সোমবার, ৯ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

লাঠি এবং আমাদের জনপ্রতিনিধিরা

মহিউদ্দিন খান মোহন

লাঠি এবং আমাদের জনপ্রতিনিধিরা

একই দিনে দুজন জনপ্রতিনিধির মানুষ পেটানোর খবর বেরিয়েছে পত্রিকায়। দেশের দুই প্রান্তের এ দুই জনপ্রতিনিধির একজন বর্তমান, আরেকজন সাবেক। রাজনৈতিকভাবেও দুজন বিপরীত মেরুর। একজন আওয়ামী লীগের, অন্যজন বিএনপির। কিন্তু কর্মটি (অপকর্ম বলাই শ্রেয়) করেছেন একই ধরনের। এ দুই জনপ্রতিনিধির পরিচয় এখন আর জানতে কারও বাকি নেই। একজন কক্সবাজারের ‘স্বনামধন্য’ সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি, যিনি ইতোমধ্যে তার নামের সঙ্গে ‘মাদক সম্রাট’-এর তকমা লাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। অন্যজন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ২৪ এপ্রিলের পত্রিকায় এ দুই ‘কীর্তিমান’ রাজনীতিক খবরের শিরোনাম হয়েছেন। একজন স্বদলীয় নেতাকে পিটিয়ে, আরেকজন রাস্তায় এক নিরীহ ভ্যানচালককে বেত্রাঘাত করে দেশবাসীর মনোযোগ কেড়েছেন। দেশের দুই পর্যটন এলাকার দুই নেতার এ অপকীর্তির খবর এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।

খবরে যেটুকু জানা গেছে তা হলো- ২৩ এপ্রিল কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের ইফতারের আগে বর্ধিত সভা চলছিল। সভায় আবদুর রহমান বদি পৌর আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে ওয়ার্ড নেতাদের প্রাধান্য দেওয়ায় তার প্রতিবাদ করেন কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. ইউছুফ মনো। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বদি হলের বাইরে থেকে তার ক্যাডার বাহিনীর কয়েকজনকে ডেকে এনে বেদম মারধর করেন ইউছুফকে এবং নিজেও কিলঘুসি মারতে থাকেন। এতে বাধা দিতে গেলে হামলার শিকার হন পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ইউছুফ ভুট্টো, অ্যাডভোকেট মাহমুদুল হক ও জাহিদ হোসেন মুন্না।

অন্যদিকে রাস্তায় ভ্যান রাখার অপরাধে (?) সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী লাঠিপেটা করেন এক ভ্যানচালককে। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, ওইদিন দুপুরে মহানগরের চৌহাট্টায় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সামনে সিগারেট কোম্পানির ভ্যানচালক রুবেল তার গাড়ি থামিয়ে সিগারেট ডেলিভারি দিচ্ছিলেন। ওই সময় সেখান দিয়ে গাড়িবহর নিয়ে যাচ্ছিলেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। রাস্তার ওপর ভ্যান দেখতে পেয়ে তিনি চালক রুবেলকে ডেকে এনে গাড়িতে বসেই লাঠি দিয়ে তার হাতে আঘাত করেন। এ ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সিলেটের সর্বত্র নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ফেসবুকে নগরবাসীর অনেকে এ ঘৃণ্য কাজের জন্য মেয়র আরিফুল হকের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছেন। মহানগরের অভিভাবক হয়ে তিনি কী করে একজন দরিদ্র শ্রমজীবীর গায়ে হাত তুললেন, তা নিয়ে সমালোচনায় মুখর সচেতন নাগরিকরা। ঘটনার পর ফেসবুকে নানাজন নানা মন্তব্য করেছেন। ‘একজন নিপীড়ক মেয়র এবং আমাদের বিবেক’ শিরোনাম দিয়ে একজন লিখেছেন, ‘এ শহরের অনেক রিকশাচালক ও খেটে খাওয়া মানুষের পিঠে মেয়র আরিফের লাঠির আঘাতের অনেক দাগ খুঁজে পাওয়া যাবে’। আরেকজন সংবাদকর্মী লিখেছেন, ‘কারও গায়ে হাত তোলার অধিকার তাকে কে দিল? দেশে কি আইন নাই!’ আর একজন নাগরিক মন্তব্য করেছেন, ‘অসভ্য সমাজের অসভ্য মেয়র’। একজন ব্যক্তিবিশেষের অপকর্মের জন্য গোটা সমাজকে অসভ্য বলা কতটা সমীচীন তা ভেবে দেখার বিষয়। ব্যক্তিবিশেষের অপকর্মের জন্য গোটা সমাজ বা দেশকে গালি দেওয়া আরেকটি অপরাধ। ইদানীং এ প্রবণতা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছু হলেই একশ্রেণির উন্নাসিক বলে ওঠেন, এই ‘অসভ্য দেশে’ মানুষ থাকে নাকি? বলার আগে তারা চিন্তা করে দেখেন না, এ ক্ষেত্রে দেশের বা সমাজের কোনো দায় নেই। তারা হয়তো ভুলে যান, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশটা আমরা পেয়েছি। তাই বলার সময় দেশের প্রতি মমত্ববোধ বা সম্মানের বিষয়টি স্মরণে রাখা দরকার। মেয়র আরিফুল হক যা করেছেন তা যে কোনো বিচারে নিন্দনীয় এবং অমার্জনীয়। কেউ আইন ভঙ্গ করলে তাকে আইনে সোপর্দ করাই একজন সৎ নাগরিকের দায়িত্ব। অভিযুক্তকে স্বহস্তে শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার কারও নেই। আমাদের জাতীয় সংবিধান সে অধিকার কাউকে দেয়নি; মেয়র আরিফকেও নয়। ভ্যানচালক রুবেল যদি আইন ভেঙে থাকেন, তাহলে মেয়রের উচিত ছিল তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। তাকে স্বহস্তে প্রহার করে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে। একসময় আমরা একই রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলাম। সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানের অত্যন্ত স্নেহভাজন আরিফুল হকের প্রাপ্তি কম নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানির পরিচালক থেকে সিটি করপোরেশনের মেয়র পর্যন্ত হয়েছেন। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী তাঁর আমলে সিলেট মহানগরের উন্নয়ন করেছেন যথেষ্ট। সিলেটকে একটি সৌন্দর্যমন্ডিত আধুনিক নগর হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে জনসমর্থনও কুড়িয়েছেন বেশ। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অলক কুমার মিত্র ছিল জালালাবাদ গ্যাসের জেনারেল ম্যানেজার। সম্প্রতি অবসরে গেছে। তার মুখে শুনেছি আরিফুল হক চৌধুরীর অনেক কথা। ভালোমন্দ মিলিয়েই মানুষ। আরিফুল হক চৌধুরীরও হয়তো ভুলত্রুটি রয়েছে। তবে প্রকাশ্যে কারও সঙ্গে অভদ্র আচরণের কথা তেমন শোনা যায়নি। প্রতিপক্ষ দলের কারও সঙ্গে তেমন অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন এমন নজিরও কম। বরং সবার সঙ্গে ভদ্র আচরণই করতেন। সম্ভবত এ গুণের জন্যই আওয়ামী লীগের ভরা মৌসুমেও তিনি দুবার সিলেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ নগরের মেয়র নির্বাচিত হতে পেরেছেন জনগণের ভোটে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আগামীতেও তাঁর আবারও মেয়র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এমন কথা অনেকে বলেন। কিন্তু আমার মনে যে প্রশ্নটি খোঁচা দিচ্ছে তা হলো, সৌজন্যবোধসম্পন্ন আরিফুল হক কেন অমন অসহিষ্ণু হয়ে গেলেন? একজন দরিদ্র, নিরীহ ভ্যানচালকের গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করলেন না! তাহলে কি দলে বঞ্চনার শিকার হয়ে তিনি মানসিক পীড়নে ভুগছেন? যার প্রতিফলন ঘটেছে ওই ঘটনায়। তার তো মনে রাখা উচিত ছিল তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত। সে ভোট তিনি পেয়েছেন সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সবার। হয়তো গত নির্বাচনে ভ্যানচালক রুবেলের ভোটটিও তাঁর মার্কায়ই পড়েছে। ভোটের আগে হয়তো তিনি পরম মমতায় রুবেলের মাথায় হাত রেখে ভোট চেয়েছিলেন। আজ সে মমতার হাত পরিণত হয়েছে অন্যায়ের হাতিয়ারে; যে হাতের লাঠির আঘাত পড়েছে তার হাতের তালুতে ‘লঘু পাপে গুরুদন্ড’ হয়ে। এ কথা অনুমান করা যায়, রাস্তায় ভ্যানচালককে প্রহারের এই ভুলের খেসারত হয়তো মেয়র আরিফুল হককে ভালোভাবেই দিতে হবে আগামী নির্বাচনে। তবে সন্দেহ রয়েছে সে নির্বাচনে তিনি তাঁর দলের মনোনয়ন পান কি না। কেননা ইতোমধ্যে খবর বেরিয়েছে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেক নজরে নেই। যে জন্য তাঁকে দলে অনেকটা অবাঞ্ছিত হয়ে পড়তে হয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, গত বছর সিটি করপোরেশনের বাজেট পেশকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা সম্বোধন করার পরই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের গুডবুক থেকে তাঁর নাম কাটা গেছে। অনেক চেষ্টা-তদবির করেও তিনি সে নাম আর প্রতিস্থাপন করতে পারেননি। যে জন্য নানা কায়দায় তাঁকে দলে অনাহূত ব্যক্তিতে পরিণত করা হয়েছে।

আর কক্সবাজারের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি যা ঘটিয়েছেন, তাতে কেউই তেমন অবাক হয়েছেন বলে মনে হয় না। কেননা এ ধরনের ঘটনা তিনি আগেও ঘটিয়েছেন। তাঁর হাতে এলাকার অনেকের লাঞ্ছিত হওয়ার অনেক নজির আছে। বদিকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। যুবসমাজকে ধ্বংসের প্রধান অস্ত্র নেশার ট্যাবলেট ইয়াবা কারবারের সাম্রাজ্য গড়ে তিনি দেশব্যাপী ভালোই পরিচিতি পেয়েছেন। কক্সবাজার উপজেলার টেকনাফে রয়েছে তাঁর ইয়াবা কারবারের স্বর্গরাজ্য। আর সে রাজ্যের সম্রাট বদি। ইয়াবা কারবারে তিনি এতটাই পসার জমাতে সক্ষম হয়েছেন যে, তাঁর মাথায় শোভা পাচ্ছে ‘ইয়াবা সম্রাটে’র মুকুট। শুধু তাই নয়, এ অবৈধ কারবারে বদির ভাই-বেরাদর, আত্মীয়স্বজন, নিকটজনরাও জড়িত। তাঁদের দিয়েই প্রতিষ্ঠিত তাঁর সাম্রাজ্য। এহেন বৈশিষ্ট্যের একজন লোক যখন দেশের আইনসভার সদস্য মনোনীত ও নির্বাচিত হন, তখন সচেতন ব্যক্তিদের মনে রাজনীতি ও রাজনীতিকদের নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়। রাজনীতিক, এমপি, মন্ত্রী, নেতা এসব অভিধা আমাদের মতো আমজনতার কাছে অত্যন্ত সম্মানীয় ছিল সব সময়। আমরা যখন ছোট তখন একজন রাজনৈতিক নেতাকে সমাজে যে সম্মান পেতে দেখতাম, এখন তা বিরল ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আগে একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বা মেম্বারও মানুষের কাছে সম্মানীয় ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হতেন। মানুষ তাঁদের সম্মান জানাত তাঁদের চারিত্রিক গুণ ও ব্যবহার-আচারের জন্য। আর রাজনীতিকরা ছিলেন আরও সম্মানীয়। ‘লোকটা রাজনীতি করে’ বা ‘রাজনীতির সঙ্গে জড়িত’ কথাটি শুনলেই দেশ ও জনগণের জন্য আত্মস্বার্থত্যাগী একজন মহান ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠত। কিন্তু আজ দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিকদের চরিত্রেও বিরাট পরিবর্তন এসেছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা তাঁদের ‘চরিত্রগুণে’ রাজনীতিক থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে উঠতে পারছেন না। তাঁদের মধ্যে যাঁরা জনপ্রতিনিধি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন তাঁদের বেশির ভাগকে জনগণের নয়, নিজের ভাগ্য গড়ার ধান্দায় লিপ্ত হতে দেখায় যায়। বিত্তবৈভবে ফুলে-ফেঁপে ওঠার জন্য তাঁরা নীতি-নৈতিকতাকে ছুড়ে ফেলে দেন ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো। তাই তো পত্রিকায় মাঝেমধ্যেই এসব জনপ্রতিনিধি সম্পর্কে নানা রকম মুখরোচক খবর বেরোয়। কেউ টেন্ডারবাজির নেতৃত্ব দেন, কেউ হাটবাজার ইজারা কন্ট্রোল করেন, কেউ চোরাকারবার করে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে সেকেন্ড হোম গড়েন, আবার কেউ এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে গড়ে তোলেন ক্যাডার এবং কিলার বাহিনী। আসলে আমাদের ঐতিহ্যবাহী রাজনীতি আজ দৈন্যদশায় ভুগছে। আবদুর রহমান বদিদের মতো ব্যক্তিরা যখন দেশের আইনপ্রণেতা হন, তখন রাজনীতির হতচ্ছাড়া দশা প্রকট হয়ে ওঠে। সবচেয়ে অবাক কান্ড হলো, মাদক কারবারের বদনামের কারণে গত সংসদ নির্বাচনে বদিকে মনোনয়ন না দিয়ে তাঁর স্ত্রীকে সংসদ সদস্য বানানো হয়েছে। কেন? ওই এলাকায় কি কোনো সৎ, নিষ্ঠাবান আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন না, যাকে এমপি পদে প্রার্থী করা যায়? আসলে দুর্বৃত্তায়নের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে পড়েছে আমাদের রাজনীতি। আর তাই যাদের থাকার কথা গারদের ভিতর, তারা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সংসদ ভবনে বসে আইন প্রণয়নে ভূমিকা রেখে চলেছেন। রাজনীতির এ অধোগতির শেষ কোথায় আমরা কেউ জানি না।    

                লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর