শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

কৃষকের ঈদ

শাইখ সিরাজ

কৃষকের ঈদ

‘থালা ঘটি বাটি বাঁধা দিয়ে হের চলিয়াছে ঈদগাহে,

তীর-খাওয়া বুক, ঋণে-বাঁধা-শির, লুটাতে খোদার রাহে।

জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ

মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’

-কৃষকের ঈদ/কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলামের ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতাটি পড়লে কৃষকের যে সামাজিক-অর্থনৈতিক চিত্র পাওয়া যায় তা-ই ছিল আমাদের একসময়ের কৃষকের অবস্থা। কৃষি মানেই ছিল অনিশ্চিত এক পেশা। ফসল ঘরে ওঠা না অবধি কৃষকের কিছুই থাকত না। আবার ঘরে ফসল উঠলেও ঠিকঠাক দাম না পেলে সেই ফসলও কৃষককে সমৃদ্ধ করত না। ফলে ফসল ফলাতে, জীবন ধারণ করতে কৃষকের মাথায় সব সময় বয়ে বেড়াতে হতো ঋণের বোঝা। নিজে ফসল ফলালেও ঘরে খাবার থাকত না তার। ফসল ঘরে তোলা না অবধি কৃষকের পকেটে কোনো নগদ অর্থ থাকত না। কিন্তু ঈদ তো আর ফসল তোলার হিসাবে আসত না। ঈদ আসত চান্দ্রমাসের হিসাবে। এ সময়ে এসে অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে বটে তবে এখনো বৈরী আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে কৃষককে গুনতে হয় লোকসানের হিসাব। ঋণের বেড়াজাল থেকে সহসা বের হতে না পেরে বিপর্যস্ত হতে হয়। ঈদে ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করা, এক মাস রোজার পর ঈদের জন্য বিশেষ বাজারসদাই করা ছিল কৃষকের জন্য কঠিন এক ব্যাপার।

গত শতাব্দীর আশির দশকে যখন কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান নির্মাণ শুরু করি তখন খুব কাছ থেকে দেখেছি কৃষকের দুরবস্থা। কৃষি মানেই ছিল ধান আর পাট। বন্যা বা খরায় একবার ফসল নষ্ট হলেই কৃষককে পথে বসতে হতো। গ্রামের মহাজনদের কাছে এক রকম জিম্মি হয়ে থাকতে হতো কৃষককে। আপনাদের অনেকের মনে থাকতে পারে, প্রায়ই সংবাদপত্রে খবর হতো, দুই মণ ধান বিক্রি করেও একটি ইলিশ কিনতে পারে না কৃষক। ধান ও পাটের দাম নিয়ন্ত্রণ করত তৃতীয় পক্ষ। লাভের অঙ্ক চলে যেত তৃতীয় পক্ষের পকেটে, কৃষক থাকত লোকসানে। কৃষক যখন ধান-পাট চাষ থেকে বেরিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষিতে যোগ দিল, তখন মাঝারি কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হতে শুরু করল। একেক মৌসুমে একেক ফসল। আবার একই খেত থেকে একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ফসল ফলিয়ে কৃষক তার হাতে সব সময়ই টাকা রাখার কৌশল শিখে নিয়েছে। এখন গ্রামের কৃষক বেশ হিসাব করে কৃষিকাজ করে। কখন কোন ফসল লাগালে কোন ফসল থেকে কী লাভ আসবে সব তার হিসাবের মধ্যে আছে। এ বদলে যাওয়া কৃষি ও কৃষককে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে।

মাসখানেক আগে গিয়েছিলাম মানিকগঞ্জের বৈচিত্র্যময় কৃষির এলাকা সিংগাইর উপজেলার খালাসিপাড়ায়। সেখানকারই একটি গ্রাম খাসেরচর। গাড়ি থেকে নেমে গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল একটা বাড়ি। গ্রামের একটা গৃহস্থবাড়ি যেমন হয়। আগে গ্রামাঞ্চলে যেমন জীর্ণ ভাঙা বাড়ি চোখে পড়ত, এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। এখন গ্রামের অনেক বাড়িই পাকা, নয় তো টিনের চালার ঘর। খাসেরচরের যে বাড়িটির কথা বলছি সেটি আধাপাকা। আমায় দেখে এগিয়ে এলেন গৃহকর্তা। নাম সিরাজুল ইসলাম। বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি হবে। এখনো বেশ শক্ত-সমর্থ। আমাকে নিয়ে গেলেন বাড়ির উঠোনে। ঘরের বারান্দায় বসতে দিলেন। কথা হলো তাঁর সঙ্গে। কৃষিজীবী সিরাজুল ইসলাম অল্পস্বল্প ব্যবসা করেন। গত ২৪ বছর তিনি এ বাড়িতে আছেন। বলছিলেন সুখী পরিবার তাঁর। জীবনে তৃপ্তিও আছে। উঠোনের চারদিকে চারটি ঘর। দুটি থাকার ঘর। একটি রান্নাবান্নার। আর একটি ঘর গরু-বাছুরের। সেখানে দুটি গরু রয়েছে। ‘প্রতি বছর দুটি করে গরু মোটাতাজা করে কোরবানির সময় বিক্রি করি। এতে হাতে বেশ কিছু নগদ টাকা আসে।’ বলছিলেন সিরাজুল। ‘কৃষিকাজ করে এখন বেশ আয়-উন্নতি হয়।’ সিরাজুল ইসলাম নিজের চোখে দেখা কৃষি উন্নতির কথা বলছিলেন। মাঠে মাঠে ফসলের বৈচিত্র্য বেড়েছে। তবে কৃষকের নিজের জমি কমছে। এ এলাকার প্রতি বাড়িরই কেউ না কেউ বিদেশ থাকেন। বিদেশ থেকে পাঠানো টাকায় কৃষিকাজ হয়, গরু কেনেন। জানালেন সিরাজুল ইসলাম। তার মানে, এ অঞ্চলের কৃষিতে বিনিয়োগের একটা বড় অংশই আসে রেমিট্যান্স থেকে। শুধু এ অঞ্চল নয়, সারা দেশেই কৃষিতে বিনিয়োগের বড় একটা অংশ আসে অকৃষিজ পেশা থেকে। কেউ বিদেশ থেকে টাকা পাঠান, কেউ বা গার্মেন্ট বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বাড়িতে টাকা পাঠান। সে টাকায় কৃষিকাজ হয়। কৃষক এখন শুধু কৃষিকাজেই যুক্ত নেই, নিজেই এখন বহুমুখী পেশায় নিজেকে যুক্ত রেখেছে। ফলে তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে। এখন ঈদ কিছুটা হলেও আনন্দের।

মানিকগঞ্জের ওই অঞ্চলে যাওয়ার বিশেষ কারণ ছিল। প্রতি ঈদেই চ্যানেল আইয়ে ঈদের পরদিন বিকাল সাড়ে ৪টায় ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ প্রচারিত হয়। এবারের ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’র খেলাধুলার অংশ ধারণ করার জন্য গিয়েছিলাম মানিকগঞ্জে। কৃষিবৈচিত্র্যে পাল্টে যাওয়া মানিকগঞ্জের কৃষকের অংশগ্রহণে এবারের ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ ভিন্ন রকম আয়োজন। আমার এ অনুষ্ঠান নিয়েও আছে নানান রকম স্মৃতি, নানান ঘটনা।

টেলিভিশন তখন ধনীদের ড্রয়িং রুম থেকে মধ্যবিত্তের ঘরে প্রবেশ করেছে। সে সময় আমি টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ শুরু করি। কৃষকদের নিয়ে সে অনুষ্ঠান কৃষক দেখত কোনো মধ্যবিত্তের ঘরে কিংবা উঠোনে কিংবা চায়ের দোকানে দল বেঁধে বসে। কিন্তু কৃষক যখন সমৃদ্ধ হতে শুরু করল, টেলিভিশনের দামও কমে এলো, তখন নিজের ঘরেই একটা টেলিভিশন রাখার ক্ষমতা তৈরি হলো। আমার মনে হলো, সে সময়টাতে কৃষকের নিজের জন্য ঈদের কোনো অনুষ্ঠান নেই। টেলিভিশনের ঈদ অনুষ্ঠান মানেই শহুরে নাটক, সিনেমা কিংবা গান। আমি চিন্তা করলাম কৃষকদের জন্য এমন একটা অনুষ্ঠান নির্মাণের যাতে কৃষকের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকবে। সে চিন্তা থেকেই নির্মাণ শুরু করি কৃষকের ঈদ আনন্দ। কৃষকদের নিয়ে খেলাধুলা। পাশাপাশি কৃষকদের নানান বিষয়ে সচেতন করে তোলা। এ অনুষ্ঠান তুমুল জনপ্রিয়তা পেল। শুধু কৃষকই নয়, এ অনুষ্ঠানের দর্শক আবালবৃদ্ধবনিতা, শহরের চাকরি-জীবী থেকে শুরু করে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। যখন শুনি কৃষকের ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’, তখন খুব আনন্দ হয়।

কৃষকের সন্তান কৃষির বাইরে নানান পেশায় নিয়োজিত আছেন অনেকে। তারা ছড়িয়ে পড়েছেন সারা দেশে। সারা পৃথিবীতে। ঈদে কৃষকের সন্তান, নাতি-নাতনিরা বাড়ি ফেরেন। আমরা সবাই কোনো না কোনো কৃষক পরিবারেরই সদস্য। আমাদের কাছে এখনো ঈদ মানেই বাড়ি ফেরা, গ্রামে সবার সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন। প্রতি ঈদে কৃষকের বাড়িটি পূর্ণ হয় আত্মীয়স্বজনে। ঈদে বিপুলসংখ্যক মানুষের বাড়ি ফেরার পথটি আমরা এখনো নিরাপদ করতে পারিনি। বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে ধারণক্ষমতার বাইরে যাত্রী বহনের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের সচেতন হওয়াটা সবচেয়ে জরুরি। ঈদে বাড়ি ফিরতে গিয়ে লাশ হওয়ার চেয়ে দেরিতে জীবন নিয়ে ফেরাটা নিশ্চয়ই ভালো। এ ক্ষেত্রে সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বয় করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ঈদ পরিপূর্ণ হোক আনন্দে। সবার ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

 

                লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর