শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও শিল্প সম্প্রসারণ

ড. মো. জামাল উদ্দিন

কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও শিল্প সম্প্রসারণ

খাদ্য প্রক্রিয়াজাত -করণ শিল্পে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে এ কথা উল্লেখ করে সম্প্রতি ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিটাক, বিসিক ও বিএসইসির সমাপ্ত চারটি প্রকল্পের উদ্বোধন করতে গিয়ে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা কৃষিপণ্য, কৃষি ও খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছি। গবেষণার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আমরা নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন, বিভিন্ন ফলমূল, তরিতরকারি সবজি উৎপাদন, মাছ-মুরগির ডিম, মাংস উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছি। এগুলো প্রক্রিয়াজাত করতে পারলে অর্থাৎ ভ্যালু অ্যাড করতে পারলে আমরা যেমন বিদেশে রপ্তানি করতে সক্ষম হব, পাশাপাশি নিজের দেশের মানুষেরও যেহেতু ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে, সেখানে আমাদের বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে। আমরা সেদিকে লক্ষ্য রেখে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। শিল্পায়নের সম্প্রসারণে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অর্থনীতি- এটা কৃষিভিত্তিক ঠিক, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শিল্পায়ন আমাদের প্রয়োজন। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে।

প্রাথমিক কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বিকাশে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে। যা ভ্যালু অ্যাডেড অ্যাগ্রিকালচারের পূর্ণতা লাভ করতে সহজ হবে। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বিকাশ ঘটাতে প্রাথমিক কৃষিপণ্যের ভ্যালু এডিশনের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। ভ্যালু অ্যাডেড অ্যাগ্রিকালচারের দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্বের বহু দেশ বেশ অগ্রসরমান। বিগত দশক থেকে বাংলাদেশও এ খাতের দিকে বেশ মনোযোগী। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে দেশে প্রায় ৬৮২ লাখ টন প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য উৎপাদন এবং ১৪০ দেশে এসব খাবার রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ১৭০ লাখ টন। বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এগিয়ে নিতে হলে মানসম্মত উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি, উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি, কন্টাক্ট ফার্মিংয়ে জোর দিতে হবে। বাণিজ্যিক উৎপাদন এলাকায় পণ্য কালেকশন সেন্টার, ওয়্যারহাউস/প্যাক-হাউস ও সংরক্ষণাগার গড়ে তোলা দরকার। ভালো চাহিদাসম্পন্ন এলাকা-ভিত্তিক ইউনিক প্রোডাক্টের ব্র্যান্ডিং করা গেলে সুফল মিলবে বেশি। যেমন ভারতের কেরালার একমাত্র আনারস ‘মরিশাস’ জাতটি জিআই প্রডাক্ট হিসেবে রাজ্য সরকার কর্তৃক স্বীকৃত। এ আনারস জাতটি শতভাগ বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়। এ আনারস কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠেছে। তাদের সহায়তায় প্রাথমিক পণ্য আনারস থেকে প্রায় ১৫ রকমের ভ্যালু অ্যাডেড খাদ্যপণ্য তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে ফ্রেশকাট পাইনঅ্যাপল, ড্রাইড পাইনঅ্যাপল, আনারসের জ্যাম, জেলি, জুস, সফট ক্যান্ডি, আনারসের চাঙ্ক, পাল্প ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কেরালায় ম্যানকো ফুডস নামে এক বেসরকারি আনারস প্রক্রিয়াজাত কারখানায় তিন ধরনের আনারসের পাল্প তৈরি করতে দেখা যায়। তা হলো অ্যাসেপ্টিক পাল্প, ক্যান্ড পাল্প ও সালফিউরেটেড পাল্প। এসব পাল্প সাধারণ তাপমাত্রায় দুই বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখা যায় বলে জানান কোম্পানির স্বত্বাধিকারী মি. সানিশ জোস। এসব পাল্প বদ্ধ ড্রামে করে বিভিন্ন জুস তৈরি কারখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের ভ্যালু অ্যাডেড খাদ্যপণ্য তৈরি হয়। ওই ফ্যাক্টরির সিইও জানান, ক্ষুদ্র আকৃতির কারখানাটি ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপনে খরচ হয়েছে মাত্র ৫ কোটি রুপি। এভাবে ব্যক্তি উদ্যোক্তা তৈরি হলে এ শিল্পের সম্প্রসারণ সহজ হবে। এ ছাড়া কেরালার ভার্জিন নারকেল তেল, নারকেল পাউডার ও নারকেলের উপজাত থেকে তৈরি নানা রকমের শোপিস পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে। এসবের অর্থনৈতিক ভ্যালুও অনেক। সেখানে কলা থেকে তৈরি নানা রকম চিপসও দেদার বিক্রি হয় রাস্তার ভালোমানের দোকানগুলোয়। একইভাবে ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটিতে ফুটপাথের দোকানে সুন্দর রেপিং করা মোড়কে বিভিন্ন ফলের ফ্রেশকাট বিক্রি করতে দেখা যায়। যা বেশ লোভনীয়। আমাদের দেশেও স্বল্প আকারে হর্টেক্স ফাউন্ডেশন এ কাজটি শুরু করেছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা শুধু কাঁঠাল থেকেই প্রায় ২০ রকমের ভ্যালু অ্যাডেড খাদ্যপণ্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। কিছু কিছু সুপার শপে তা বিক্রি হতে দেখা যায়। চাহিদাও বেশ লক্ষণীয়। এ ছাড়া মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম থেকেও অনেক ভ্যালু অ্যাডেড খাদ্যপণ্য তৈরি হচ্ছে আমাদের দেশে। সেসবের প্রচার ও প্রসার ঘটা দরকার। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে হলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি বেসরকারি প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ জোরদার করতে হবে। এলাকাভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। অঞ্চলভিত্তিক ধনী লোকদের এ ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে পারলে সুফল মিলবে বেশি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও কারিগরি সহায়তার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তি বিনিময়, উন্নত ব্যবস্থাপনা, তদারকি জোরদার ও কাজের স্বীকৃতি প্রদান নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে এ শিল্পের প্রসার ঘটবে। জাতীয় কৃষিনীতি-২০১৮ -এ ওই বিষয়ে ১২.২ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে; যা অত্যন্ত বাস্তব ও যৌক্তিক। তাতে বলা আছে- প্রাথমিক কৃষিপণ্য-ভিত্তিক শিল্প স্থাপনে উৎসাহিত করা হবে; কৃষি উপজাত ব্যবহারপূর্বক শিল্প স্থাপনে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হবে; কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত -করণে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিগত ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হবে।

লেখক :  সিনিয়র বিজ্ঞানী, বারি

সর্বশেষ খবর