্ট্যান্স হয়ে যায় কিংবা পরিমাণে দিন দিন বেশি প্রয়োজন হয়, ফলে মাদকসেবীদের কাছে এ ধরনের অপ্রচলিত ড্রাগের চাহিদা তৈরি হয়। তাই ইন্টারনেট থেকে তথা ড্রার্কসাইট থেকে সাইকেডেলিক ড্রাগের ওপরে অনুসন্ধান শুরু করে।

এভাবে ম্যাজিক মাশরুমসহ জীবনবিধ্বংসী নতুন নতুন মাদকে ঝুঁকছে তরুণ প্রজন্মসহ ছাত্র-যুব সমাজ। ফলে নতুন নতুন মাদকের সম্পর্কে আমরা জানতে পারি যা কি না উদ্ধার করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যে ছাত্র-তরুণ-যুব সমাজ দেশের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, একসময় জাতির আশা-আকাক্সক্ষার লক্ষ্যস্থল হিসেবে যারা বিবেচিত হয়েছে আজ তারা মাদকের ভয়াল থাবায় বিপথগামী। সন্ত্রাসবাদ ও কূপমন্ডূূকতার প্রতিভূ জঙ্গিবাদের সঙ্গে দৃশ্যত এদের জড়িয়ে পড়ার পেছনে মাদকের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।তবে সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে মাদকাসক্তি রোধ ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় যত্নবান হতে হবে। দেশের প্রাণশক্তি তরুণ ও যুব সমাজকে সব ধরনের সর্বনাশা থাবা থেকে মুক্ত করতে সমাজসংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা একান্তভাবেই কাম্য।

লেখক : প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক, বাংলাদেশ পুলিশ।

সর্বশেষ খবর