রবিবার, ১৫ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ঘৃণ্য অপরাধ

যুবায়ের আহমাদ

কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ঘৃণ্য অপরাধ

ব্যবসা পারস্পরিক চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের মহান উদ্যোগ এবং জীবিকা উপার্জনের উত্তম মাধ্যম। ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয় শুধু বৈষয়িক মুনাফা লাভের সুযোগই নয়; বরং তা ইবাদতও। কিন্তু সততা না থাকলে তা ইবাদত তো হবেই না, থাকবে না ব্যবসা গন্ডির মধ্যেও; পরিণত হবে প্রতারণায়। ইদানীং প্রায়ই গণমাধ্যমের খবরে দেখা যাচ্ছে, বেশি ‘লাভ’ করার আশায় নিত্যপণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণি। পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি ইসলামে ঘৃণ্য অপরাধ। যারা নিত্যপণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করবে রসুলুল্লাহ (সা.) তাদের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন বারবার। মজুদদারদের প্রতি আল্লাহতায়ালাও ক্ষুব্ধ হন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন খাদ্য মজুদ রাখল সে আল্লাহ থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল, আল্লাহও নিঃসম্পর্ক হয়ে গেলেন তার থেকে।’ মুসনাদে আহমাদ। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি (কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর জন্য) ৪০ দিন পর্যন্ত কোনো জিনিস গুদামজাত করে রাখবে, তার এত মারাত্মক গুনাহ হবে যে এই সমুদয় সম্পদ দান করে দিলেও তার গুনাহ মাফের জন্য যথেষ্ট হবে না।’ মিশকাত।

মজুদদারির মাধ্যমে কোটিপতি হলেও তার ওপর গজব ও দারিদ্র্য অবধারিত হবে। উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেউ যদি খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম উপায়ে সংকট তৈরি করে আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেবেন। ইবনে মাজা। পক্ষান্তরে যারা মজুদদারি না করে স্বাভাবিকভাবে মুনাফা অর্জন করতে চান আল্লাহ তাদের ব্যবসায় বরকতের দরজা খুলে দেন। তাকে অপ্রত্যাশিত রিজিক প্রদান করেন। উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অবাধ ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় আর পণ্য মজুদকারী অভিশপ্ত হয়।’ ইবনে মাজা।

মজুদদারি করে হারাম পথে বেশি উপার্জন করে লাভ কী? উপার্জন হারাম হওয়ার কারণে তার নামাজ, রোজা, হজ, দান-সদকা কিছুই কবুল হবে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি অবৈধভাবে সম্পদ সঞ্চয় করে এরপর তা দান করবে, সে এই দানের জন্য কোনো প্রতিদান পাবে না এবং তাতে পাপ ভোগ করতে হবে। ইবনু হিব্বান। পক্ষান্তরে হারাম পথ অবলম্বন না করে হালাল উপার্জন থেকে অল্প দান করলেও আল্লাহর কাছে এর মর্যাদা অনেক বেশি। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ দান করবে (আল্লাহর কাছে তা এতই প্রিয় হবে যে) আল্লাহ একে তার কুদরতি ডান হাতে কবুল করবেন। এরপর একে দাতার জন্য তোমাদের কারও অশ্বশাবককে প্রতিপালন করার মতো করবেন এবং প্রতিপালন করতে করতে পাহাড় পরিমাণ কড় করবেন (পাহাড় পরিমাণ দানের সওয়াব দান করবেন)।’ বুখারি। ‘আরো চাই’ প্রবণতা মানুষকে চরম সংকটে ফেলে দেয়; হাজার কোটি টাকা থাকলেও তার অভাব শুধু বাড়তেই থাকে। তাই প্রাচুর্যের চাহিদার লাগামকে টেনে ধরার নির্দেশ দিয়ে পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। এমনকি তোমরা কবরে পৌঁছে যাবে।’ (সুরা তাকাসুর : ১-২)। হালাল-হারামের বিবেচনা না করে যে ব্যক্তি শুধু স্পদ উপার্জন করতে চাইবে, তার জীবন অশান্তিময় হয়ে যাবে। জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির উদ্দেশ্য হবে কেবল দুনিয়া অর্জন, আল্লাহ তার কাজকে এলোমেলো বিক্ষিপ্ত করে দেবেন। পেরেশানি সৃষ্টি করে দেবেন। সম্পদের পাহাড় থাকলেও তার দুই চোখের সামনে দারিদ্র্য এনে দেবেন (আরও চাই আরও চাই প্রবণতা তাকে পাগল করে তুলবে)। অথচ পার্থিব সম্পদ সে ততটাই লাভ করতে পারবে, যতটা আল্লাহ তার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। আর যার উদ্দেশ্য হবে আখিরাত আল্লাহ তার সবকিছুকে পরিপাটি গোছালো করে করে দেবেন। তার জীবন সুশৃঙ্খল হয়ে ওঠবে। তার অন্তরে মুখাপেক্ষীহীনতা ঢেলে দেবেন। দুনিয়া বিনাশ্রমে তার কাছে আসবে।’ ইবনে মাজা।

আর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যবসায় সব ধরনের প্রতারণা মজুদদারি, মুনাফাখোরি বাদ দিলে ব্যবসায়ীর ব্যবসা হবে ইবাদত, তার উপার্জন হালাল হওয়ায় নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত সব ইবাদত কবুল হবে (ইনশা আল্লাহ), হাশরের ময়দানে আল্লাহ এ ব্যবসায়ীকে পুরস্কৃত করবেন। আবু সায়ীদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীরা হাশরে নবীগণ, সিদ্দিকগণ ও শহীদগণের সঙ্গে হাশর হবে।’  তিরমিজি। একজন ব্যবসায়ীর জন্য এর চেয়ে আশার বাণী আর কী হতে পারে যে তিনি হাশরের ময়দানে নবী-রসুল ও শহীদদের সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবেন!

লেখক : খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ ও পরিচালক, বাইতুল হিকমাহ একাডেমি, গাজীপুর।

সর্বশেষ খবর