রবিবার, ১৫ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

এম জে আকবরের মুখোমুখি নঈম নিজাম

এম জে আকবরের মুখোমুখি নঈম নিজাম

এম জে আকবর ও নঈম নিজাম

এম জে আকবর (জন্ম : ১১ জানুয়ারি ১৯৫১)। নামটাই যথেষ্ট এ উপমহাদেশের জন্য। তিনি রাজনীতিক। প্রখর ধীসম্পন্ন বিখ্যাত সাংবাদিক। সংবাদপত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। এখন সংসদ সদস্য-রাজ্যসভার সদস্য। গুরুত্বপূর্ণ অনেক পত্রিকায় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ সময়জুড়ে।  তাঁকে স্বাগত বাংলাদেশে। রাজনীতিতে অনেক বড় অবস্থানে ছিলেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম

 

নঈম নিজাম : আমি শুরুটা করতে চাই একদম ছোটবেলা দিয়ে। আপনার জন্ম হুগলিতে। এ অংশটা দিয়ে আমরা সামনে যাব।

এম জে আকবর : জন্ম আমার পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে একটা জুটমিলে। ভিক্টোরিয়া জুটমিল। তার সামনে আমার দাদাবাড়ি। যেখানে গ্রাম ছিল। সেটা বড় একটা ক্যানভাস। আমাদের গ্রাম থেকে দুই মাইল দূরে জুটমিল। ভিক্টোরিয়া জুটমিলে আমাদের গ্রামের কয়েকজন ওয়ার্কার ছিল। দাদার বয়স যখন ১০-১১ বছর তিনি ভিক্টোরিয়া জুটমিল খুঁজতে বের হন। জুটমিলে প্রথম শিফট শুরু হতো ৪টায়। তিনি পৌঁছলেন। জুটমিলের ওইখানে গিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। তখন সেখানে চায়ের দোকান ছিল। চায়ের দোকানের মালিক এলেন। দেখলেন একটা ফ্যামিস্ট ছেলে ওখানে পড়ে রয়েছে। তিনি তখন তাঁকে চা-বিস্কিট দিলেন। ওই জায়গায় তিনি পরিবার নিয়ে থাকতে শুরু করলেন। তিনি (দাদা) উদ্যোক্তা ছিলেন। দোকান করলেন। নানা কাজ করতেন। তবে তিনি নিজের ছেলেকে স্কুলে পাঠালেন। মানে আমার বাবাকে। তারপর আমার প্রথম জেনারেশন। চন্দনগরের মধ্যে ফ্রেঞ্চ কলোনিতে একটি ইংলিশ স্কুল ছিল- সেন্ট জোসেফ। আমরা প্রথম জেনারেশন ইংরেজি-মাধ্যমে সেখানে পড়লাম। তারপর বোর্ডিং স্কুলে। সেখান থেকে কলকাতা বয়েজ স্কুল। তারপর আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করি। সেখানে অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে ঢুকতে হতো। পাস করে গেলাম। ইংলিশ লিটারেচার পড়তাম।

 

নঈম নিজাম : আপনার ক্যারিয়ার কি সাংবাদিকতা দিয়ে শুরু?

এম জে আকবর : আমি লিখতে শুরু করি স্কুল থেকে। তখন কলকাতার সবচেয়ে ভালো কলেজ ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজ, সেখানে পড়াশোনা করেছি। আমি লেখা পাঠাই। লেখা ছাপা হলো। জানত না তখন লেখা কে পাঠিয়েছে। ওরা একটা কাগজ বের করেছিল। তার মধ্যেই লিখতাম। পকেটমানি ছিল কদাচিৎ। বাড়ি থেকে যা পেতাম অতটুকুই। তবে আমার মনে আছে লেখালেখি করে প্রথম যখন ৫০ টাকার একটা চেক পেলাম আমার বাবা বিশ্বাস করলেন না। কোনো দিনও তিনি ওই চেকটা ব্যাংকে দিলেন না। ১৯৬৬ সালে ৫০ টাকা অনেক টাকা। তিনি বলতেন আমি যদি কাউকে বলি যে আমার ছেলে ৫০ টাকার চেক পেয়েছে কেউ বিশ্বাস করবে না। এ জন্য চেকটা তিনি সঙ্গে রাখতেন। তবে স্নাতক ছাত্র থাকতেই আমি একটি বড় কোম্পানিতে চাকরি শুরু করি। আসলে এর আগেও আমি অন্য একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। আমার প্রথম কর্মস্থলে স্টার্টিং স্যালারি তখন ১৩৫০ টাকার মতো ছিল। আমি একটু পাগলও ছিলাম। ওই চাকরি ছেড়ে আমি টাইমস অব ইন্ডিয়ায় জয়েন করি। মাত্র ২৮০ টাকা মাইনেতে।

 

নঈম নিজাম : এটা কত সালে?

এম জে আকবর : ১৯৭১ সাল। বেতন ছিল মাত্র ২৮০ টাকা। চার বছর কলেজের পর স্ট্রাগল গেল। আমাদের দেশে খুব খারাপ একটা সময় ছিল। একটা নকশাল ভায়োলেন্স পুরো বেঙ্গল এবং বেঙ্গলের বাইরে চলছিল। আপনারা তখন এই বাংলাদেশে চমৎকার সাহস দেখিয়ে লড়াই করছিলেন।

 

নঈম নিজাম : তখন কমরেড চারু মজুমদারের অনুসারীরা দুই জায়গাতেই সক্রিয় ছিলেন।

এম জে আকবর : হুম। বাংলাদেশে তখন লিবারেশন দেখলাম আমরা। দূর থেকেই দেখেছি। সে সময় আমি টাইমস অব ইন্ডিয়ায় লিখতে আরম্ভ করেছি। জয়েন করেছি। তখন স্টোরি করেছিলাম। সে সময় থেকেই আমি পুরো বাংলাদেশের ইতিহাস দেখছি।

 

নঈম নিজাম : টাইমস অব ইন্ডিয়ার পরের কাগজ কোনটা?

এম জে আকবর : ইলাস্ট্রেটেড অব ইন্ডিয়ার এডিটর আমাকে বললেন তুমি আমার ম্যাগাজিনে কাজ কর। তুমি লিখতে জান। ওই ম্যাগাজিনে আমি এক-দুই বছরের মধ্যে ৩০-৪০টি কাভার স্টোরি করলাম। নামটাও একটু বিখ্যাত হলো। লোকজন চিনতে শুরু করল। সবচেয়ে বড় যে ব্রেকটা আমি পেলাম অভিক সরকারের কাছ থেকে আনন্দবাজারে। কথা ছিল একটা সানডে ম্যাগাজিন বের হবে। আমি বললাম ‘না’। আমি কাগজের সানডে ম্যাগাজিন করব না। আমি একটা ইনডিপেনডেন্ট পলিটিক্যাল পত্রিকা করব। যা হয় না ওই যে জাওয়ানির নেশা। হাঃ হাঃ হাঃ। আমাকে বোঝাল যে চাকরি পেয়ে গেছি- নিয়ে নাও। কিন্তু আমি বললাম, না, আমি স্বাধীনভাবে পত্রিকা করব। আর কলকাতা থেকে কোনো ইনডিপেনডেন্ট ম্যাগাজিন কখনো চলেনি। কিন্তু এই সানডেটা এক বছরের মধ্যে সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। কয়েক বছরের মধ্যেই ৪ লাখ কপি বিক্রি হতো সানডে। এটা ছিল একটা রেকর্ড।

 

নঈম নিজাম : আপনিই সম্পাদক ছিলেন সে সময়?

এম জে আকবর : আমিই ফাউন্ডার এডিটর সানডের। তবে সানডেটা সাকসেস হয়ে গেল। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কেননা ১৯৭৬-৭৭ সালে আমরা ইমারজেন্সি বের হলাম।

 

নঈম নিজাম : কত সালে আপনি প্রথম সম্পাদক হয়েছিলেন?

এম জে আকবর : আমি সম্পাদক হয়েছি তখন আমার বয়স ২৪ বছর।

 

নঈম নিজাম : ২৪ বছর বয়সে আপনি সম্পাদক হলেন। বিখ্যাত সানডে কাগজে। এটা আপনার হাত দিয়ে বিকশিত হয়ে বিখ্যাত হলো।

এম জে আকবর : তখন সানডেটা বিখ্যাত ছিল না। পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়। সানডে ছিল সবচেয়ে বড় পলিটিক্যাল ম্যাগাজিন। সমগ্র ইন্ডিয়ায় বিখ্যাত হয়েছিল। তখন জনতা পার্টি ছিল। সেটা বিট করতাম। সব বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ইন্টারভিউ সানডেতে ছাপা হতো।

 

নঈম নিজাম : পত্রিকার এডিটিং, রিপোর্টিং তো আপনি নিজেই করতেন?

এম জে আকবর : হ্যাঁ রিপোর্টিং এবং এডিটিং আমি নিজেই করতাম। আমার রিপোর্টগুলো নিয়ে একটা কালেকশন বের হয়েছিল ওই সময়।

 

নঈম নিজাম : সানডের পর কোথায় কাজ করলেন?

এম জে আকবর : একটা কথা বলি, সানডের জন্য বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ইন্টারভিউ আমি করেছিলাম। আমরা জার্নালিজম করেছি তার একটা ইমপেক্ট ছিল। তখন প্রিন্ট জার্নালিজম একটা মানে রাখত। তারপর তো সানডে থেকে ডেইলি কাগজে মুভ করলাম। ডেইলি কাগজে ইনভেস্টমেন্টসহ আরও অনেক কিছু লাগে। টেলিগ্রাফ ছিল আনন্দবাজারের একটা ফ্ল্যাগশিপ।

 

নঈম নিজাম : আপনি ফাউন্ডার এডিটর ছিলেন যখন টেলিগ্রাফের দায়িত্ব নিলেন? টেলিগ্রাফকেও আপনি খুব জনপ্রিয় কাগজে পরিণত করলেন।

এম জে আকবর : হয়তো জিওগ্রাফিক্যালি এটা রিচ না হলেও এটাই সত্য যে, এডিটোরিয়াল হিসেবে এটি ন্যাশনাল কাগজ। ওই সময় রাজীব গান্ধীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়।

 

নঈম নিজাম : এ বন্ধুত্ব কখন থেকে হলো?

এম জে আকবর : সানডে থেকেই আমার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে রাজীব গান্ধীর। আচ্ছা একটা বিষয় হলো ইমারজেন্সিতে যারা রিফরমেবল সে তো মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আর সোনিয়া গান্ধী। কিন্তু রাজীব গান্ধীকে কেন টার্গেট করা হলো? রাজীব গান্ধীর সঙ্গে সখ্য ছিল অনেক। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন আমাকে বারবার বলতে থাকেন যে রাজনীতিতে তোমাকে আসতে হবে। তত দিনে টেলিগ্রাফ আরম্ভ করেছি। রাজীব গান্ধীর কথা ফেলতে পারিনি।

 

নঈম নিজাম : ১৯৮৯ সালে এমপি হলেন কংগ্রেস থেকে?

এম জে আকবর : হ্যাঁ। সে সময় আমি এমপি হলাম। রাজীব গান্ধীর উৎসাহ পেয়ে। কিন্তু তা বেশি দিন চলল না। কারণ ১৯৯২ সালে যা কিছু হলো তা দেখে রাজনীতি ছেড়ে দিলাম। মেনে নিতে পারলাম না।

 

নঈম নিজাম : রাজীব এবং ইন্দিরা গান্ধী দুজনকে আপনার কাছ থেকে দেখা। দুজনকে নিয়ে মূল্যায়নটা কী আপনার?

এম জে আকবর : ইন্দিরা গান্ধী তো খুবই বড় রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী একটা পলিটিক্যাল ভিউ পলিটিক্যাল ফিলোসফিতে ব্যবহার শুরু করলেন। ইমারজেন্সি চলল। ইমারজেন্সির পর আমাদের কোনো প্রশ্নই ছিল না যে আমরা সেন্সরশিপ অ্যাকসেপ্ট করব।

 

নঈম নিজাম : তখন তো আপনি পত্রিকায় ছিলেন। সাংবাদিকতায় নানা নিষেধাজ্ঞা বা সেনসেটিভ ছিল কঠিনভাবে।

এম জে আকবর : আমার এখনো মনে আছে, তখন আমি ধারণা করেছিলাম ইন্দিরা গান্ধী ইলেকশনে হারবেন।

 

নঈম নিজাম : তিনি হেরেছিলেন। এমনকি কারাগারে যেতে হয়েছিল।

এম জে আকবর : এটাও সত্যি। ১৯৮০ সালে তিনি আবার ব্যাক করলেন। তখন মিসেস গান্ধী জিতলেন। ধারণাই করতে পারেননি অনেকে যে এত দ্রুত তিনি ফিরতে পারবেন। এ জন্য সবার সব সময় মনে রাখা উচিত কোনো কিছু ধারণা করে ফেলা এত সহজ নয়।

 

নঈম নিজাম : তার মানে আমরা জার্নালিস্টরা যেটা প্রেডিকশন করি সেটা সব সময় বাস্তবায়ন হয় না।

এম জে আকবর : এটা সবার স্বীকার করা উচিত। আমাদের হীনমন্যতা দূর করা উচিত।

 

নঈম নিজাম : ১৯৯৪ সালে আপনি রাজনীতি ছেড়ে আবারও মিডিয়ায় ব্যাক করলেন পুরোপুরিভাবে।

এম জে আকবর : তখন আমি এশিয়ান এজ-এ। এটা ভারতের প্রথম ইন্টারন্যাশনাল কাগজ। টেলিগ্রাফে আমি একটা জিনিস করেছিলাম; সেটা হলো প্রথম আমি কম্পিউটারাইজড কম্পোজ সিস্টেম চালু করি। তখন সেটা খুব কঠিন ছিল। আনন্দবাজারে স্ট্রাইকও হয়েছিল। সবাই নতুন প্রযুক্তিকে গ্রহণ করতে পারলেন না। কিন্তু একটা প্রযুক্তির ওপর ভরসা-বিশ্বাস ছিল না। যখন আমি প্রমাণ করে দেখালাম যে প্রযুক্তি আপনার সময় বাঁচাবে। কাজ সহজ করে দেবে। অনেক দিক থেকে সবাই উপকৃত হবে।

 

নঈম নিজাম : আপনার এশিয়ান এজ কাগজ লন্ডন এবং ভারতে একসঙ্গে প্রকাশ হতো। আপনি তো মালিকানায়ও ছিলেন।

এম জে আকবর : হ্যাঁ। আমার শেয়ার ছিল। আমার মেধা এখানে বিনিয়োগ হলো।

 

নঈম নিজাম : মেধার বিনিয়োগ একটা বড় বিনিয়োগ।

এম জে আকবর : অবশ্যই। মেধার বিনিয়োগ একটা বড় বিনিয়োগ। এরপর শেষে যা হয়, কোনো কিছুই তো চিরস্থায়ী নয়। বেরিয়ে গেলাম। এরপর জার্নালিজমে দুই বছর ইন্ডিয়া টুডেতে ছিলাম।

 

নঈম নিজাম : তখন কাগজের জনপ্রিয় ধারা ছিল। এরপর কী হলো?

এম জে আকবর : ইন্ডিয়া টুডের পর আরও অনেক কাজ করেছি। লেখালেখি করেছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আমার মনে হলো, এই লোকটি দেশের জন্য কিছু করতে পারেন। তাঁর প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। কিন্তু আমি যে ইভ্যুলেশন অব জার্নালিজম দেখছি। এই এত বছরের অভিজ্ঞতায়। আমি সত্যি বলি, আমার কোনো ইচ্ছা নেই। সবাই বলে, আমার সময়ে একটা গোল্ডেন এজ ছিল। আর এখন সবকিছুই খারাপ। এ ধারণা খুবই ভুল। এখন যে ইনোভেশন হচ্ছে বা ওটিটি প্ল্যাটফরম হচ্ছে আমার তো হিংসে হয়। কারণ আমাদের সময় এসব ছিল না। কিন্তু যখন আমরা এডিটর ছিলাম সত্তর কিংবা আশির দশকে অথবা নব্বই দশকে তখন একটা বিষয় ছিল সেটা হয়তো এখন এত নেই। আমার জ্ঞান অর্জনের ক্ষুধা ছিল। যেটা এখনকার জেনারেশনের মধ্যে অত নেই। আর যদি বলেন টেলিভিশন জার্নালিজমের প্রসঙ্গ। টেলিভিশন জার্নালিজম জনপ্রিয় হতে পারে কিন্তু সেখানে একটাই ডাইমেনশন দেখিয়ে চলে যাচ্ছে।

 

নঈম নিজাম : কোনো কিছুর গভীরতায় যেতে পারছে না? টিআরপি পিছনে দৌড়ানোর কারণেই কি এটা হচ্ছে?

এম জে আকবর : টিআরপি নিয়ে আমার কোনো প্রবলেম নেই। আমি সার্কুলেশনের জন্য অনেক কিছুই সেক্রিফাইস করে দেব। এখন যে কয়েকটি জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে তারা ওয়ার্ল্ড রেসলিং ফেডারেশনের মতো হয়ে গেছে। কুস্তি করা ছাড়া আর কিছুই করে না। এটা ঠিক হচ্ছে না।

 

নঈম নিজাম : সোশ্যাল মিডিয়ার একটা অবস্থান, টেলিভিশন মিডিয়ার একটা অবস্থান, আবার দেখা যাচ্ছে প্রিন্ট মিডিয়ার অবস্থান আগের চেয়ে স্লো হয়ে যাওয়া। সব মিলিয়ে আপনি প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যৎটা কী মনে করেন? অনেক কাগজ তো আপনার হাতে গড়া।

এম জে আকবর : প্রসেস অব কন্টেন্ট ইজ লেস ইন্টারেস্টিং টু মি দ্যান এনিথিং। প্রসেস অব কন্টেন্ট এক সময় প্রিন্টিং প্রেস ছিল। এক সময় রেডিও এলো। এরপর টেলিভিশন এলো। এখন ইন্টারনেট এসেছে। কোনো মিডিয়া তার আগের মিডিয়াকে পুরোপুরি রিপ্লেস করতে পারেনি। এখনো রেডিও আছে। কিন্তু কন্টেন্টের গভীরতা বা অ্যানালাইসিস নেই। অথচ এখন আগের চেয়ে কাজ করার স্কোপ বেশি। যেহেতু এখন ইন্টারনেট রয়েছে। আপনি যদি এটা দিয়ে ১৪০ ক্যারেক্টারে জার্নালিজম করতে চান এ ক্ষেত্রে জার্নালিজমটা পুরোপুরি ধ্বংস, পুরোপুরি নষ্ট। এখানেই আমার আপত্তি। এটাই আমার অবজারভেশন। এই যে একটা ক্লেভার অপিনিয়ন। কিন্তু সবাই চালাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে বড় যে দোষ এটা ডিপলি প্রবলেমেটিক। এটা কত দিন অ্যাকসেপ্ট হবে কি হবে না আমি জানি না। কিন্তু এটা অ্যাকসেপ্ট করা উচিত নয়। কন্টেন্ট উইদাউট এডিটিং চলছে। যার যা খুশি করছে। এখন কন্টেন্ট উইদাউট কাউন্টিবিলিটি। কন্টেন্ট উইদাউট কন্টিবিলিটি টু ল। চারপাশ দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিজ। তারা পুরো এ কমিউনিকেশন ওয়ার্ল্ডের ওপর নির্ভরশীল। এখন যে কানুন তা প্রাইভেট কো-অপারেশন্স। দ্য আর ইমপোর্টেট। নট পার্লামেন্ট, নট সোশ্যাল ল, নট গভর্নমেন্ট। পুরো ওয়ার্ল্ড কমিউনিকেশনটা এখন পাঁচটি বা ছয়টি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির হাতে। যারা নিজের প্রফিট ছাড়া কিছু বোঝে না। ওরা আর কিছুই দেখে না। আমরা তো এখন দেখছি কয়েকটি দেশের জেনারেল ইলেকশনে। আমরা দেখছি সুপার পাওয়ারের ওপর ওদের কত প্রভাব।

 

নঈম নিজাম : আমেরিকার মতো দেশেও ওরা প্রভাব খাটাচ্ছে আর আমাদের এ ভূখন্ড তো আছেই। এটা এক হুমকি কি না?

এম জে আকবর : আমি সেটা জানি না। ওরা তো আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কী বলা উচিত? বলা উচিত না। ওরা তো আপনাকে ক্যানসেল করে দেবে। যদি আপনি একটা বক্তৃতা দিতে যান। আমি সায়েন্টিস্ট নই। কিন্তু আমি জার্নালিস্ট হিসেবে এটা জানি এরা তো একটা নতুন রকমের প্রাইভেট সেক্টর সেনসেশন। এর ড্যামেজ আসলে কত হবে এটা দেখা উচিত।

 

নঈম নিজাম : আপনি কি মনে করেন গুজব ছড়ানোর জন্য একটা বড় ভূমিকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই? যা সমাজকে ক্ষতি করছে। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরি করছে। এর থেকে উত্তরণের পথটা কী?

এম জে আকবর : অ্যাবসলিউটলি। গুজব অ্যালিগেশন যা ইচ্ছা। আমি বলব সোশ্যাল হার্মিংয়ের ওপর একটা জায়গা তৈরি হচ্ছে। দ্যাট কেন বি ভেরি ডেঞ্জারাস। কেননা এসব আউট অব কন্ট্রোল। কোনো জুডিশিয়ারি এটা কন্ট্রোল করতে পারছে না। গভর্নমেন্ট এটা কন্ট্রোল করতে পারছে না। সমাজ এটা কন্ট্রোল করতে পারছে না।

 

নঈম নিজাম : বাংলাদেশ, ভারত কিংবা এ উপমহাদেশে পরিবর্তন কিছু হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়? নাকি ডে বাই ডে আগের জায়গায় ফিরছে। আপনার সময়ের জার্নালিজম আর এখনকার জার্নালিজম আপনি কীভাবে দেখেন বা মূল্যায়ন করেন?

এম জে আকবর : এভরি এরা ফাইন্ড ইট অন চ্যালেঞ্জ। আর প্রত্যেকের জার্নালিজম যদি লেটেস্ট টেকনোলজি সেটা অলওয়েজ প্রোগ্রেস। সেটা মানতে হবে। কিন্তু প্রোগ্রেসটা কোনো ডিরেকশনে যাচ্ছে সেটাও একটু দেখা প্রয়োজন। ভাবা উচিত। যেমন আগে আমরা খুব সুন্দর কাবাব খেতাম। প্রোগ্রেসের মানে কি আমি আমাদের হামবার্গার খেতে হবে। হাঃ হাঃ হাঃ। কমিউনিকেশন প্লেসে এটা কি ভালো! ইনফরমেশন কেন নট বিকাম থার্স্টি। চট করে দাও। একজন ভালো শেফ কিন্তু সময় নিয়ে রান্না করে।

 

নঈম নিজাম : নতুন প্রজন্মের সংবাদকর্মীদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

এম জে আকবর : নতুন প্রজন্মের জন্য পরামর্শ হলো- একটা জিনিস সেটা সাংবাদিক হোক কিংবা রাজনীতি- যেদিন আপনার ইন্টিগ্রেটি কম্প্রোমাইজ করতে হবে সেদিন জার্নালিজম থাকবে না। আমি বলছি না যে ভুল হবে না। ভুল হবে। কিন্তু ভুলটা অনেস্টলি হতে হবে। পয়সা দিয়ে ইনফরমেশন বিতরণ করা সেটা হবে না। কখনো হাওয়া আসবে, কখনো তুফান আসবে, কখনো ঝড় হবে, কখনো বৃষ্টি হবে কিন্তু আমাদের ইমানটা অর্থাৎ ইন্টিগ্রেটিটা ঠিক থাকলে বাকি সবই হবে।

 

নঈম নিজাম : রাজনীতি করলেন। সংবাদপত্রে কিংবদন্তিতুল্য অবস্থানে ছিলেন। লেখালেখি করেন নিয়মিত। বইও লিখেছেন। কোথায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। নাকি সব আলাদা আলাদা?

এম জে আকবর : সবাই আমার ছেলে। কোন ছেলেকে বেশি ভালোবাসি। সবাইকে ভালোবাসি। যদি আমি ভালো না বাসতাম তবে তো আমি যেতামই না। সে পথে হাঁটতামই না। তবে পাবলিক মনে করে এ লাইফ খুব গ্ল্যামারাস। আসলে গ্ল্যামারাস না। খুবই টাফ লাইফ। কিন্তু যে প্রাইস অনেক সময় এমন লাইফে পে করতে হয় এটা ভেরি ভেরি হার্ড। যদি আপনি পরিবর্তন চান, যদি আপনি চেঞ্জের দিকে চেষ্টা করেন লটস অব প্রোসেস দেয়ার টু ড্রিম বিকাম ট্রু। সবকিছুর সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় কিন্তু কপালের সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় না। হাঃ হাঃ হাঃ।

হ্যাঁ, একটা কথা বলতে পারি যে স্যাটিসফেকশন বই লেখার মধ্যে রয়েছে। যেটা আমি পারসোনালি অন্য কোথাও পাই না। শেষ তিন বছরে আমার দুটি বই বেরিয়েছে। প্রথমটা হলো Gandhi's Hinduism the Struggle against Jinnah's Islam পুরো কাহিনিটা ১৯৪০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত সাত বছরের যে পরিবর্তনটা তার ইমপেক্ট এখনো চলছে আর কত বছর চলবে আমি জানি না। কিন্তু ওই যে সাত বছরের কাহিনি যেগুলো জনসম্মুখে আসেনি সেটা রিভিল করার চেষ্টা করেছি বলে মনে করি। এর পরের বইটা Doolally Sahib and the Black Zamindar: Racism and Revenge in the British Raj-এটা হলো ইংরেজদের সঙ্গে জমিদারদের যে সম্পর্কটা সেটা তুলে নিয়ে এসেছি। নতুন ক্লাস অব জমিদার তৈরি করেছিল তারা।

 

নঈম নিজাম : তারা (ইংরেজরা) একটা শ্রেণি তৈরি করল যাদের সহায়তায় তারা শাসনটা করত। খাজনা তুলত। নতুন সিস্টেম ক্রিয়েট করল। এ বইটাতে আপনি কী নিয়ে এলেন?

এম জে আকবর : আমি নিয়ে এলাম যাকে বলে গোবিগ্রামের ছুরি। ওই ছুরি নিয়ে এ পলিটিকস করত। ইংরেজরা যা ইতিহাস লিখেছে সাম্রাজ্য সম্পর্কে ওর মধ্যে তো এসব চর্চা এখনো করছে ওরা। আমার একটা বিষয়- মাঝেমধ্যে খুব রাগ হয় আমাদের ভারতের ইতিহাসবিদরা এটা তুলে আনেননি। যেমন ব্রিটিশরা যে যাকে আমি বলি জেনোসাইড বাই প্যানিক। ১৭৬৫ সালে আসার পরে পুরো বেঙ্গলটা রুল করা শুরু করল।

 

নঈম নিজাম : যাত্রাটা শুরু করেছিল মুর্শিদাবাদ থেকে।

এম জে আকবর : হুম মুর্শিদাবাদ থেকে যাত্রাটা শুরু হয়। পরে পুরো কন্ট্রোল অব বেঙ্গল শুরু হয় ১৭৬৫ থেকে। বাংলাটা তারা দখল করে ফেলে মাত্র চার বছরের মধ্যে। আগে যারা রাজা ছিল, মহারাজা ছিল তারা ট্যাক্স দিত। এই ইংরেজরা আপনি বিশ্বাস করবেন না যে ১৭৭০-এ যে প্যানিক ছিল তার মধ্যে অ্যাকর্ডিং টু ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি একজন চিঠি লিখেছে। ওয়ান অব দ্য বোর্ড ডিরেক্টর। সে বলছে বিটউইন ওয়ান থার্ড অ্যান্ড ওয়ার হাফ বেঙ্গল পপুলেশন হেজ স্টার্ফ টু ডেথ। আপনি ভাবতে পারেন! চারদিকে দুর্ভিক্ষ। চারদিকে ক্ষুধার্ত মানুষ। হাফ অব দ্য পপুলেশন না খেয়ে থাকছে! তিনি নিজেই বলছেন এ কথা। আর তারপর বলছেন আমি ভায়োলেন্স বন্ধ করতে রেভিনিউ বাড়িয়েছি। ব্রিটিশরা যে শেষে ১৯৪৩-তে ওই কাহিনিটা পুরোপুরি প্রকাশ করা উচিত ছিল।

 

নঈম নিজাম : এটা হলো না কেন? আমাদের ইতিহাসবিদরা সেটা পারলেন না কেন?

এম জে আকবর : আমি এটা বলতে চাই না। আমি চাইলে অনেক রিজন দিতে পারি কিন্তু আমি দিতে চাই না। কিন্তু ওই দু-তিনটে বই। অমর্ত্য সেন তো একটা বই করেছেন। যেটা পপুলার। এ নিয়ে কিছু কাহিনি আছে, গান আছে। সত্যজিৎ রায় এটা নিয়ে একটা ফিল্মও করলেন। কিন্তু যে লেভেলের কাজটা করা উচিত ছিল তা কিন্তু হয়নি। আর ফরচুনেটলি সেটা হয়নি। এখন আর রিগ্রেট করে কোনো লাভ নেই। আমি যা করতে পারি আমি করেছি। এই যে আসলে সত্যি যে কী ছিল হোয়াট ওয়াজ দ্য রিয়েল ট্রুথ-রেসিজম বেড়েছিল। আর যারা ওরা বলে রেল বানিয়েছে, রোড বানিয়েছে সেটা ছিল মেন্টাল স্ট্র্যাটেজি এক প্রকার। ওরা তো কখনই বলেনি যে দ্য আর কাম টু ইন্ডিয়া টু সেভ ইন্ডিয়া। ওরা তো আসলে ব্যবসা করতে এসেছে। ব্যবসা করতে করতে রুল করেছিল বা ব্যবসা থেকে রুলে গেল।

 

নঈম নিজাম : একদম শেষ পর্যায়ে আমি যেটা বলতে চাই এ উপমহাদেশে আগামীতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কটুকু কেমন মনে হয় বা কেমন হওয়া দরকার? ওয়ার্ল্ড পলিটিকস বা আদার্স হিসাব-নিকাশ কী বলছে?

এম জে আকবর : দেখুন, বাংলাদেশ এবং আমার দেশ ভারতের বন্ধুত্ব ইন সাসটেইনেবল। ক্রেডিবল। কেননা ইট ইজ বিল্ট অন শেপ ভ্যালু। এ ভ্যালুজ মানে আমার ডেমোক্র্যাসি। এ ডেমোক্র্যাসি উইক হলে এ রিলেশনশিপটাও ভ্যারি করবে। শেপ ভ্যালুজ ডেমোক্র্যাসি মডার্নিটি প্রোগ্রেসিভ সবকিছুই অল ফিলস অব ফ্রিডম। এটা ফাউন্ডামেন্টাল... আমি তো অনেক ওয়ার্ড ভুলি। এই যে একটা ধারণা হয়ে গেছে কোনো একটা বড় দেশ কোনো একটা ছোট দেশ। এটা একটা অবজারভেশন। আদতে কোনো দেশ যেমন বড় হয় না, তেমনি কোনো দেশ ছোট হতেও পারে না। এখানে সবাই সমান। থিংস আর ইক্যুয়াল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড অব ইক্যুয়ালিটি। আপনি যদি দেখেন আসলে ছোট আর বড় মানেটা কী! আলেকজান্ডার যখন বের হলেন মেসিডোনিয়া কত বড় ছিল? এরপর কত দূরে চলে গেল। সাম্রাজ্য বৃদ্ধি পেল। এদিকে পুরো ব্রিটিশ এম্পায়ারটা আফ্রিকা থেকে এশিয়া। আমেরিকা পর্যন্ত। সাম্রাজ্য করে নিল। আদতে ছোট-বড় কোনো অর্থ নেই। আমাদের বাংলা ছিল ধনী আর সবার মধ্যে এ উপমহাদেশে। এ জন্যই পুরো ইউরোপ এখানে এলো। তারা আমাদের চেহারা দেখতে আসেনি। এখানে প্রশ্ন আসে কেন? কেননা বিকজ অব দ্য ম্যানুফ্যাকচারিং স্কিল। আপনি কি জানেন নেপোলিয়নের ওয়াইফ ইউজ টু রাভ বেঙ্গলের সিল্ক। পুরো ইউরোপ বেঙ্গলের সম্পদের প্রতি আগ্রহী ছিল। দ্য হেড টু ডেস্ট্রয়েড।

 

নঈম নিজাম : ঢাকার মসলিন একসময় পৃথিবী বিখ্যাত ছিল। মুঘলরা ঢাকা থেকে মসলিন সংগ্রহ করত।

এম জে আকবর : এ মসলিন নিয়ে একটা কাহিনি আছে যে আওরঙ্গজেবের মেয়ে আট লেয়ারের স্কার্ট পরেছে। স্কার্ট মানে কুর্তা পরেছে। তার পরও বাবার আপত্তি। হাঃ হাঃ আর ইউরোপে তো এটা আইকন।  তাহলে ওদের ইন্ডাস্ট্রিটা বিল্ড হতো না এটা যদি থাকত।

 

নঈম নিজাম : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার বক্তব্য থেকে আগামী প্রজন্ম অনেক বেশি জানতে পারবে।  অনেক বেশি শিখবে এবং একটা গাইডলাইন পাবে।

এম জে আকবর : ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার : ২৬ মার্চ ২০২২, হোটেল ওয়েস্টিন, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর