মঙ্গলবার, ১৭ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

সব ক্ষেত্রে রসুলকে অনুসরণ করতে হবে

এম এ মান্নান

সব ক্ষেত্রে রসুলকে অনুসরণ করতে হবে

রসুল (সা.) সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দিয়েছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আপনি নীতি-নৈতিকতা ও উত্তম চরিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠিত।’ (সুরা আল কালাম, আয়াত ৪) ‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রসুলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সুরা আহজাব, আয়াত ২১) রসুল (সা.) ছিলেন সেরা মানব এবং সেরা ও শেষ নবী। তাঁর জীবনাদর্শই মানুষকে দুনিয়া এবং আখিরাতের শান্তি ও মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে। রসুলের মাক্কিজীবন, মাদানিজীবন সবই উম্মতের জন্য অনুসরণীয়। এ দুই জীবনের মধ্যে অন্যতম পার্থক্য হলো মক্কায় জন্মস্থান হলেও রসুল (সা.) এবং মুসলমানরা সেখানে ছিলেন প্রতিকূল অবস্থায়। তাঁরা ছিলেন মুশরিকদের দ্বারা নির্যাতিত। পক্ষান্তরে মাদানিজীবনের প্রথম থেকেই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। মদিনায় রসুল (সা.) মর্যাদার দিক থেকে ছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান, মদিনার সবার ওপরে ছিল তাঁর স্থান। মদিনার জীবনে একদিকে রসুলের সঙ্গে ছিলেন জীবন উৎসর্গকারী মুহাজির সাহাবির একটি দল আর তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন অসাধারণ ত্যাগ ও ভ্রাতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী আনসার সাহাবির আরও একটি দল। আর এ দুই দলের পারস্পরিক অসাধারণ আত্মত্যাগ এবং অনুপম আদর্শে মাদানি জীবনের শুরু থেকেই পরিবেশটা ছিল মুসলমানদের অনুকূলে। মদিনার নাগরিক সমাজের সব অংশ রসুল (সা.)-এর নেতৃত্বে আস্থা রাখে। ইসলাম গ্রহণকারীরা তো বটেই, অন্যান্য সম্প্রদায় এমনকি ইহুদিরাও প্রথম দিকে রসুল (সা.)-কে স্বাগত জানায়। মদিনা রাষ্ট্রের ঐক্য এবং নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার করে। তবে তারা তাদের মোনাফেকি চরিত্রের জন্য রসুল (সা.)-কে দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকতে পারেনি। রসুল (সা.) ও তাঁর সাহাবিদের বিপদে ঠেলে দেওয়ার ক্ষেত্রে ইহুদিদের হঠকারিতা ও বিরোধিতা কম ছিল না।

রসুল (সা.)-এর জন্য মুহাজির ও আনসার সাহাবিদের অসাধারণ আত্মত্যাগের কোনো তুলনা নেই। রসুলে কারিম (সা.) মদিনায় হিজরতের লক্ষ্যে যখন গারে সাওয়ে পৌঁছলেন তখন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বললেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! এ গুহায় প্রথমে আমি অবতরণ করব যাতে কোনো ক্ষতিকর কিছু থাকলে আমার কিছু হলেও আপনার কিছু না হয়। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) আগে গুহায় নেমে সুন্দরভাবে পরিষ্কার করার পর রসুলে কারিম (সা.) গুহায় অবতরণ করেন। গুহার মধ্যে যতগুলো ছিদ্র ছিল সব সঙ্গে থাকা একটি কাপড় টুকরা টুকরা করে বন্ধ করা হয়। কিন্তু একটি ছিদ্র বন্ধ করতে না পেরে নিজের পা দিয়ে ছিদ্রের মুখ বন্ধ করে রাখলেন। তখন ওই গর্তে থাকা সাপ হজরত আবু বকরের পায়ে দংশন করলেও তিনি কষ্ট সহ্য করেন। ওই সময় কষ্টে চোখ দিয়ে পানি ঝরতে শুরু হলে রসুলে কারিম (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, আবু বকর তোমার কী হয়েছে? আবু বকর (রা.) বললেন, আমাকে সাপে দংশন করেছে। তখন রসুল (সা.) নিজের মুখের লালা ওই দংশিত স্থানে লাগিয়ে দিলে ব্যথার উপশম হয়। অনুরূপভাবে রসুল (সা.) মদিনায় পৌঁছে যখন হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাড়িতে অবস্থান করেন। একদিন রাতে ওপরের তলায় পানি পড়ে গিয়েছিল। রসুলে কারিম (সা.) তখন লোকজনের সাক্ষাতের সুবিধার্থে নিচে ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) শীতের রাতে গায়ের কম্বল দিয়ে ওই পানি পরিষ্কার করেন এবং কম্বল ছাড়াই রাত কাটান। তবু তিনি রসুলের গায়ে এক ফোঁটা পানি পড়ুক তা চাননি। সাহাবায়ে কিরামদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের দৃষ্টান্তও ছিল উল্লেখযোগ্য।

আনসারি সাহাবি সাদ ইবনে রবি (রা.) মুহাজির সাহাবি হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তাঁকে বললেন, আপনি আমার অর্ধেক সম্পদ গ্রহণ করুন এবং আমার দুজন স্ত্রী আছে, আপনার পছন্দ অনুযায়ী একজনকে আমি তালাক দিয়ে দেব। আপনি ইদ্দত শেষে তাকে বিয়ে করে নেবেন। হজরতের সাহাবায়ে কিরাম রসুলে কারিম (সা.)-এর জন্য যেসব আত্মত্যাগ করেছেন সেসব ঘটনার মধ্যে এগুলো একেবারেই ছোট ঘটনা। রসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার কারণেই সাহাবায়ে কিরামরা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগে প্রস্তুত থাকতেন। আত্মত্যাগের ক্ষেত্রে মক্কা কিংবা মদিনার সাহাবিদের কাউকে এগিয়ে রাখা কিংবা পৃথক করার সুযোগ নেই। মক্কায় ইসলাম গ্রহণের জন্য মুশরিকদের নির্মম অত্যাচারের শিকার হওয়ার পরও কেউ আপস করেননি। মুশরিকদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে সাহাবির একাংশ আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে বাধ্য হয়। রসুল (সা.)-এর নির্দেশেই তারা হিজরত করেন। এটি ছিল ইসলামের জন্য সাহাবিদের আত্মত্যাগ।

মাক্কিজীবনে হোক আর মাদানিজীবনেই হোক সাহাবায়ে কিরাম রসুলের জন্য যেভাবে জীবন উৎসর্গ করেছেন, রসুলের অনুসরণ করেছেন আমাদেরও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁকে সেভাবে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে হবে। সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের ঘরবাড়ি পরিবার-পরিজন আত্মীয়স্বজন ক্ষেত্রবিশেষ সব পরিহার করেছেন। কিন্তু রসুলের আদর্শ, ভালোবাসা, রসুলের সঙ্গ ছাড়েননি। সুতরাং আমাদেরও যত কষ্ট করতে হয় করতে হবে। যত ত্যাগ শিকার করতে হয় করতে হবে। যতটা বিসর্জন দিতে হয় দিতে হবে, এর পরও রসুলের সুমহান আদর্শ থেকে সরে যাওয়া যাবে না। মুসলমানদের কাছে রসুল (সা.)-কে অনুসরণের মতো সৌভাগ্য আর কিছুতে নেই। দুনিয়ার জীবনে শুধু নয়, আখিরাতের জীবনের ফায়দার জন্য সব ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রিয় হাবিবকে অনুসরণ কর্তব্য বলে ভাবতে হবে।

                লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর