শুক্রবার, ৬ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

মুহিত জীবদ্দশায় এক কিংবদন্তি

ইনাম আহমদ চৌধুরী

মুহিত জীবদ্দশায় এক কিংবদন্তি

জীবদ্দশায়ই কিংবদন্তি বা ‘লিজেন্ড’ হয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য খুব কম মানুষের জীবনেই ঘটে। মরহুম এ এম এ মুহিত- মুহিত ভাইয়ের ৮৮ বছরের সফল ও সার্থক জীবনে সেই ব্যতিক্রম আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল একাধিক স্তরের পারিবারিক পর্যায়ে। তদুপরি বড় ভাই মরহুম ফারুক চৌধুরীর একজন অন্তরঙ্গতম আবাল্য-সুহৃদ ছিলেন তিনি। জাতির একজন দিকনির্দেশক বাতিঘর হিসেবেও আমাদের নাগরিক অস্তিত্বে তাঁর ব্যাপক উপস্থিতি। তবে বেদনাবিধুর এই মুহূর্তে আমার সংক্ষিপ্ত সশ্রদ্ধ স্মৃতিচারণা শুধু ব্যক্তিগত নিবিড় ও গভীর পরিচয়ভিত্তিক।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ অবসানে ১৯৪৬ সালে বাবা আসামের শিলং থেকে বদলি হয়ে যান উত্তর আসামে। সেখানে বসবাসের বিশেষ করে আমাদের (পুত্র-কন্যা) স্কুল-শিক্ষার ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করার জন্য স্বল্পকালীন সিলেট রেখে যান। ওই সময় জিন্নাহ সাহেব দু-এক দিনের সফরে একবার সিলেট এসেছিলেন। তখন সিলেটবাসীর মধ্যে দারুণ উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। আমরা তখন স্কুলের ছাত্র। স্কুল-কলেজের ছাত্ররা টিলাগড়ে এমসি কলেজ মোড়ে জিন্নাহ সাহেবের মোটরবহর থামিয়ে একটি স্বতঃপ্রণোদিত সংবর্ধনা জানিয়েছিল। উদ্দীপনাদীপ্ত মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে তখনই প্রথম পরিচয়। তিনি ছিলেন মুকুল ফৌজের অগ্রসেনা এবং আমাদের জ্যেষ্ঠ। সেই কৈশোরকাল থেকেই মুহিত ভাইয়ের রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল পরিদৃশ্যমান। সিলেটের এক অতি সম্ভ্রান্ত সমাজ-সচেতন শিক্ষিত পরিবারেই অবশ্য তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা।

১৯৫৪ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পরই মুহিত ভাইয়ের সান্নিধ্যে আসি। ১৯৫২-৫৩ সালে আমি ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলাম ও রাষ্ট্রভাষাসংক্রান্ত আন্দোলনে বহিষ্কৃতও হয়েছিলাম। মুহিত ভাই ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসমাজে নেতৃস্থানীয়। ১৯৫৪-৫৫ সালে এস এম হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মুহিত ভাই, (মরহুম) মাহবুব আনাম এবং আমি যথাক্রমে ‘হল সংসদের’ ভাইস প্রেসিডেন্ট, জেনারেল সেক্রেটারি ও জয়েন্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলাম। এই মুহিত ক্যাবিনেটের নেতৃত্বে তখনকার কর্মচঞ্চল ছাত্রজীবনে, বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও প্রগতিধর্মী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সংসদ একটি অগ্রণী ভূমিকা নিতে পেরেছিল। ওই সময়ের একটি ঘটনা মনে পড়ে। নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া ওয়াদা অনুযায়ী হলের পরিবেশিত খাবারের মানোন্নয়ন বাস্তবায়নের জন্য আবাসিক ছাত্রদের মাসিক ‘মেস ফি’ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য সদস্যদের সাধারণ সভায় পেশ করা হয়। কিন্তু তা গৃহীত না হওয়ায় মুহিত ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা সবাই কার্যকরী কমিটির পদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করি- প্রস্তাবের প্রত্যাখ্যানকে সাধারণ ছাত্রদের ‘ক্যাবিনেটে’র ওপর অনাস্থা বিবেচনা করে।

পদত্যাগ অবশ্য ‘হল কর্তৃপক্ষ’ কর্তৃক গৃহীত হয়নি এবং আমরা নির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত কার্যকর থাকি। ব্যাপারটি ক্ষুদ্র, তবে তা যৌবনকালেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি মুহিত ভাইয়ের আস্থার একটি প্রকাশ বলে ধরা যেতে পারে। পরবর্তী জীবনেও মুহিত ভাই তা প্রদর্শন করেছেন। স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে পদত্যাগ করার পর তদানীন্তন সামরিক প্রেসিডেন্ট তাঁকে অর্থমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন। মুহিত ভাই এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন শর্ত সাপেক্ষে। কথা ছিল প্রেসিডেন্ট সত্বর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে শাসনভার ন্যস্ত করবেন। দ্রুত তা হলো না বলে মুহিত ভাই অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। নীতিনিষ্ঠ মুহিত ভাই একজন সমাজসচেতন মেধাবী ছাত্রই ছিলেন না, ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আজীবন ছিল তাঁর প্রবল উৎসাহ। পরবর্তী জীবনে বাবা (মরহুম গিয়াসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী) যখন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট, মুহিত ভাই ছিলেন তাঁর সক্রিয় জেনারেল সেক্রেটারি। তাঁরা সর্ববিধ ক্রীড়ার ক্ষেত্রে শুধু মানোন্নয়ন নয়, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ সংরক্ষণে খুবই সচেষ্ট ছিলেন। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম এ বি এম মূসা এবং মুহিত ভাই আলাদাভাবে লিখেছেন। অরাজনৈতিক, মূলত সামাজিক জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকাণ্ডে ছিল মুহিত ভাইয়ের সোৎসাহ অংশগ্রহণ। বাবা ছিলেন ওই অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ওই দুই ভূমিকায় মুহিত ভাইয়ের প্রশংসনীয় দায়িত্ব সম্পাদনের ভালো কথা বাবার মুখে অনেক শুনেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবেও আমরা মুহিত ভাইয়ের যথাযথ নেতৃত্ব প্রত্যাশা করেছি।

১৯৫৬ সালে তিনি সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগদান করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বকাল পর্যন্ত অতীব দক্ষতার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব সম্পাদন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর বলিষ্ঠ ও ত্যাগী ভূমিকা সর্বজনবিদিত। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তিনি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও আইডিবিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করেন। পরবর্তীতে সৌভাগ্যক্রমে ওইসব দায়িত্ব পালনের সুযোগ আমার হয়েছিল এবং বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর কৃতিত্বের বলিষ্ঠ পদচিহ্ন ‘লিগেসি’ রেখে গেছেন। ১৯৮৩-৮৪ সালে ব্যাংককের জাতিসংঘ এস্কাপ কমিশনের বার্ষিক অধিবেশনে বাংলাদেশের নেতৃত্ব প্রদানকালে তিনি অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। দেশের আরেকজন কৃতী সন্তান মরহুম এস এ এম এস কিবরিয়া জাতিসংঘের এ সংস্থার নির্বাহী সচিব এবং আমি তখন কমিশনের সচিব। সেখানে দেখেছি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর দৃপ্ত ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। তখনই তিনি পরিবেশ-সংরক্ষণ ব্যাপারে জাতিসংঘের সম্ভাব্য জোরালো ভূমিকার ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। আমরা দেখেছি পরবর্তীতে তিনি হয়েছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

বাংলাদেশের সর্বদীর্ঘকালীন অর্থমন্ত্রী এবং একজন সুলেখক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও পেয়েছে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি। নির্দ্বিধায় বলা যায়, জীবনের যে ক্ষেত্রেই এ এম এ মুহিত পদচারণ করেছেন, সেখানেই তিনি হয়েছেন সফল ও সার্থক। একজন সিভিল সার্জেন্ট, কূটনীতিক, অর্থনীতিবিদ, মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদ, লেখক, ক্রীড়া-সমাজ-সাংস্কৃতিক সংগঠক- সব ভূমিকায়ই তিনি হয়েছেন সুপ্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে বিশ্ব ইতিহাসের ওপর একটি প্রামাণ্য পুস্তক রচনায় তিনি ব্যাপৃত ছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, তাঁর তিরোধান সে প্রচেষ্টায় যতি টেনে দিল।

আয়ুষ্কালের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশ ও মানুষের প্রতি সদাহাস্য এই নির্মোহ আদর্শবাদী মানুষের আকর্ষণ ও আনুগত্য ছিল পরিপূর্ণ ও প্রশ্নাতীত। সর্বজনপ্রিয় এই ব্যতিক্রমী মানুষকে জাতি সশ্রদ্ধ প্রীতিতে স্মরণ রাখবে চিরকাল।

লেখক : সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক চেয়ারম্যান প্রাইভেটাইজেশন কমিশন।

সর্বশেষ খবর