বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

তামাককে না বলুন

ডা. এ জেড এম মোস্তাক হোসেন

তামাককে না বলুন

তামাকের ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে ঘোষণা দিয়েছেন ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার। তিনিই বিশ্বের প্রথম কোনো সরকারপ্রধান যিনি এমন ঘোষণা দিলেন। তিনি শুধু দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণাই দেননি, বরং এ লক্ষ্য অর্জনে করণীয় সম্পর্কেও আলোকপাত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রথম পদক্ষেপে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবহার করে একটি তহবিল গঠন করা, যা দিয়ে দেশব্যাপী জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। দ্বিতীয় ধাপে আমরা তামাকের ওপর বর্তমান শুল্ক-কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক শুল্ক-নীতি গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেব। এর উদ্দেশ্য হবে দেশে তামাকজাত পণ্যের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস এবং একই সঙ্গে এ অঞ্চলের সর্বোত্তম ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের শুল্ক আয় বৃদ্ধি।

বাংলাদেশে পৌনে ৪ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। তামাক সেবনের ফলও ভয়াবহ। প্রতি বছর দেশে তামাকজনিত রোগে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায় এবং বছরে ৪ লাখ লোক হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে তামাক ব্যবহারের ফলে তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা ও উৎপাদনশীলতা নষ্ট হওয়ায় প্রতি বছর দেশে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে। এ ছাড়া তামাক চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, তামাকপণ্য উৎপাদন, কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস, বিড়ি/সিগারেটের ধোঁয়ায় পরিবেশগত ক্ষতি রয়েছে। সামগ্রিকভাবেই তামাক জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য বড় একটি হুমকি।

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির গবেষণায় (২০১৮) দেখা গেছে, দেশের ত্রিশোর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর ৯.১ শতাংশ তামাক ব্যবহারের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের রোগ ইত্যাদিতে আক্রান্ত। এ ছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বছরে প্রায় ৬১ হাজার শিশু ধূমপান না করেও তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে মৃত্যুবরণ করেন ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ। (সূত্র : টোব্যাকো অ্যাটলাস, ষষ্ঠ সংস্করণ)

হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার, মুখের ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে ২০১৬ অনুসারে বাংলাদেশে দরিদ্রতম ২০ শতাংশ পরিবারগুলো তামাকপণ্যের পেছনে তাদের আয়ের ২১% ব্যয় করে।

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭ অনুসারে একজন ধূমপায়ী প্রতি মাসে সিগারেটের পেছনে গড়ে ১ হাজার ৭৭ এবং বিড়ির পেছনে গড়ে ৩৪১ টাকা ব্যয় করেন। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর (১৬ বছর বা তদূর্ধ্ব) ৩৫.৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাক সেবন করেন। গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে ২০১৩ অনুসারে দেশের ১৩-১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬.৭ শতাংশ তামাক ব্যবহার করে।

দেশে তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার ২০০৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন করে। পরে ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়। বিশ্বজুড়ে অকালমৃত্যুর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতিরোধযোগ্য কারণ তামাক ব্যবহার। বিশ্বে প্রতি বছর ৬০ লাখের বেশি মানুষ তামাক ব্যবহারের কারণে মারা যায়। বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় ৭০০-এর বেশি বিষাক্ত রাসায়নিক থাকে, যার মধ্যে অন্তত ৭০টি কার্সিনোজেন রয়েছে যা মানবদেহের প্রায় প্রতিটি অঙ্গকে ক্ষতি করতে পারে।

ধূমপানের ফলে হৃদরোগ, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ, ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ হতে পারে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় এসব অসংক্রামক রোগে, যা মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশ। প্রতি বছর মোট মৃত্যুর ৩০ ভাগের পেছনে শুধু হৃদরোগ দায়ী। আর হৃদরোগসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের পেছনে অন্যতম কারণ তামাক ব্যবহার। ধূমপানের ফলে মৃত্যু বা অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি সিগারেটের সংখ্যার সমানুপাতে বৃদ্ধি পায়, তবে এক শলাকা সিগারেটও শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপায়ীদের নিয়মিত ধূমপানের কারণে গড়ে কমপক্ষে ১০-১১ বছর আয়ু কমে যায়। এ ছাড়া সেকেন্ডহ্যান্ড বা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে অধূমপায়ীরাও ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁঁকিতে পড়েন।

ফুসফুসের ক্যান্সার এখন বিশ্বে ক্যান্সার মৃত্যুর প্রধান কারণ। এটি দীর্ঘদিন ধরে পুরুষের মধ্যে ক্যান্সার মৃত্যুর প্রধান কারণ এবং অনেক দেশে এখন স্তন ক্যান্সারকে ছাড়িয়ে যাওয়া নারীর মধ্যে ক্যান্সার মৃত্যুর প্রধান কারণ। সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, দেশে নারীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ জরায়ু ও স্তন ক্যান্সার। অথচ বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, নারীদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হৃদরোগ। আর হৃদরোগের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ তামাকের ব্যবহার। আমাদের দেশে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীর মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাকদ্রব্য যেমন জর্দা, গুল ও সাদাপাতার ব্যবহার বেশি দেখা যায়। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭ অনুসারে দেশে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর প্রায় ২৫ শতাংশই ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করেন, যা তাদের স্বাস্থ্যঝুঁঁকি বাড়াচ্ছে। প্রায় ৩৭ শতাংশ নারী নিজের বাড়িতেই পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। এর বাইরে গণপরিবহনে ৩৮ ও কর্মক্ষেত্রে ১৯ শতাংশ নারী পরোক্ষ ধূমপানের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁঁকিতে পড়ছেন। আর পরোক্ষ ধূমপানের ফলে তারা ধূমপায়ীদের সমান স্বাস্থ্যক্ষতির শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশেও প্রচুর মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে অসুস্থতায় পতিত হচ্ছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ।

                লেখক : উপাচার্য, রাজশাহী          মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর