সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

বন্ধ হোক প্রতারণা

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

বন্ধ হোক প্রতারণা

করোনাকালীন অনলাইন পণ্য সরবরাহ এবং মূল্য পরিশোধের যে প্রতারণা আমরা দেখেছি তা সহজে ভোলার নয়। মূল্য পরিশোধ করার পরও দিনের পর দিন অপেক্ষা করে পণ্যটি আসেনি কিংবা যে পণ্য দেওয়ার কথা তা না দিয়ে নিম্নমানের অন্য কিছু পাঠিয়ে দায় সেরেছে। আবার কোনো কিছু না দিয়েই টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করে উধাও হয়ে গেছে। এসব হায় হায় কোম্পানির কিছু কিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চিহ্নিত করতে পারলেও ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগ মোটেও লাঘব হয়নি। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে গ্রামের ও বস্তির গরিব ও দরিদ্র মানুষ বিশেষ করে মহিলাদের কাছ থেকে অল্প অল্প টাকা নিয়ে বেশি টাকা ফেরত দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করে অফিসে তালা ঝুলিয়ে লাপাত্তা হয়েছে। এভাবে গ্রাহকরা প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। অব্যাহত প্রতারণার সঙ্গে নতুন করে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে পণ্যের নির্ধারিত মূল্যে ঘষাঘষি করে নতুন মূল্য লিখে দেওয়া। বিভিন্ন উৎসব বিশেষ করে ঈদ সামনে রেখে পণ্যের মূল্যের হরহামেশা পরিবর্তন বর্তমান সময়ে মিডিয়ার কল্যাণে সবার নজরে এসেছে। একই পণ্যের ওপর একবার নয়, দুবার নয়, তিনবার পরিবর্তন করে নতুন মূল্য নির্ধারণ করা প্রতারণার কোন পর্যায়ে পড়ে তা ভেবে দেখা দরকার। প্রতারণার ফাঁদে পড়ে গ্রাহকদের কষ্টের টাকার এ জলাঞ্জলি কষ্টের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।

সম্প্রতি বিভিন্ন শপিং মলে এ ধরনের প্রতারণার দৃশ্য প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও ভ্রাম্যমাণ আদালত এদের চিহ্নিত করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে এ ধরনের চক্র এত বেশি যে সামান্য কয়েকজন লোকবল দিয়ে এ ধরনের প্রতারণা বন্ধ করা সম্ভব নয়। ২০১৯ সালের ২৫ মে ঈদ মৌসুমে উত্তরার আড়ং শপিং মলে ৭১৩ টাকায় একটি পাঞ্জাবি কিনেছিলেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম। ছয় দিন পর ৩১ মে ওই একই পাঞ্জাবি কিনতে গিয়ে দেখেন, সেটির দাম ১ হাজার ৩০৫ টাকা। বেশি দামেই পাঞ্জাবিটি কিনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগ করেন তিনি। অভিযোগটি আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটকে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমকে চেনে না এমন সচেতন মানুষ কম। মাছে ফরমালিন মেশানো, খাদ্যে ভেজাল এবং নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অধিক দামে বিক্রি করার অভিযানে তিনি সবার মধ্যমণি হয়েছিলেন। কিন্তু পত্রিকায় দেখেছি উনার ব্যাচের সবার প্রমোশন হলেও তার প্রমোশন হয়নি। উপরন্তু বদলি করা হয়েছে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে। এখন থেকে ১০-১৫ বছর আগে খাদ্যে ভেজালবিরোধী অভিযানে বাংলাদেশে প্রথম জনগণের দৃষ্টিতে এসেছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট রোকনুদ্দৌলা। দুই-তিন বছর অনবরত তাকে সক্রিয় দেখা গেছে। বর্তমানে তিনি কোথায় কী করছেন তা কারও জানা নেই।

অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতারণার এ কার্যক্রম শুধু পণ্যের মূল্য পুনর্নির্ধারণ কিংবা খাদ্যে ভেজালই নয়, প্রতারণা চলছে খাদ্যে রং মিশিয়ে, মরা মাছে গরুর রক্ত মিশিয়ে, মহিষের মাংসকে গরু এবং কুকুরের মাংসকে খাসির মাংস বলে, পুকুরের মাছকে নদীর মাছ বলে। প্রতারণা আছে পোড়া মবিল দিয়ে ভাজাপোড়া করা, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বেচাকেনা করা, রডের পরিবর্তে বাঁশের কঞ্চি এবং সিমেন্টের স্থলে বালু ব্যবহার করা ইত্যাদি। জাকাতের কাপড় দেওয়ার নামে মানুষকে পায়ে পিষ্ট করে মেরে ফেলা প্রতারণা নয় কি? ত্রাণের প্যাকেটে ১০ কেজির স্থলে ৭ কেজি দেওয়া প্রতারণা নয় কি? গরিবদের জন্য সরকারি সহায়তা গরিবদের না দিয়ে নিজের ঘরে খাটের নিচে কিংবা গুদামজাত করা প্রতারণা নয় কি? ফুটপাথে গরিব অসহায় হকারদের কাছ থেকে দৈনিক ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা প্রতারণা নয় কি? এগুলো যারা নিয়ন্ত্রণ করে তারা এত শক্তিশালী যে সরকারপ্রধানকেও ভয় পায় না। প্রমাণস্বরূপ আমরা দেখেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক গৃহীত ভূমিহীন অসহায় মানুষের জন্য তৈরি আশ্রয়ণ প্রকল্প, যেখানে নবনির্মিত ঘরগুলো উদ্বোধন করার কিছুদিনের মধ্যেই ধসে পড়েছে। জাতির সঙ্গে এ ধরনের প্রতারণা নির্দ্বিধায় যারা করে যাচ্ছে তাদের এখনই কঠোর হস্তে দমন করা প্রয়োজন।

এটা সত্য যে, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও রমজানকে কেন্দ্র করে অনেক মুসলিম দেশে পণ্যের দাম কমিয়েছে। অথচ দুর্ভাগা এ বাংলাদেশে রমজান মাস এলেই পণ্যের দাম লাগামহীন বাড়তে থাকে। মহামান্য রাষ্ট্রপতিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অসৎ ব্যবসায়ীদের এসব কারসাজিকে গজব বলে উল্লেখ করেছিলেন। আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম ঘোষণা করেছেন। নিয়ম মেনে সঠিকভাবে ও ধৈর্য ধরে ব্যবসা পরিচালনা করলে একদিকে যেমন অনেক সওয়াব হয়, অন্যদিকে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের স্বার্থই সংরক্ষণ হয়। পণ্যের মূল্য ঘষামাজা করে ব্যবসার পরিবেশ এবং ক্রেতা-বিক্রেতা মধুর সম্পর্ক নষ্ট করা মোটেও কাম্য নয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত হয়তো শুধু জরিমানা করবে; কিন্তু পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হতে পারে, ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত যে কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তখন ক্ষতির সম্মুখীন হবে বিক্রেতাই বেশি। সম্প্রতি নিত্যপণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষ খুবই হিমশিম খাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে রোজার মাসে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে টিসিবির পর এবার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় রাজধানীর ১০টি স্থানে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রে সুলভে দুধ, ডিম ও মাংস বিক্রি করছে। এ উদ্যোগ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বাজার দরের চেয়ে কম দামে এসব পণ্য কিনতে পেরে অনেকের ভরসার স্থল হয়ে উঠেছে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এ ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্র। তবে অভাবী জনসংখ্যার অনুপাতে এ ধরনের উদ্যোগ আরও বেশি নেওয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। আর বাজার নিয়ন্ত্রণে আরও অধিক জনবল নিয়োগসহ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা দরকার। অসাধুদের শায়েস্তা এবং যারা নিয়ম-কানুন সঠিকভাবে মেনে চলে তাদের পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা দরকার।

লেখক : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর