শনিবার, ২৮ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

শত বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনা ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

শাইখ সিরাজ

শত বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনা ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রধান যোগাযোগমাধ্যম হওয়ার কথা ছিল জলপথ। ভূগর্ভস্থ পানি নয়, বরং নদী-নালা-খালবিলের পানিতেই হতে পারত আমাদের কৃষি সেচ। দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত আর হাওর-বাঁওড়ের বাংলাদেশ হতে পারত বিশ্বের কাছে প্রাকৃতিক পর্যটনের অন্যতম ক্ষেত্র। কৃষি ঘিরে রচিত হতে পারত অন্য রকম বাংলাদেশ। এসব অমিত সম্ভাবনা ফুরিয়ে যায়নি। স্বাধীনতার প্রথম ৫০ বছরে আমাদের মূল লড়াইটা ছিল মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে অধিক জনসংখ্যার একটি দেশের দারিদ্র্য ঘোচানোর, দুর্ভিক্ষ দূর করে ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়ার। সেই বিবেচনায় গত ৫০ বছরে আমাদের অর্জন কম নয়। তবে পথটা যে খুব মসৃণ ছিল তা বলা যাবে না। বিগত সময়ের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিস্তর সমন্বয়হীনতা আমরা দেখেছি। ফলে সময়ে আমাদের যেখানে শত কিলোমিটার পথ অতিক্রমের কথা ছিল, সেখানে অনেকখানি পিছিয়ে আছি। সময়ে সময়ে প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। কখনো রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরূপ আচরণ কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগও আমাদের পথরোধ করেছে। এ মুহূর্তে দেশের একাংশে বন্যা চলছে। ১১ মে অব্যাহত ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সিলেট জেলায় বন্যা শুরু হয়েছে। মৌসুমি এ বন্যায় বহুমুখী ক্ষতি ও দুর্ভোগের চিত্র দুই সপ্তাহজুড়ে দেখছি। এর মধ্যে বড় এক ক্ষতের মধ্যে পড়েছে কৃষি খাত। যদিও এ অঞ্চলে আগাম বোরো ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। তার পরও বিস্তীর্ণ জমিতে বোরো ধান ছিল। সেগুলো পানিতে নিমজ্জিত হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতি হয়েছে আউশ ধানের বীজতলাসহ গ্রীষ্মকালীন সবজি ও অন্যান্য ফসলের। ভেসে গেছে পুকুর ও জলাশয়ের মাছ। বন্যা আমাদের দেশের নিয়মিত এক প্রবণতা। ভৌগোলিক কারণে প্রাকৃতিক এ দুর্যোগ একদিকে অভিশাপ, অন্যদিকে আশীর্বাদ। বন্যা আমাদের কৃষিজমির পলিবাহক। ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত নানা প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বদ্বীপ বাংলাদেশের জীবন বাস্তবতা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের তিনটি প্রধান নদ-নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা। নদীবাহিত পলিমাটি দ্বারা গঠিত দ্রুতবর্ধনশীল এ বদ্বীপ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। নদী ও তার প্লাবনভূমি এ দেশের ৮০ শতাংশ এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির নিয়ামক শক্তি। আমাদের নদীই জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। এ বিষয়টি সামনে রেখেই শত বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনা; আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এক বড় মাইলফলক। এ মাইফলক রচনায় সহায়ক দেশ নেদারল্যান্ডস। বদ্বীপ ব্যবস্থাপনায় অসামান্য সাফল্যের নজির গড়ে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন বদ্বীপ উন্নয়ন ও নদী ব্যবস্থাপনায় নির্দেশকের ভূমিকা রাখছে। আমি যখন এ লেখাটি লিখছি তখন রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বদ্বীপ সম্মেলন। এ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বদ্বীপ পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত বিদেশি সব অংশী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি। কথা বলেছি বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ প্রতিনিধি মার্সি টেম্বনের সঙ্গে, বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাঁদের উপলব্ধি প্রসঙ্গে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু একটি বদ্বীপ, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে আছে। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদীগুলোকে অর্থনৈতিক সম্পদে পরিণত করা গেলে এ দেশের অর্থনীতিতে বিস্ময়কর পরিবর্তন আসবে। যা ছাপ রাখবে কৃষি, শিক্ষা, অবকাঠামো ব্যবস্থা সবকিছুতে। আপনার হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে আমি দেখেছি, আপনি দেখিয়েছেন নেদারল্যান্ডস কীভাবে পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিজেদের পাল্টে নিয়েছে। নেদারল্যান্ডস পেরেছে, বাংলাদেশও পারবে। ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক সব উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে অংশীদারি বজায় রেখে কাজ করে চলেছে।

কথা বলেছি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ইফাদের বাংলাদেশ প্রতিনিধি আর্নাউড হ্যামেলিয়ের্সের সঙ্গে। তিনি বলেন, ডেল্টা প্ল্যানের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সবাইকে একই পথে বা দিকে চলতে হবে। ফলে আরও সমন্বয় জরুরি। যদিও কভিড আমাদের কাজ অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে। তার পরও আমি মনে করি আরও বেশি সমন্বয়ের প্রয়োজন, একে অন্যের কাজে আরও বেশি পরিপূরক ভূমিকায় থাকতে হবে। অবকাঠামোগত বিনিয়োগ করতে ইফাদ গবেষণার দিকটা দেখবে। সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টিও রয়েছে। অবশ্যই কর্মদক্ষতা বাড়াতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অনেক কাজ করছি এবং সম্প্রতি এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক ও নেদারল্যান্ডস অ্যাম্বাসির সঙ্গে একটি প্রকল্পে যৌথভাবে কাজ করছি। পারস্পরিক সমন্বয়কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন নেদারল্যান্ডস রাষ্ট্রদূত আনে ফান লিউভেনও। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, আন্তমন্ত্রণালয় অগ্রগতি এবং সমন্বয়ের প্রয়োজন। এজন্য আমাদের দরকার একটি কার্যকর ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল। দ্বিতীয়ত, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যক্তি ও সরকারি খাতে বিশেষ করে বিরূপ জলবায়ু মোকাবিলায় অর্থায়ন। এর পরের চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে দাতা সংস্থার সমন্বয়কে আরও শক্তিশালীকরণ। বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়ন কোনো দ্বিপক্ষীয় বিষয় নয়। এটি অর্জন করতে হলে নিরাপদ, উন্নয়নশীল, জলবায়ুসহিষ্ণু- এ তিনটি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে সংশ্লিষ্ট জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অংশীজনদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পৃথিবীর নদী ও সমুদ্র তীরবর্তী একেক জনপদের বাস্তবতা একেক রকম। জীবনাচার, সংস্কৃতি ও লোকভ্যাসও একেক রকমের। আমাদের জীবন ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে আমাদের বাস্তবতায়। শত বছরের ডেল্টা পরিকল্পনায় আমাদের সব বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও সেখানে দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে রয়েছে মেকং ডেল্টার সফল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দেশ ভিয়েতনাম ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নিচের দেশ নেদারল্যান্ডস। আমাদের শত বছরের পরিকল্পনার মধ্যে অনেক পর্ব রয়েছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়নের জন্য এরই মধ্যে নেওয়া হয়েছে ৮০টি প্রকল্প। এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছি শত বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনার অন্যতম কুশলী, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প আহ্বান করা হয়। তারপর সে প্রকল্পগুলোর বিনিয়োগ কাঠামো যাচাই-বাছাই করতে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা চাই। ইকোনমিক, সোশ্যাল ও এনভায়রনমেন্টাল লেন্সে ফেলে প্রকল্পগুলো কতটা প্রভাব বিস্তারকারী হতে পারে সে সম্পর্কে একটা ধারণা ইতোমধ্যে আমাদের দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক নিজস্ব খরচে এ কাজটি করে দিয়েছে। তবে সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ৮০টি প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ, বলছিলেন ড. শামসুল আলম। আমার প্রশ্ন ছিল, অর্থের সংস্থান হলেও এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সক্ষমতা আমরা অর্জন করতে পেরেছি কি না?

দীর্ঘমেয়াদি ও সুবিশাল কর্মপ্রয়াস রয়েছে বদ্বীপ পরিকল্পনায়। আগামী আট বছরে রয়েছে অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে নানামুখী কর্মতৎপরতার কথা। এর সঙ্গে জনমানুষের জীবন কাঠামোর বিপুল পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। রয়েছে আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিশাপ কমিয়ে আশীর্বাদকে বেশি মাত্রায় গ্রহণের চিন্তাভাবনা। এ ক্ষেত্রে বন্যা ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাবে। তবে দীর্ঘকালের নদী ড্রেজিং ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নেওয়া উন্নয়ন কাজগুলোর নানা দিক নিয়ে কথা বলছেন ড. আইনুন নিশাত। এমনকি এ পর্যন্ত নেওয়া ৮০টি প্রকল্পের ধারণাগুলোও নতুন নয় বলে জানিয়েছেন বদ্বীপ পরিকল্পনা মূল্যায়নকারীদের অন্যতম এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, পাশের দেশ ভারত যোগাযোগের জন্য নদীপথ ও রেলওয়েকে সমৃদ্ধ করছে। আর আমরা সড়কপথে বেশি বিনিয়োগ করছি। ড. আইনুন নিশাত ডেল্টা প্ল্যানের প্রকল্পগুলোর সময়োপযোগিতা আরও বেশি যাচাই-বাছাই করে নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন।

সম্প্রতি আমি নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে সেখানকার বদ্বীপ ব্যবস্থাপনার নানা বিষয় দেখেছি। নেদারল্যান্ডস প্রাচীনকাল থেকেই বন্যা নিয়ন্ত্রণে তাদের পুরনো কারিগরি উৎকর্ষের প্রয়োগ করে আসছে। কয়েক শ বছরের পুরনো ও এখনো সক্রিয় সব উইন্ডমিল তারই পরিচয় বহন করে। এ ছাড়া তারা যে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্র করে পানি ব্যবস্থাপনার বহুবিধ কৌশল অবলম্বন করে, তেমন দুর্যোগ তাদের জীবনে কমই আসে। এ দিক থেকে বাংলাদেশের রয়েছে নানাবিধ সংকট ও প্রতিকূলতা। রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, খাদ্য উৎপাদনের গতি ধরে রাখার মতো গবেষণা, নদীকেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থা আরও সচল ও স্বাভাবিক করার তাগিদ। এর সঙ্গেই যুক্ত রয়েছে কৃষি, খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, যোগাযোগ ও টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনার সব ধারায় নিজেদের বেগবান রাখার বিষয়। বাংলাদেশের বাস্তবতাগুলো কাছ থেকে দেখে নেদারল্যান্ডস যথেষ্টই আশাবাদী। বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের পানি ব্যবস্থাপনাবিষয়ক প্রতিনিধি মারটাইন ফান ডের ঘুপ বলছেন, বাংলাদেশের পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়নের কৌশল ও আন্তর্জাতিক মহলের মতামত গ্রহণের এ অনুশীলন একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করছে।

আমি মনে করি যে কোনো পরিকল্পনায় জনমানুষকে সম্পৃক্ত রাখা জরুরি। সবাই যদি কর্মকান্ডের সঙ্গে একাত্মতা বোধ না করে তবে তা দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়ন করা যায় না। সে ক্ষেত্রে জনমানুষকে সচেতন করতে মিডিয়া বা গণমাধ্যমের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নে সমাজ বা রাষ্ট্রের সব ইউনিটের কার্যকর অংশগ্রহণ ছাড়া শতভাগ সাফল্য লাভ সম্ভব না।

তবে আমি আশাবাদী থাকতে চাই। সুদীর্ঘ এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন জ্ঞান ও দক্ষতা বিনিময়। পৃথিবীর সেরা ও বাস্তবমুখী উদাহরণগুলো সামনে রেখে উন্নত ধারণা ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ কাজ লাগাতে হবে আমাদের। যাতে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ধারার সঙ্গে উন্নত বাংলাদেশ রচনার সব আয়োজনের সমন্বয় থাকে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

ইমেল : [email protected]

সর্বশেষ খবর