রবিবার, ১ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

আবুল মাল আবদুল মুহিত : একমাত্র একজন

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

আবুল মাল আবদুল মুহিত : একমাত্র একজন

আবুল মাল আবদুল মুহিত (১৯৩৪-২০২২) অর্থাৎ আমাদের মুহিত স্যার আর নেই। গত পরশু রাতে তিনি আমাদের ছেড়ে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। তিনি ছিলেন জ্ঞান, প্রজ্ঞা, নিষ্ঠায় দেশিকোত্তম এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর নিজ অবস্থানে একমাত্র একজন হিসেবে পরিগণিত হতেন। তাঁর স্নেহচ্ছায়ায় কেটেছে আমার সরকারি চাকরিকাল। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের কর্ণধার অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আবদুল হাফিজ, মাতা সিলেট মহিলা মুসলিম লীগের সভানেত্রী সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরী। তাঁর দাদা খান বাহাদুর আবদুর রহিম ছিলেন আসাম সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা। অন্য দাদা আবদুল হামিদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী। আরেক দাদা এস এম আকরাম পূর্ব পাকিস্তান হাই কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি। জনাব মুহিতের নানা সৈয়দপুর অঞ্চলের প্রখ্যাত জমিদার সৈয়দ আবুল বাশার চৌধুরী। মুহিতের প্রপিতামহ দানবীর মৌলভী আবদুল করিম সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। তাঁর ফুফু ছিলেন সিলেট জেলার প্রথম মুসলিম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। সাত ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে জনাব মুহিত তৃতীয়; ভাইবোনেরা সবাই উচ্চশিক্ষিত, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত এবং দেশে-বিদেশে স্বনামে পরিচিত। ১৯৫৫ সালে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে প্রভাষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু।

সুশীল সেবক এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত আর্থ-প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সংস্কার ও উদ্ভাবনী মূলক পদক্ষেপ গ্রহণে বরাবরই প্রতিশ্রুতিশীল ছিলেন। ঔপনিবেশিক কাল থেকে চলে আসা সরকারি চাকুরেদের পেনশন অনুমোদন পদ্ধতিতে যুগোপযোগী পরিবর্তন তিনিই আনেন ১৯৮২-৮৩ সালে। সরকারি বেসরকারি খাতের সবার জন্য পেনশনব্যবস্থা প্রবর্তনের মূল কাজ তিনি তাঁর সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের সময় শুরু করেন। পেনশনাররা এখন ইএফটির মাধ্যমে পেনশন পাওয়ার মতো যুগান্তকারী সুযোগ লাভ পেতে শুরু করেছেন তাঁরই স্বপ্ন-প্রেরণা ও তদারকিতে অর্থ বিভাগ উদ্ভাবিত ই-ট্রান্সফার পদ্ধতিতে। ১৯২২ সালের (ব্রিটিশ) ভারতীয় আয়কর আইন ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশে অনুসৃত হয়ে আসছিল। জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৮২-৮৩ সালে অর্থ উপদেষ্টা থাকার সময় বাংলাদেশের জন্য নতুন আয়কর আইন সংরক্ষণ ও প্রবর্তনের প্রথম উদ্যোগ নেন। তাঁর ফসল বাংলাদেশ আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ (তখন দেশে সংসদ ছিল না তাই অধ্যাদেশ আকারে এটি প্রবর্তিত হয় এবং এখনো বলবৎ আছে। বিদ্যমান আয়কর, মূসক ও শুল্ক আইনকে যুগোপযোগী করার প্রচেষ্টা তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন তাঁর সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের সময় পর্যন্ত। নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণামতে জনপ্রতিনিধিদের সম্পদ বিবরণী প্রদান ব্যবস্থাপনা কার্যকরের ব্যাপারে তাঁর তরফে করণীয় নির্ধারণে তিনি অবিচল ছিলেন। মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিজ সম্পদের হিসাব প্রধানমন্ত্রীর দফতরে নিজে যেমন পাঠান, তেমনি সহকর্মী অন্য মন্ত্রী/উপদেষ্টা/ প্রতিমন্ত্রীদেরও আহ্বান জানিয়েছেন তাঁদের সম্পদের হিসাব প্রধানমন্ত্রীর দফতরে জমা দিতে। এভাবেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনের লক্ষ্যে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। তাঁর স্মৃতিচারণামূলক লেখাগুলোয় দেখা যায় তাঁর সব কর্মস্থলে-কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পরিবেশ রচনায় তিনি ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে তাঁর দর্শন তাঁর জেলা প্রশাসন সংস্কার গ্রন্থে উঠে এসেছে সেই ষাটের দশকেই।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানতেন তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের অর্থনীতির নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বমন্দা এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যার ভিতরও বাংলাদেশের দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার উদাহরণ স্থাপন এবং স্বল্প সম্পদের দেশে উন্নত ও টেকসই অর্থনীতি গড়ে তোলার সমীকরণটি অত্যন্ত জটিল। তথাপি সৎ, স্বচ্ছ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার অগ্রণী ভূমিকায় তিনি ছিলেন।

বাংলাদেশে পরিবেশ আন্দোলন গড়ে তোলার পথিকৃৎ মুহিত বাপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরিকল্পনাবিহীন অবস্থায় নগরায়ণ বন্ধ ও পরিবেশ রক্ষা, সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তর, বিনোদন পার্ক সৃষ্টিতে তাঁর ভূমিকা রয়েছে। শৈশব-কৈশোরেই শিশু সংগঠন করেছেন, ছাত্র সংগঠন করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পাকিস্তান আন্দোলনে চাঁদা সংগ্রহ করেছেন। আবার সেই পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ বিরোধী আন্দোলন, বিশেষ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন পাকিস্তানি শাসনের শুরুতে, ১৯৪৮ সালে; আন্দোলনের একপর্যায়ে তাঁকে কারাবরণও করতে হয়েছে। সিলেটের নামকরা প্রতিষ্ঠান মুসলিম সাহিত্য সংসদে সদস্য হন ১৯৪৫ সালে। ওখানে সাহিত্যসভা করতেন। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি ভলিবল, ফুটবল, বাস্কেটবল, ক্রিকেট খেলতেন। স্কুলে থাকতেই বড় বড় সব বই পড়ে ফেলেছিলেন তিনি। ইতিহাস ছিল তাঁর খুব প্রিয় বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র-সংসদের নির্বাচিত ভিপি হিসেবে সে সময়ের ছাত্র আন্দোলন ও সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি।

আবুল মাল আবদুল মুহিতের অন্যতম পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন লেখক। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩১। দেশে-বিদেশে ২৫টি প্রকাশনায় তাঁর লেখা প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। বিভিন্ন আন্দোলন নিয়ে যেমন চমৎকার গ্রন্থ রচনা করেছেন তেমনি ভ্রমণকাহিনি, স্মৃতিকথা, রাষ্ট্র ও সরকারের রেখাচিত্রও অঙ্কন করেছেন স্বকীয় চিন্তায়। তাঁর লেখার বিষয়বস্তু মূলত প্রশাসন এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কীয়।

মানবসভ্যতার বিকাশে এ পৃখিবীর বিচিত্র রঙ্গমঞ্চে যে কোনো ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রায় হলেও নেতৃত্বের ভূমিকা নিতান্তই অনিশ্চায়ক। ‘মহাপুরুষদের কথা কাছ থেকে দেখা’ গ্রন্থে লেখক দেশের ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গনের চারজন খ্যাতনামা ব্যক্তির (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, লেখকের পিতা অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আবদুল হাফিজ এবং অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক) চিন্তা ও কর্মের কিছু পরিচিতি ব্যক্তিগত টুকরো স্মৃতির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। অন্যরূপ আলোকে আঁকা চিত্রগুলো ব্যতিক্রমধর্মী বটে। লেখকের গভীর ইতিহাস সচেতনতা এবং দেশ ও বিশ্ব পটভূমির সঙ্গে ব্যাপক পরিচিতি এ বিবরণগুলোকে করেছে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক ও আকর্ষণীয়। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে লেখকের নির্বাচিত এ চার মহাপুরুষ নানা অঙ্গনে বিচরণ করছেন। তাঁদের অবদান রয়েছে জাতিগঠনে, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায়, জ্ঞান বিতরণে এবং সমাজসেবায়।

আইয়ুব খান আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধু যখন রাওয়ালপিন্ডি যান তখন তাঁর দলের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন জনাব মুহিত এবং তখন যেসব বাঙালি কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে সহযোগিতা করেছিলেন বিভিন্ন তথ্য দিয়ে তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ২৪ আগস্ট ২০১৯ মরহুম মুহিতের সঙ্গে আমার একটি একান্ত আলাপচারিতা (মুক্ত আলোচনা পর্ব ৯০) অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানেই তিনি তুলে ধরেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের সংগ্রাম। তিনি সুদূর ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সপরিবারে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। আমেরিকায় বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে তিনি ছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায়। তিনি সব শ্রেণির মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি দেশকেও তুলে ধরেছেন। সমকালীন জীবন-যাপন, অর্থনীতির পাশাপাশি অতীতের অনেক অজানা বিষয় তাঁর লেখার মাধ্যমে উঠে এসেছে। নিজের অনন্যসাধারণ কর্মচঞ্চলতার মধ্যেই বইগুলো লিখেছেন। তাঁর লেখার প্রকাশগুণ অসাধারণ ও সহজবোধ্য। ফলে খুব সহজেই তাঁর লেখা পাঠককে টানে।

শাহবাগের সিভিল অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমিতে (কোটা) ১৯৮১ সালে আমরা যখন বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে ছিলাম তখন তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। তিনি বক্তৃতা দিতে আসতেন। আমরা কোটাতে থাকতেই জানলাম তিনি অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছেন সরকারে। ১৯৮২ সালের শেষের দিকে তাঁর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিসেন্ট্রলাইজেশন-সংক্রান্ত বইটি রিভিউ করেছিলাম পত্রিকায়। আমি তখন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডারের জুনিয়র কর্মকর্তা। ধন্যবাদ জানাতে আমাকে ডেকেছিলেন মন্ত্রণালয়ে। সেই থেকে আছি তাঁর স্নেহের বন্ধনে নানান পর্যায়ে, উপায় ও উপলক্ষে। ১৯৯২ সালে আমি যখন ইআরডিতে, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপ্লোমা কোর্সে অধ্যয়নের জন্য মনোনীত হয়েছিলাম আমার সম্পর্কে তাঁর লেখা নাতিদীর্ঘ প্রশংসাপত্রের সুবাদে। যখনই আমার কোনো বই প্রকাশিত হয় তা তাঁকে দিতে গেলে ঘণ্টাধিক সময় নিয়ে আলোচনায় উজাড় করতেন তাঁর অভিজ্ঞতার ডালি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অ্যালামনাই তিনি এবং আমরা। বছর তিনেক আগের এক সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমিতে, এই বয়সেও এসেছিলেন আমাদের সঙ্গে সেলিম আল দীনের ‘নিমজ্জন’ নাটকটি দেখতে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআর      চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ খবর