শনিবার, ৭ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

প্রয়োজন পরিবর্তিত জলবায়ুর কৃষিপ্রস্তুতি

শাইখ সিরাজ

প্রয়োজন পরিবর্তিত জলবায়ুর কৃষিপ্রস্তুতি

‘জলবায়ু পরিবর্তন’ এখন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিশ্বের চিন্তাবিদরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সরব। বিশ্ব নাগরিকদের সচেতন করার লক্ষ্যে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। যে কোনো বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করার প্রথম ধাপ হচ্ছে দুর্যোগপূর্ব প্রস্তুতি, বিষয়টি আমরা সবাই জানি। তার জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ আমরা ইতোমধ্যে বুঝতে শুরু করেছি। যেহেতু কৃষকের সঙ্গেই কাজ আমার, আমি তাদের কাছ থেকে জেনেছি জলবায়ু পরিবর্তন তারা কতটা অনুভব করতে পারছেন। সাদা চোখে এর প্রভাবটুকু শুধু গরম বাড়া-কমা কিংবা বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাবে দেখা হলেও আরও সূক্ষ্ম কিছু অনুষঙ্গ কৃষক অনুধাবন করছেন। পরিবর্তিত এই সময়ে কৃষির সার্বিক পরিস্থিতি কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন-জনিত সমস্যাগুলো আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব, সে বিষয়ে আমাদের গভীর ভাবনা-চিন্তার দরকার আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে পরিবর্তিত জলবায়ু সম্পর্কে কৃষককে সচেতন করে তুলতে হবে।

জার্মান ওয়াচের গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০২১ অনুযায়ী জলবায়ুতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। প্রশ্ন হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের দেশের ভূমিকা কতটুকু? যা জানতে পারলাম তা হলো, বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এ দেশের কন্ট্রিবিউশন ০.৪৭ শতাংশ। ইমিউশনের পরিমাণ ০.৯৮। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই আমাদের টেকসই উন্নয়ন অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত বৃষ্টি, বন্যা, খরা, ট্রিপিক্যাল সাইক্লোন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, মৌসুম পরিবর্তন, নদীভাঙন, সমুদ্রোপকূলে লবণাক্ততা লাখ লাখ মানুষের জীবন-যাপনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

গত বছর এপ্রিলে এক অচেনা দুর্যোগের সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল হাওরসহ দেশের ৩৬ জেলার হাজার হাজার কৃষককে। ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় বেশ কিছু অঞ্চলের ওপর দিয়ে গরম বাতাস বয়ে যায়। এ কারণে ধানসহ অন্যান্য ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে সারা দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হিটশকের (গরম বাতাসের প্রবাহ) কারণে ৩২৮ কোটি টাকার বোরো ধানের ক্ষতি হয়। অনেক অঞ্চলের ধান গাছগুলো ফ্লাওয়ারিং স্টেজ বা মিল্কিং স্টেজে (ধানে চাল গঠনের পর্যায়ে) থাকায় গরম বাতাসে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ফলে গাছে ধানের শীষ থাকলেও ধান সব চিটা হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে মোট ৩৬ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হিটশকে ২১ হাজার ২৯২ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়। শুধু ধান নয়, ধানের পাশাপাশি ভুট্টা, সবজি, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী ও কলার ফলনও নষ্ট হয়। সব মিলে টাকার অঙ্কে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৩৪ কোটির বেশি। বিজ্ঞান বলছে, ধান গাছের কচি থোড় থেকে ফুল ফোটার সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি হলে ধানে চিটা হয়ে যায়। অতিরিক্ত তাপ ও আর্দ্রতার কারণে গাছের ছত্রাক রোগ বাড়ে। পোকামাকড়ও বেড়ে যায়। ঠিক এ সমস্যাগুলোর ভিতর দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের কৃষককে। গত বছর নেত্রকোনার খালিয়াজুরী হাওর এলাকার খাইরুল, বিকাশ, বাছেত, সোহেল, নির্মলসহ অনেক কৃষক বলেছিলেন পোকামাকড়ের উৎপাত বেড়েছে। ফসলে নতুন নতুন পোকার দেখা মিলছে যা আগে কখনো তাঁরা তেমন দেখেননি। তাঁরা বলেছিলেন, এমন অকস্মাৎ গরম বাতাসে ধান নষ্ট হয়ে যাওয়াও জীবনে তাঁরা দেখা দূরে থাক শোনেনওনি। শুধু তাই নয়, কয়েক বছর ধরেই হাওরে অকালবন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের পূর্বাভাস দেয়।

মনে পড়ছে বছর দু-এক আগে পটুয়াখালীর উপকূল এলাকায় কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ দিন দিনই বাড়ছে। আবহাওয়া দফতরের এক তথ্য থেকে জেনেছি, গত ৩০ বছরে প্রতি বছর ৩.৮ থেকে ৫.৮ মিলিমিটার করে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি বাড়ছে। সমুদ্রোপকূলে ১২.৩৪ থেকে ১৭.৯৫ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে পানির উচ্চতা বাড়ার কারণে। এ কারণে বাংলাদেশে ৫.৮ থেকে ৯.১ শতাংশ ধান উৎপাদন কমছে। নিঃসন্দেহে আমাদের কৃষিতে এটি মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব। বাংলাদেশের মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর আবাদি জমির ক্ষতি করেছে; যা প্রাণীর খাদ্য উৎপাদনে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলেছে। সমুদ্রের লোনা পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রবেশ করেছে; ফলে খাবার পানিসহ পশুখাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ১ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা আকস্মিক বন্যার শিকার হচ্ছে। সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী জেলাগুলো আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিপক্ব ফসল কর্তনের আগেই প্রতি বছর হাজার হাজার হেক্টর পাকা বোরো ধান আকস্মিক বন্যাকবলিত হয়। এতে কৃষক হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত। অতিবৃষ্টি, বন্যা ও পানিবদ্ধতা ক্রমাগত বাড়ছে। দেশের প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর জমি প্রতি বছর বন্যাকবলিত হয়।

গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেস্ক অনুযায়ী ১৯৯৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দুর্যোগে দক্ষিণ এশিয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের মুখোমুখি বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৬৪ শতাংশ দক্ষিণ এশিয়ায় বাস করে। বিশ্বব্যাংকের মতে জলবায়ু পরিবর্তন ২০৩০ সালের মধ্যে ৬২ মিলিয়ন দক্ষিণ এশীয়কে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এত বড় বিপর্যয়ের জন্য আমরা কীভাবে প্রস্তুত হচ্ছি?

গবেষণা বলছে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস মেনে কৃষি পরামর্শ সেবা বাস্তবায়নের মাধ্যমে শস্যের ফলন ৭ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। এ ছাড়া উৎপাদন খরচ প্রায় ১৫ শতাংশ কমিয়ে কৃষকের আয় ৩১ থেকে ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করা যাবে। বাংলাদেশের সব কৃষক এ পূর্বাভাস পেলে ফলন ৭ শতাংশ বাড়বে। এতে জাতীয় খাদ্যভান্ডারে দশমিক ১৭ মিলিয়ন টন ধান যোগ হবে। আবহাওয়া পূর্বাভাস ধান উৎপাদনব্যবস্থায় সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে ১ টাকা বিনিয়োগে ৫১ থেকে ৭৩ টাকা আয় করা সম্ভব হবে। এ সমস্যা আমরা খুব সহজেই উতরে যেতে পারি। সরকার প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার গড়ে তুলেছে। চাইলেই সেখান থেকে প্রতি সপ্তাহের কিংবা প্রতি মাসের সম্ভাব্য আবহাওয়া পূর্বাভাস জানিয়ে দেওয়া সম্ভব।

সাম্প্রতিক সময়ে একটা আলোচিত বিষয় হচ্ছে ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার। টেকসই কৃষি উৎপাদন ও ফসলের অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং গ্রিনহাউস গ্যাসগুলো হ্রাসকরণ বা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব প্রশমিত করে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করার সমন্বিত কৌশলই ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচারের তিনটি স্তম্ভ-

১. উৎপাদনশীলতা : পরিবেশের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেলেই টেকসইভাবে কৃষি উৎপাদনশীলতা এবং ফসল, পশুসম্পদ ও মাছ থেকে আয় বৃদ্ধি করা। এর ফলে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বাড়বে। ভূমি ও সম্পদের সীমিত ব্যবহারের মাধ্যমে এ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত করা এর অন্যতম লক্ষ্য।

২. অভিযোজন : ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচারের লক্ষ্য কৃষকের স্বল্পমেয়াদি ঝুঁকি কমানো, পাশাপাশি যে কোনো অভিঘাত ও দীর্ঘমেয়াদি চাপেও খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা।

৩. প্রশমন : যতটা সম্ভব গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে হবে। কার্বণ নিঃসরণ কমাতে হবে। পৃথিবী যার যার জায়গা থেকে সবুজ করে তুলতে ভূমিকা রাখতে হবে।

ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে। শুধু কৃষকই নই, সব শ্রেণি-পেশার নাগরিককে এ ব্যাপারে জানাতে হবে। তারা যেন যার যার অবস্থান থেকে পরিবেশ বিষয়ে সচেতন হয়। পরিবর্তিত জলবায়ুর কৃষি কেমন হবে, কোন কোন বিষয়ে কৃষককে সচেতন করতে হবে সেগুলোর নীতিমালা তৈরি করতে হবে। কৃষককে এখনই প্রস্তুত করতে হবে আগামীর কৃষির জন্য। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অংশীদারির ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ  জায়গা থেকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট সম্পর্কে কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। আগামীর কৃষির জন্য এখনই প্রস্তুত না হলে ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর