বুধবার, ১৮ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

বাঙালির বাঁশবাৎসল্য

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

বাঙালির বাঁশবাৎসল্য

বাঙালির বাঁশবিষয়ক বন্ধন, বাৎসল্য বা বন্ধুত্ব বোধকরি বাল্যবেলায় রোপিত। বাল্যকালেও শুনেছি দাইমা নামে পরিচিত গ্রাম্য ধাত্রীরা বাঁশের কঞ্চি বা ধারালো ফলা দিয়ে সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানের নাড়ি কাটতেন। বাঁশের দোলনায় ঘুম পাড়ানো হতো ছোট শিশুদের। হাজম নামের গ্রাম্য ডাক্তাররাও বাঁশের কঞ্চি বা ধারালো ফলা দিয়ে ছোট ছেলেদের মুসলমানি বা খতনা সম্পন্ন করতেন। তাঁদের দেখে পাড়াসুদ্ধ দুষ্ট ছেলের দল ভয়ে বাঁশবাগানে পালিয়ে যেত। পালানোর অপরাধে ধরে এনে আবার বাঁশের কঞ্চি দিয়েই বেত্রাঘাত করা হতো এই দুষ্ট ছেলেদের। বাঁশের সাঁকো পার হয়ে স্কুলে যাওয়া, বর্ষায় বাঁশের সাঁকো থেকে খালে ঝাঁপ দেওয়া কিংবা খালপাড়ে বসে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো ছিপ দিয়ে মাছ ধরার স্মৃতি এখনো অনেকের মনে উজ্জ্বল। বাঁশের সঙ্গে জাল লাগিয়ে মাছ ধরা, বাঁশের ডুলিতে মাছ জমানো- তা-ও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। বাঁশের ঘরে কেটেছে অনেকের শৈশব। তাই বাঁশের সঙ্গে বন্ধুত্ব বা বাৎসল্যের বন্ধন বাল্যবেলায় রোপিত হওয়া বিচিত্র বটে, তবে বাস্তব।

বাঁশ থেকেই একসময় এই বাংলার রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী নদীর তীরে কর্ণফুলী পেপার মিলসে বিপুল কাগজ ও কাগজ তৈরির মন্ড উৎপাদন হতো। বাঁশ থেকে বানানো সেই কাগজের বই পড়ে আর খাতায় লিখে বড় হয়েছে বাঙালি। বাঙালির জনপ্রিয় বাহন নৌকার পাল ওড়ানো, পাটাতন তৈরি বাঁশ দিয়েই এবং ‘এক বাও মিলে না, দুই বাও মিলে না’ গভীরতা মাপা হতো বাঁশ দিয়েই। সড়কপথে গরু ও ঘোড়ার গাড়ি এবং রিকশার পাটাতন ও হুডে ছিল বাঁশের ব্যাপক রাজত্ব। বিমান বা হেলিকপ্টারে বাঁশ লাগাতে না পারার দুঃখ ঘোচাতে বাঙালি ঘুড়ি ও নাটাই তৈরিতে বাঁশ কাজে লাগায়। এভাবে জল, স্থল ও আকাশে বাংলার বাঁশ বংশপরম্পরায় ব্যাপক ব্যাপ্তি ছড়িয়েছে। পাঠশালার হেডস্যার মানেই ছিল বাঁশের কঞ্চি হাতে এক কঠিন হৃদয়ের মানুষের উপস্থিতি। আবার বাঁশের কঞ্চির বাড়ি খাওয়া শিশুদের ঘুম পাড়াতে মায়েরা গাইতেন ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ...’। বাবা, দাদা, মামা-চাচারা বাঁশের চাঁই বা পলো দিয়ে মাছ ধরতেন। বাঁশের তৈরি বিশেষ ডুলায় মাছ জমিয়ে একবারে বাড়ি ফিরতেন তারা। জেলেপল্লীর কাছে যেতেই নাকে আসত বাঁশের মাচায় শুকাতে দেওয়া শুঁটকির গন্ধ। পার্বত্যাঞ্চলে কচি বাঁশ (কোরল) তরকারি হিসেবে এবং মোটা-পোক্ত বাঁশের একটি অংশে মাছ, মুরগি বা শুঁটকি পুরেও মুখ বন্ধ করে আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাঁশের কঞ্চি ও মাচার সাহায্যে জন্মে পান। শৌখিন বাঙালি পেট পুরে খাবার খেয়ে আয়েশে সেই পান চিবায় এবং বাঁশের সূক্ষ্ম কাঠি দিয়ে দাঁত খিলাল করে।

আমাদের সংস্কৃতিতেও মিশে আছে বাঁশ। আবহমান বাংলায় গানের সঙ্গে বাঁশের বাঁশির সুরের বন্ধন বরাবরই তৃপ্ত করে সংগীতবোদ্ধাদের। কৃষক যখন বাঁশের জোয়াল গরুর ঘাড়ে লাগিয়ে খেতে লাঙল চালায় কিংবা বাঁশের মই দিয়ে জমির মাটি সমান করে, তখন গাছের ছায়ায় বসে বাঁশের বাঁশি বাজায় সুজন রাখাল। পার্বত্যাঞ্চলের বাঁশ নৃত্যমুগ্ধ করে দেশ-বিদেশের অতিথিদের। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া ও তৎসংলগ্ন জেলায় জনপ্রিয় বিনোদন উপলক্ষ হলো বাঁশ দিয়ে বানানো লাঠি খেলা। বাঁশের খুঁটি দিয়ে প্যান্ডেল খাটিয়ে রাত-বিরাতে চলে যাত্রা, সার্কাস, মেলা, তাবলিগের ইজতেমা এবং ওয়াজ মাহফিল। বাঁশের বেড়া ও বাঁশের চালের মধ্যেই জন্ম, বেড়ে ওঠা ও মৃত্যু বহু গুণীজনের। আবার মৃত্যুর পর কবর দিতে কিংবা চিতায় দাহ করতেও বাঁশ প্রয়োজন। বাঁশের সঙ্গে তাই বাঙালির বন্ধন দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত।

একদিকে যুদ্ধবিগ্রহ আর অন্যদিকে অপকর্মেও বাঁশের জুড়ি নেই। ১৮৩১ সালে আমাদের পাশের পশ্চিমবঙ্গের নারিকেলবাড়িয়ায় ব্রিটিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঁশের লাঠি হাতে প্রতিবাদ করেছিলেন সৈয়দ মীর নিসার আলী, (২৭ জানুয়ারি ১৭৮২-১৯ নভেম্বর ১৮৩১) তিতুমীর নামেই তিনি অধিক জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে চব্বিশ পরগনা, নদীয়া ও ফরিদপুরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ছোটখাটো অনেক খন্ডযুদ্ধে তিতুমীর বাহিনীর বাঁশের আঘাতেই ধরাশায়ী হয় ব্রিটিশ অনুগত জমিদার বাহিনী এমনকি ব্রিটিশ সেনারাও। বারাসাত নামক স্থানে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষক সেনা বাঁশের লাঠি, বল্লম, তীর-ধনুক দিয়ে হটিয়ে দেয় ব্রিটিশদের। ব্রিটিশের মোকাবিলার লক্ষ্যে ১৮৩১ সালে বারাসাতের কাছে এবং বাদুরিয়া থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে বাঁশ ও কাদা দিয়ে দুই স্তরবিশিষ্ট ‘বাঁশের কেল্লা’ বা দুর্গ নির্মাণ করেন তিতুমীর। একই বছর নভেম্বরের ১৩ তারিখে ব্রিটিশ বাহিনী জমিদারদের সমর্থন নিয়ে কামান ও অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রসহযোগে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে। তিতুমীর ও তাঁর বাহিনী বাঁশ, তীর-ধনুক ও বল্লম নিয়ে বীরদর্পে লড়াই করেন। তিতুমীর ও তাঁর ৪০ জন সহযোগী এ যুদ্ধে শহীদ হন। ব্রিটিশরা কামানের আঘাতে বাঁশের কেল্লা উড়িয়ে দিলেও বাঁশ হাতে শত্রুর কামানের সামনে বুক উঁচু করে যুদ্ধ করার গৌরবগাথা ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে।

ব্রিটিশদের ভারত উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত করার ক্ষেত্রে মূল অবদান ছিল মহাত্মা গান্ধীর। জনগণকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে তিনি সমগ্র ভারতবর্ষ হেঁটে বেড়িয়েছেন। এ সময় তিনি ৫৪ ইঞ্চি লম্বা ও শক্ত বাঁশের লাঠি ব্যবহার করতেন। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কোটি বাঙালি স্রেফ বাঁশ হাতেই প্রাথমিক প্রতিরোধ ও প্রশিক্ষণ শুরু করে। দেশের প্রথম সারির রাজনৈতিক দলের দলীয় প্রতীকের সঙ্গে বাঁশের সম্পর্ক বিশেষভাবে লক্ষণীয়। নৌকার লগি, পাটাতন, ছই ও পাল তুলতে বাঁশ প্রয়োজন। ধানের শীষ বহনে প্রয়োজন বাঁশ, ধান মজুদের জন্য গোলা তৈরিতে বাঁশের চাটি এবং ধান পরিষ্কার করতে বাঁশের কুলা প্রয়োজন। বাঁশের জোয়াল ছাড়া লাঙল অচল। তিনটি বাঁশের খুঁটি সংযুক্ত করে ট্রাইপড বানিয়ে মাঝে ঝোলানো হয় দাঁড়িপাল্লা। মই কিংবা কুঁড়েঘর তৈরিতে আগাগোড়া বাঁশ প্রয়োজন। মশাল জ্বালাতে বাঁশের ছোট লাঠির বিকল্প নেই। ঘুরিয়ে বাতাস করার জন্য ব্যবহৃত হাতপাখা তৈরি হয় বাঁশ থেকে। বাঁশের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতীকের এ মিল অবাক করার মতো।

প্রিয় পাঠক! বাঁশবিষয়ক এতসব বেহুদা ভাবনার উদয় হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু সংবাদ ও দুঃসংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে। প্রকৌশলী এবং স্থপতি মহলে সবার জানা আছে, বাংলার অহংকার স্থপতি এফ আর খান মূলত বাঁশের গঠন ও শক্তিমত্তা হৃদয়ে ধারণ করে প্রচলিত চার কোনা এবং মাঝে পিলারবিশিষ্ট বহুতল ভবনের বদলে বাঁশের মতো গোলাকার এবং মাঝে পিলার ছাড়াই উন্মুক্ত বহুতল ভবনের কথা ভাবেন। আমেরিকায় এমন একাধিক বহুতল ভবন গড়ে তিনি স্থাপত্য জগতের ‘আইনস্টাইন’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। বাঁশের কথা মাথায় রেখেই স্থপতি এফ আর খান ১৯৭৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে ১১০ তলাবিশিষ্ট ও ১ হাজার ৪৫৪ ফুট উঁচু ‘সিয়ার্স টাওয়ার’ নির্মাণ করে সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত এটিই ছিল বিশ্বে সর্বোচ্চ ভবন। তবে অবাক করা বিষয় হলো, এফ আর খানের পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ এ যুগের একদল স্থপতি, প্রকৌশলী, ঠিকাদার ও মিস্ত্রি সেই বাঁশকে আরও উচ্চ মর্যাদায় নিয়ে গেছেন। বিগত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় নির্মাণাধীন পল্লীশ্রী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চার তলা ভবন পেছন দিকে হেলে পড়ে। এরপর শিক্ষা বিভাগের প্রকৌশলী ও ঠিকাদার যৌথভাবে অভিনব পদ্ধতিতে ভবনটি সোজা করার উদ্যোগ নেন। সরেজমিন দেখা যায়, ভবনটির সামনে ও এক পাশে গভীর খাল খনন করা হচ্ছে। খাল থেকে উত্তোলিত পচা মাটি বস্তায় ভরে ভবনের পেছনে এবং অন্য পাশে ডোবা-নালায় বাঁশের পাইলিং দিয়ে প্রায় ১২ ফুট চওড়া ও ১৪ ফুট উচ্চতায় বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। বাঁশের পাইলিং ও বালু দিয়ে এভাবে ভবন বাঁচানোর চেষ্টা করা হলেও কেন ভবনটি নির্ধারিত স্থানের বদলে নিকটবর্তী পচা মাটি এলাকায় কোনো সয়েল টেস্ট না করেই নির্মিত হলো, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়নি। একসময় স্কুলের শিক্ষকদের হাতে বাঁশের কঞ্চি বা বেত দেখা যেত। এখন সেই বাঁশের কঞ্চির ঠাঁই হয়েছে স্কুলের নির্মাণকাজে। ১০ আগস্ট ২০২০ তারিখে সরকারি দলের এক ছাত্রনেতার ঠিকাদারিতে নির্মিত বরগুনার আমতলী উপজেলার বৈঠাকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি টয়লেট ভেঙে পড়ে। এ টয়লেটের ভগ্নস্তূপে দেখা যায় এটি নির্মাণে কয়েকটি স্থানে রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে। (সূত্র : দি ডেইলি স্টার; ১২ আগস্ট ২০২০) ৬ জুলাই ২০১৮ তারিখে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মুসিকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন সীমানাপ্রাচীরে রডের বদলে বাঁশ পাওয়া যায়। এ বাঁশ দিয়েছেন এলাকার একজন রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধির ভাগ্নে। (সূত্র : দি ডেইলি স্টার; ১৫ জুলাই ২০১৮) এর আগের বছর (২০১৭) জুলাইয়ে বান্দরবান জেলার বালাঘাটা এলাকায় সরকারি মহিলা কলেজের ড্রপওয়াল নির্মাণে রডের পাশাপাশি বাঁশ ব্যবহারের সচিত্র খবর প্রকাশ পায়। (সূত্র : দি অবজারভার; ২৩ জুলাই ২০১৭) তারও আগের বছর ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীবাহী একটি ট্রলি দেয়ালে আঘাত লাগে। এতে দেয়ালের টাইলস ও সিমেন্ট খসে পড়ে এবং দেয়ালের ভিতরে রডের বদলে বাঁশ ব্যবহারের তথ্য ভেসে ওঠে। (সূত্র : দি ডেইলি সান; ১ নভেম্বর ২০১৬) গাইবান্ধার মেঘডুমুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টয়লেট নির্মাণেও রডের বদলে বাঁশ ব্যবহারের তথ্য আসে গণমাধ্যমে। (সূত্র : নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম; ১৮ জুলাই ২০১৭) ২০১৫ সালের এপ্রিলে চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একটি ভবন নির্মাণে রডের বদলে বাঁশ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। (সূত্র : দি ডেইলি স্টার; ৫ মার্চ ২০২১) ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর দি ডেইলি স্টারের সংবাদ ও প্রকাশিত ছবি মোতাবেক ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় রামভাদ্রপুর গ্রামে খাড়িয়া নদীর ওপর নির্মিত উঁচু ব্রিজের অ্যাপ্রোচ রোড নির্মিত না হওয়ায় বাঁশের মই দিয়ে গ্রামবাসীকে ব্রিজে ওঠানামা করার করুণ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হচ্ছে। একই ধরনের ব্রিজ ১০ বছর ধরে কোনো ব্যবহার ছাড়াই দাঁড়িয়ে আছে নেত্রকোনার মদন উপজেলার খুড়াইখালী খালের ওপর। (সূত্র : দি ফিন্যানশিয়াল টাইমস; ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২) ময়মনসিংহের সদর ও গৌরীপুর উপজেলার ১১ গ্রামের মানুষ বাঁশ বেয়ে স্থানীয় সুরাইয়া ডুবা খালের ওপর নির্মিত ব্রিজে ওঠানামা করে। অ্যাপ্রোচ রোড না থাকায় ব্রিজে ওঠার বাঁশের সাঁকোই তাদের ভরসা। (সূত্র : দি ইনডিপেনডেন্ট; ১৬ জুলাই ২০১৫) একই ধরনের ব্রিজ ২২ বছর যাবৎ বেকার পড়ে আছে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভূকসীময়েল ইউনিয়নের খালের ওপর। (সূত্র : ইউএনবি; ২ ডিসেম্বর ২০১৯) পাবনার বেড়া উপজেলার আমিনপুর গ্রামে কদমতলা খালের ওপর ২০১৪ সালের মার্চে ৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকায় বেশ বড়সড় ব্রিজ নির্মাণ করলেও তা বেকার হয়ে পড়ে অ্যাপ্রোচ রোড না থাকায়। (সূত্র : দি ডেইলি স্টার; ৮ মার্চ ২০১৫ আপডেটেড) ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় চারালকাটা নদীর ওপর নির্মিত ১৪০ মিটার লম্বা ব্রিজে বাঁশের চাটি বিছিয়ে ধান ও গোবর শুকায় স্থানীয় কৃষক। কারণ অ্যাপ্রোচ রোডের অভাব। (সূত্র : দি ডেইলি স্টার; ৩ মার্চ ২০১৫) বাঁশের সাহায্যে ৩১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সিতাইহারের ব্রিজে ওঠানামা করে তিন ইউনিয়নের হাজার হাজার গ্রামবাসী। (সূত্র : ডেইলি সান; ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২) এমন আরও বহু ব্রিজের তথ্য পাওয়া যায় আর্কাইভ ঘাঁটলেই। অতি সম্প্রতি (ঈদের ছুটিতে) নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি উপজেলার ফরিদপুর গ্রামে ছয় বছর আগে নির্মিত ব্রিজের ওপর বাঁশ, কাঠ ও টিন দিয়ে নির্মিত ঘরের ছবি প্রকাশিত হয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। তথ্যমতে মাছের ঘেরের লোকজন ওই ঘরে থাকে ও পাহারা দেয়। আর মানুষ হাটে ব্রিজের নিচ দিয়ে। কারণ অ্যাপ্রোচ রোড নেই দুই পাশে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৩১ লাখ টাকার এ ব্রিজ নির্মাণ করান স্থানীয় সংসদ সদস্য। (সূত্র : দি ডেইলি বাংলাদেশ; ২ মে ২০২২)

অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রেল মন্ত্রণালয়ও বাঁশ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। ২০১৯ সালের ২৭ জুন ঢাকা ট্রিবিউন এবং পরে অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুসারে হবিগঞ্জ জেলার ৫২ কিলোমিটার রেলপথে থাকা ৮৪টি রেল কালভার্টের ওপর রেললাইন ও প্লেট যথাস্থানে রাখতে ও শক্তিশালী করতে বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে। এ রেলপথের প্লেট বা সিøপারকে যথাস্থানে রাখতে ব্যবহৃত লোহার বেল্টের অধিকাংশ চুরি হয়ে গেছে। এ অবস্থায় সিøপার যথাস্থানে রাখতে বাঁশের লম্বা  ফাঁলি পেরেক দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে একের পর এক সিøপারের সঙ্গে। বাঁশ নিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, স্থানীয় সরকার, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং রেলওয়ে মন্ত্রণালয় এমন অপরাধ ও দুর্নীতিমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়লেও বাঁশনির্ভর কাগজ ও মন্ড তৈরির কারখানা (কর্ণফুলী) বাঁচাতে পারেনি শিল্প মন্ত্রণালয়।

বাঁশনির্ভর কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নামই শোনা যায় না আজকাল। বাঁশ ও বাঁশজাত পণ্য রপ্তানির এক বিরাট সুযোগ থাকলেও তা কাজে লাগাতে পারছি না আমরা। ২০২০ সালে বিশ্বে বাঁশ ও বাঁশজাত দ্রব্যের বাজারমূল্য ছিল ৫৩.২৮ বিলিয়ন ডলার, প্রতি বছর এ বাজার শতকরা ৫.৭ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে ধারণা গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চ নামক গবেষণা সংস্থার। কৃত্রিম বা রাসায়নিক দ্রব্যের বদলে প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে এ বাজার ২০২৮ সালে প্রায় ৮৩ বিলিয়ন ডলার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চীনে ২০১৮ সালে কাঁচামাল শিল্পপণ্য, আসবাবপত্র, কচি বাঁশ (তরকারি) ও অন্যান্য কাজে ৬২ বিলিয়ন ডলারের বাঁশ ব্যবহৃত হয়েছে, যা ২০২৮ সাল পর্যন্ত ৬.৫ শতাংশ হারে বাড়বে। জার্মানি ২০২০ সালে তরকারি হিসেবে খাওয়ার জন্য শুধু ইতালি থেকেই ২.৬৯ বিলিয়নের কচি বাঁশ বা বেম্বো স্যুট আমদানি করেছে। (সূত্র : ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ ট্রিড ব্যাজ ডট কম) ২০০৯ সালেই চীন বিশ্বের ১৭৭টি দেশে শতাধিক ধরনের ভ্যারাইটি বাঁশ ও বাঁশজাত পণ্য রপ্তানি করে তৎকালীন ১.৫ বিলিয়ন ডলার আয় করে। এ আয় গত এক যুগে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে সুচিন্তিত পরিকল্পনার কল্যাণে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে চীন এক মাসে সর্বোচ্চ ২৭.৩৪১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বাঁশ ও বাঁশজাত পণ্য রপ্তানি করে। (সূত্র : সিইআইসি ডাটা ডটকম) পক্ষান্তরে বাংলাদেশ থেকে বাঁশ ও বাঁশজাত পণ্য রপ্তানির সুনির্দিষ্ট তথ্য রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি। আসবাবপত্র এবং হস্তশিল্প রপ্তানি সংক্রান্ত তথ্যউপাত্ত থাকলেও এ ক্ষেত্রে বাঁশের অংশ কতটুকু তা অস্পষ্ট। লেখাটা শেষ করব দুটি পৃথক প্রসঙ্গ টেনে।

এক : বাংলাদেশের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ পেশায় ছিলেন আইনজীবী। তাঁর নির্বাচনী এলাকার মানুষের মামলা তিনি বিনা খরচে পরিচালনা করতেন এবং রায়ের পর টাকা নেওয়ার বদলে তৎকালীন একটি আধুলি বা কয়েন দিতেন। শেষ জীবনে রসিকতা করে তিনি বলেছিলেন, জীবনভর এই আধুলি বা কয়েন দিয়েছিলেন বাঁশ কেনার জন্য। কারণ তিনি যাদের উপকার করেছেন তারা সত্যিকার বাঙালি হয়ে থাকলে অবশ্যই উপকারকারীর অর্থাৎ এই নেতা বা আইনজীবীর মাথায় বাঁশ দিয়ে আঘাত করবেন এই বাঁশ যদি তাঁর দেওয়া আধুুলি বা কয়েন দিয়ে কেনা হয়, তবে মনে হবে নিজের টাকায় কেনা বাঁশ নিজের মাথায় পড়েছে। কেউ মারেনি।

দুই : প্রবাস থেকে আসা শ্বশুরপক্ষের আত্মীয়কে দাওয়াত দিয়ে বিপাকে পড়েছেন বন্ধু দম্পতি। তিন বাজার ঘুরে রান্নার জন্য ভোজ্য তেল না পেয়ে বন্ধুদের কাছে তেল ধার চাচ্ছেন। আমরা যদিও বাঙালি, তবু বিপদে এগিয়ে এসেছি, বাঁশ দিইনি। তেল দিয়েছি। তবে  তেল নিয়ে পত্রিকায় কিছু লেখারও অনুরোধ রাখতে পারিনি। কারণ দেশের গণতন্ত্র যখন ‘বাই দ্য বিজনেসম্যান, ফর দ্য বিজনেসম্যান, অব দ্য বিজনেসম্যান’ হয়ে যায়, তখন তেল,  পিঁয়াজ বা চাল-ডাল নিয়ে লিখেও কিছু হয় না। এ যেন ছোটবেলায় শেখা তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের এক লাফে চার হাত ওঠা ও তিন হাত নামার অঙ্ক। বেতন ও বোনাস দিয়ে জনগণ নামক বানরটিকে চার হাত উঠতে দেওয়া হলো। এরপর অসাধু ব্যবসায়ীদের মাখানো তেলের কারণে জনগণ নামের বানর কেবল নামতেই থাকল। কিংবা একবারে নিচে পড়ে হাত-পা-কোমর ভেঙে মাটিতে পড়ে তৈলাক্ত বাঁশের আগার দিকে তাকিয়ে থাকল। আকাশ দিয়ে তখন হয়তো একটা প্লেনে বেগমপাড়া (বিদেশে) যাচ্ছেন ব্যবসায়ী ও কর্তাব্যক্তিরা, আর জনগণ নামক বানর মাটিতে বসেই গেয়ে উঠল- ‘আমার বলার কিছু ছিল না, চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে... তুমি চলে গেলে...’।

 

                লেখক : গবেষক, কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর