বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

হৃদয়ের কথা

তসলিমা নাসরিন

হৃদয়ের কথা

১. বাংলাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ফিরোজ সাঁই ১৯৯৫ সালে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে “এক সেকেন্ডের নাই ভরসা” গানটি গাইতে গাইতে মঞ্চের ওপর ঢলে পড়েন। কী হয়েছিল? স্ট্রোক। স্ট্রোক থেকে মৃত্যু। সত্যিই তো, এক সেকেন্ডের নাই ভরসা। মঙ্গলবার কলকাতার নজরুল মঞ্চে গান গাইতে গাইতে ঠিক নয়, তবে গানের অনুষ্ঠান থেকে হোটেলে পৌঁছেই সঙ্গীতশিল্পী কেকে’র মৃত্যু হলো। মালায়ালি শিল্পী এদাভা বশিরও তিন দিন আগে গান গাইতে গাইতে মঞ্চের ওপরই মৃত্যুবরণ করেন। পৃথিবীর প্রচুর অভিনেতা, শিল্পী, বাদক মঞ্চে পারফর্ম করতে করতে মারা গেছেন। আসল সত্যটা হলো, এক সেকেন্ডের নাই ভরসা।

কেকে’র বয়স এমন কিছু নয়, দেখলে মনে হয় রেগুলার ওয়ার্কআউট করা শরীর, স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন, হলে কী হবে, ওই যে ফিরোজ সাঁই গেয়েছিলেন, এক সেকেন্ডের নাই ভরসা। কেউ চমৎকার লাইফ স্টাইল মেইন্টেইন করেও হুট করে চলে যান, কেউ আবার কিছুই না করে ৯৯ বছর বেঁচে থাকেন।

জিনে রোগ শোক থাকে, ওটির আরেক নাম হয়তো নিয়তি। ওটিকে খুব একটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা যায় না। আমার মনে হয় দীর্ঘদিন শারীরিক কষ্ট যন্ত্রণায় ভুগে মরার চেয়ে এমন হঠাৎ করে মরে যাওয়া অনেক ভালো। কেকের অনুষ্ঠানে প্রচুর শ্রোতা এসেছিল, প্রচুর সমর্থন তিনি পেয়েছেন, প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছেন। মন তখন নিশ্চয়ই তাঁর ভালো লাগায় ভরে ছিল। আনন্দে নেচেছিল হৃদয়। এই সুখানুভূতি নিয়ে যদি মৃত্যু হয়, তবে সেই মৃত্যু সওয়া যায়। কেউ ভালোবাসে না, কেউ কাছে আসে না, কেউ নেই কোথাও, শুধু দুঃখ, শুধু বেদনা, শুধু হতাশা- এমন সময় মৃত্যু এলে সেই মৃত্যু সওয়া যায় না।

২. কিছুদিন আগে নরসিংদী স্টেশনে জিন্স, টি শার্ট পরা এক মেয়ে আক্রমণের শিকার হওয়ার পর মেয়েদের পোশাক নিয়ে মানুষ সিরিয়াসলি ভাবছে। বাংলাদেশে আমি সত্তর দশকেই প্যান্ট শার্ট পরতাম। স্কার্ট টপ পরতাম। লোকে মুগ্ধ চোখে দেখতো আর বলতো, কী স্মার্ট রে বাবা। আশির দশকে জিন্স পরতাম, টি শার্ট পরতাম। বড় সানগ্লাস পরতাম। কাঁধে ইয়াশিকা ক্যামেরা নিয়ে রাস্তায় হাঁটতাম। ফটো তুলতাম। সালোয়ার কামিজ পরলে ওড়না পরতাম না। চুল বয়কাট রাখতাম। লোকে দেখতো আর বলতো, বাহ বিরাট স্মার্ট তো। নব্বইএর দশকের শুরুতে যখন ইচ্ছে শাড়ি, যখন ইচ্ছে স্কার্ট, জিন্স, প্যান্টস, টপ, শার্ট, টি শার্ট। লোকে বলতো, বেশ স্মার্ট। আর এখন ২০২২ সাল। জিন্স আর টি শার্ট পরলে লোকের মার খেতে হয়। মারের আসল কারণটা হলো ‘জিন্স টি শার্ট ছেলেদের পোশাক, তুই ছেলেদের পোশাক পরলি কেন, তোর ওড়না কোথায়? তুই হিজাব পরলি না কেন? বোরখাই বা কেন পরলি না? মুসলমানের মেয়ে মুসলমানের পোশাক পরবি।’

আসলে একটা বদ হাওয়া বয়ে গেছে গত দুই দশকে। এই বদ হাওয়া ধর্মান্ধ নারীবিদ্বেষী দেশের পোশাককে নিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। বদ হাওয়াটা মানুষের মস্তিষ্ককেও বদ করে দিয়েছে। শুধু জিন্স টি শার্ট পরে প্রতিবাদ করলে খুব বেশি লাভ হবে না। বদ হাওয়াটাকে দূর করতে হবে।

কিন্তু দূর কে করবে? মেয়েদের শরীর কেন এত ঢেকে রাখতে হবে, এই প্রশ্ন করাতে সেদিন রে রে করে ছুটে এলো নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করে এমন কিছু লোক। তারা বললো আমি নাকি পলিটিক্যালি কারেক্ট নই। খোলামেলা পোশাকে সব পুরুষকে যেমন মানায় না, সব মেয়েকেও মানায় না, এই কথা বলাতে আবার কেউ কেউ বললো, আমি বডি শেমিং করছি। ঠিকই তো, যার পা দেখতে ভালো, সে যদি পা খোলা পোশাক পরে, দেখতে ভালো লাগে আমার। আর যার পা হাতির পায়ের মতো, আমি বলতেই পারি তার কী দরকার পা খোলা পোশাক পরার! একই কথা বলি বুক পেট নিতম্বের বেলায়। কেন আমি যার পা সুন্দর তার পা সুন্দর বললাম, কেন আমি যার পা সুন্দর নয়, তার বডি শেমিং করলাম! এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিন্দের ঝড় বয়ে গেল।

আমি বাপু পলিটিক্যালি কারেক্ট কখনও ছিলাম না। চিরকালই আমি পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট। সে কারণেই আমার শত্রুর শেষ নেই, সে কারণেই ফতোয়া, মিছিল, হুলিয়া জারি, দেশ থেকে বিতাড়ন, বই ব্যান। অন্য দেশেও একই পরিস্থিতি, গৃহবন্দিত্ব, রাজ্য থেকে বিতাড়ন, দেশত্যাগে বাধ্য করা। সর্বত্র ব্রাত্য আমি।

আমি বেড়াল ভালোবাসি বললে কিছু লোক ঘেউ ঘেউ করে উঠবেই, বলবে, আমি কুকুর ভালোবাসি না। সুতরাং কুকুরপ্রেমীরা এক জোট হয়ে আমার কুৎসা রটাবে। একবার আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে একটি ঘটনার বর্ণনা করেছিলাম এভাবে, মেয়েরা দূরপাল্লার বাসে বসে ছিল, বাস মাঝপথে থামার পর পুরুষেরা বাইরে গিয়ে প্রস্রাব করে এল, মেয়েরা প্রস্রাব আটকে বাসেই বসে রইলো। অমনি লোকেরা বলতে শুরু করলো, আমি নাকি বলেছি মেয়েরা ছেলেদের মতো দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করুক। একবার লিখলাম, মুসলমান পুরুষেরা চার বিয়ে করতে পারে, ইসলাম ধর্ম পুরুষকে এক সঙ্গে চার স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে, অমনি লোকে বলতে শুরু করলো, আমি নাকি মেয়েদের চার বিয়ের অধিকার চাইছি, অর্থাৎ মেয়েরা যেন চার স্বামী নিয়ে এক সঙ্গে এক ঘরে বাস করতে পারে। আমি যতটুকু ভাবি, তার চেয়ে বেশি ভেবে নেয় কিছু পাঠক। কারণ তাদের উদ্দেশ্য ছলে বলে কৌশলে যে করেই হোক আমার বদনাম করা।

মেয়েদের শরীরের কোন অংশ, এবং পুরুষের শরীরের কোন অংশ দেখতে ব্যক্তি আমি পছন্দ করি, তা জানানোর পর কিছু লোক ঘেউ ঘেউ করে উঠেছে, কী পোশাক কাকে মানায়, কাকে মানায় না তা বলাতেও ঘেউ ঘেউ। এর মানে আমি নাকি মেয়ে বা পুরুষ যারা কোন পোশাক পরলে আমার চোখে মানায় না বলেছি, তাদের বডি শেমিং করছি। আমরা তো দিন রাতই বলছি, এ পোশাক ওকে মানাবে, সে পোশাক তাকে মানাবে। মোটাদের জন্য এক ধরনের পোশাক, স্লিমদের জন্য আরেক। লম্বাদের জন্য এক রকম, বেঁটেদের জন্য আরেক। তরুণীদের জন্য এক রকম, বৃদ্ধাদের জন্য আরেক। আওয়ারগ্লাস বডি হলে এক রকম, না হলে আরেক রকম। এসব বিভিন্ন পোশাক-কোম্পানিগুলোই তৈরি করে। ফ্যাশান ম্যাগাজিনগুলো বলে দেয় কার কী পরা উচিত। আমার ব্যক্তিগত মত, স্তন স্যাগ করলে পুশ আপ পরলে ভালো, বুক খোলা ব্রাহীন ড্রেস না পরাই ভালো। আর স্যাগ না করলে খোলা রেখে চললেও ঠিক আছে। এ বডিশেমিং নয়, বরং বডিশেমিং থেকে মেয়েদের বাঁচানো। এর নাম সত্য কথন। চরম তসলিমাবিদ্বেষীরাও তা জানে। জানে কিন্তু মুখে উল্টোটা বলবে।

এরা ঘেউ ঘেউ করবেই , বেঁটেকে বেঁটে কেন বললাম, লম্বাকে লম্বা কেন বললাম, মোটাকে মোটা কেন বললাম, স্লিমকে স্লিম কেন বললাম। সুন্দরকে সুন্দর কেন বললাম, তাহলে অসুন্দরদের তো বডি শেমিং করে ফেললাম, সুদর্শনকে সুদর্শন কেন বললাম, তাহলে তো কুদর্শনের বডি শেমিং করে ফেললাম, মোদ্দা কথা সর্বনাশ করে ফেললাম! আমি কাউকে বলিনি তুমি দেখতে বেঁটে তুমি লম্বা আলখাল্লা পরো না, আমি বলিনি, তোমার স্যাগিং স্তন, তুমি ভুলেও স্তন দেখানো ড্রেস পরো না। যার যে পোশাক পরার ইচ্ছে, সে পোশাক সে পরবে। আমার কোনটা ভালো লাগছে, কোনটা ভালো লাগছে না, তা আমি বলবো। এতে এত ঘেউ ঘেউএর কী আছে? ওয়েট, যদি বলিই তোমাকে এই পোশাকে মানাচ্ছে না, যদি উপদেশই দিই এটা পরো না, ওটা পরো, তাতে এত বিচলিত হওয়ার কারণ কী? আমি তো দিন রাত মেয়েদের উপদেশ দিচ্ছি, হিজাব বোরখা পরো না, ওসব পোশাক নারী নির্যাতনের প্রতীক, ওসব পোশাক পরলে নিরেট যৌনবস্তু ছাড়া তোমার আর কোনও পরিচয় থাকে না। আমার উপদেশ কজন মেয়েই বা শুনছে! কিন্তু আমি তো সারা জীবনই এই উপদেশ দিয়ে যাবো, আমার এই মত আমি প্রকাশ করবোই, যতই আমাকে ‘চয়েজ’বাদীরা গালি দিক।

নারীর অনেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে অনেকে মনে করে নারীর ‘লজ্জাস্থান’। লজ্জাস্থান নিয়ে কথা বলাটাই তাদের কাছে স্পর্ধা বলে মনে হয়েছে। সুতরাং আমার স্পর্ধা তারা মানবে কেন? তা না মানুক, আমার তো স্পর্ধা দেখাতে জুড়ি নেই।

সত্য কথন, বা ভিন্নমত কোনওকালেই সমাজের অধিকাংশ কূপমন্ডূক সহ্য করতে পারেনি। আজ হঠাৎ কী ঘটে গেল যে সহ্য করবে? আমি আশাও করি না। বিরুদ্ধ স্রোতে আমি জীবন ভর চলেছি। অতীতে চলেছি, আজও চলছি, যতদিন বাঁচি চলবো। এ নিয়ে আমার কোনও দুঃখ নেই।

৩. বন্দুক নিয়ে হেঁটে এলো এক লোক, বাচ্চাদের দিকে তাক করে গুলি ছুড়লো। অনেকগুলো বাচ্চা মরে গেল। রক্তে ভেসে গেল ক্লাসরুম, বা ইস্কুলের আঙিনা। এ নতুন কিছু নয় আমেরিকার জন্য। সেদিনই টেক্সাসের এক ইস্কুলে কুড়ি-একুশ জন বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে এক বন্দুকধারী।

আমেরিকার বন্দুক আইন সংশোধন করা সহজ নয়। কেন্দ্রে এক আইন, রাজ্যে রাজ্যে ভিন্ন আইন। মানুষ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা চায়। ১০ জনের মধ্যে ৪ জন আমেরিকানই ঘরে বন্দুক রাখে। তারা তাদের এই বন্দুক, তাদের এই স্বাধীনতা, এই নিরাপত্তা বিসর্জন দেবে না। সাদারা বন্দুক আইন যেমন আছে, তেমন থাকুক চায়। সাদারাই বন্দুক কারখানার মালিক, সাদারাই বন্দুক ক্লাবের সদস্য। সাদারাই ধনী। সাদারাই সরকার পোষে।

অতএব বন্দুক কোনও না কোনও লোকের হাতে আজ না হোক কাল পড়বে। তা নিয়ে সেই লোক মানুষ মারার মজা উপভোগ করতে কাছে পিঠের ইস্কুলে যাবে, যেহেতু ইস্কুলে আগেও এরকম বহুবার ‘মজা’ হয়েছে, সেহেতু এই মজাটা জায়েজ। তারপর লোকটি সাদা হলে তাকে মাথা খারাপ বলা হবে, কালো হলে তাকে ক্রিমিনাল বলা হবে, মুসলমান হলে তাকে জিহাদি বলা হবে। তারপর নটে গাছটি মুড়াবে। শাস্তি যে যার ধর্ম বর্ণ জাত অনুযায়ী পাবে। ওদিকে আরও কেউ তৈরি হতে থাকবে মানুষ মারার মজা লোটার জন্য। বড়রা মিসাইল ছোড়ে, তারা না হয় গুলি ছুড়ে হাত পাকায়। বড়দের কাছ থেকেই তো ছোটরা শেখে।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর