মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

হে মজুদদার! কাফনের কিন্তু পকেট নেই

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

হে মজুদদার! কাফনের কিন্তু পকেট নেই

করোনার ভয়াল থাবা এখনো পৃথিবীর বুক থেকে চলে যায়নি। কত বড় বড় ধনকুবের খালি হাতে বিনা চিকিৎসায় দুনিয়া থেকে চলে গেলেন! আফসোস, চোখের সামনে এমন তাজা উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও আমাদের মজুদদার বন্ধুরা দেদার মজুদদারি করে যাচ্ছেন। কি মহামারি, কি বিপদাপদ, কি রমজান, কি হজ- কোনো একটা দুর্যোগ বা প্রয়োজনের আভাস পেলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী। মানুষের বিপদ পুঁজি করে মুনাফার স্বপ্ন দেখেন তারা। রমজান উপলক্ষে ঘৃণ্য মজুদদারি এ দেশের ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। শত বলেকয়েও মজুদদারি রুখতে পারছে না আলেমসমাজ। আমরা প্রায়ই বলি, যদি ব্যক্তির ভিতর খোদাভীতি না জাগানো যায় তাহলে আইন করে কখনো দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না। তাই তো রসুল (সা.) আইন প্রণয়নের আগে মানুষের ভিতর তাকওয়া জাগিয়ে তুলেছিলেন। আমাদের দেশে আইনের চেয়ে ধর্মীয় অনুভূতির কারণে মানুষ গুনাহ থেকে বিরত থাকে বেশি। কিন্তু মজুদদারির বেলায় দেখা গেছে বিপরীত দৃশ্য। এখানে আইনের প্রয়োগ তো আছেই, আলেমদের সক্রিয় ভূমিকা, বক্তব্য, ওয়াজ-নসিহতেও কোনো কাজ হচ্ছে না।

আসলে অর্থবিত্তের কাছে অনেক সময় ধর্ম মূল্যহীন হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা যখন দেখছে মজুদদারি করে কোটি কোটি টাকা ইনকাম করা সম্ভব, তখন তারা ধর্মকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে মজুদদারির পথেই পা বাড়াচ্ছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো নিয়ত করে রেখেছে, ভালো ব্যবসা হলে কাবায় গিয়ে হজ করব কিংবা অমুক বড় মাদরাসায় দান-সদকা করে আল্লাহর থেকে মাফ চেয়ে নেব। কিন্তু মানুষের জীবন-জীবিকা সংকুচিত করে হজ কিংবা সদকায় কোনো লাভ হবে না- এ সহজ বিষয়টি শয়তান মজুদদারের মাথা থেকে ভুলিয়ে দেয়।

হে আমার মজুদদার ভাই! আল্লাহকে বেজার করে, আল্লাহর রসুলকে কষ্ট দিয়ে, মানুষের অভিশাপ কামিয়ে যে সম্পদের পাহাড় আপনি গড়ে তুলছেন, একটু ভাবুন কবরে এ সম্পদ কি কাজে আসবে? যাদের জন্য ইমান আমল বিকিয়ে দিয়ে আজাব পকেটে পুড়ছেন তারা কি আপনার আজাবের ভাগিদার হবে? সেই যে কবে বাবা-মাকে কবরে রেখে এসেছেন, আর কি কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন? দুই চোখের পানি ছেড়ে খোদার কাছে বাবা-মার মুক্তির জন্য মোনাজাত করেছেন? আপনার সন্তানের প্রতি আপনার যেমন মমতা, আপনার বাবা-মাও তো আপনাকে ঠিক তেমনই ভালোবাসতেন। আজ আপনি আপনার বাবা-মাকে ভুলে আছেন, কাল আপনার সন্তান আপনাকে ভুলে যাবে। এটাই হয়ে থাকে। তাই সন্তানকে ভালো রাখতে গিয়ে নিজের আখিরাত শেষ করবেন না। মনে রাখবেন, কাফনের কিন্তু পকেট নেই। আল্লাহর কাছে তওবা করুন, অবশ্যই আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করবেন।

দাম বাড়ানোর জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী জমা রাখাকে ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় ‘ইহতিকার’ বা ‘মজুদদারি’ বলা হয়। অস্বাভাবিকভাবে মুনাফা লাভের আশায় মজুদদারি অভিশাপ বা গুনাহের কাজ। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) বলেন, ‘সর্বসাধারণের কষ্ট ও ক্ষতি হয় এমনভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আটকিয়ে রাখাই হলো মজুদদারি। মজুদদারি গুনাহের কাজ হওয়ার কারণ, এর ফলে সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য ক্ষুণ্ণ হয়, দৈনন্দিন জীবনে খাবারের চাহিদা মেটাতে মানুষ হিমশিম খায়, অর্থনৈতিক হয়রানির শিকার হয় এবং সব শ্রেণির মানুষ খাদ্যকষ্টে ভোগে। এজন্য ইসলামী শরিয়ত মজুদদারিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। প্রিয় নবী (সা.) মজুদদারকে গুনাহগার, অভিশপ্ত ও সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এক হাদিসে মজুদদারকে গুনাহগার আখ্যায়িত করে তিনি বলেছেন, ‘পণ্যদ্রব্য আটক করে অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী অবশ্যই পাপী।’ (বায়হাকি, মিশকাত) অন্য হাদিসে মজুদদারকে অভিশপ্ত ঘোষণা করে প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘অধিক মুনাফার লোভে মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি ৪০ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, সে ব্যক্তি আল্লাহর দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট।’ (ইবনে মাজাহ, বায়হাকি, মিশকাত) মজুদদার সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, ‘মজুদদার খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের মূল্য কমে যায়, তবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। যদি মূল্য বেড়ে যায় তবে তারা আনন্দিত হয়।’ অন্যায়ভাবে মানুষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে সামাজিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে মজুদ করা যেমন গুনাহের কাজ, তেমনি এ কাজে আল্লাহ দুনিয়ায় মহামারি দিয়ে শাস্তি দেন। হাদিসে এসেছে, ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকে রাখে অর্থাৎ মজুদদারি করে, তবে আল্লাহ তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (মিশকাত)

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি।

সর্বশেষ খবর