শুক্রবার, ৩ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

র‌্যাবকে আবার স্যালুট

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

র‌্যাবকে আবার স্যালুট

র‌্যাব যে দেশে আইনের শাসন রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে তার নতুন প্রমাণ মিলল ৩০ মে নরসিংদীতে। সেদিন র‌্যাব-১১-এর দক্ষ ও নিষ্ঠাবান সদস্যরা মার্জিয়া আখতারকে (যে একাধিক নামে পরিচিত বলে খবরে প্রকাশ) গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে, যে তার বোনের বাড়িতে পলাতক ছিল। এ সেই আসামি যে ২০ মে নরসিংদী রেলস্টেশনে এক মহিলাকে আধুনিক পোশাক পরিধানের কারণে হেনস্তা এবং মারধর করেছিল, যার সঙ্গে পরবর্তীতে যোগ দিয়েছিল আরও কয়েকজন দুষ্কৃতকারী। পুরো ঘটনাটি ইউটিউবে দেখা যাওয়ার সুবাদে এটি পরিষ্কার যে ভুক্তভোগী মহিলা কোনো অশালীন বা বেআইনি পোশাক পরিধান করেননি। তিনি আধুনিক পোশাকে সজ্জিত হলেও সেটি ছিল সম্পূর্ণ আইনসংগত ও শালীনতাপূর্ণ। কিন্তু আসামি মহিলা তার পরও সেই ভুক্তভোগীকে নাজেহাল করে, তার কাপড় ছিঁড়ে ফেলে; যা ইউটিউবে দেখা গেছে। সম্ভবত ভুক্তভোগী মহিলার পোশাক ওই আসামির রুচির সঙ্গে মেলেনি বলেই সে অপরাধমূলকভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে নরসিংদীতে বেড়াতে যাওয়া মহিলাকে নাজেহাল করেছিল। ভুক্তভোগী মহিলা এবং তার সঙ্গের দুজন অবশেষে স্টেশনমাস্টারের অফিসে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন। নয় তো তাদের ভাগ্যে আরও মারাত্মক কিছু ঘটতে পারত। স্টেশনমাস্টার সাহেব তাদের নিরাপদে ট্রেনে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেও দুর্ভাগ্যের কথা হলো, আসামিদের বিরুদ্ধে তিনি বা অন্য কেউ কোনো মামলা করলেন না, যদিও আসামিরা যা ঘটিয়েছে দৃশ্যত এবং আপাতদৃষ্টিতে তা আমাদের দন্ডবিধি ও নারী নির্যাতন আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমনকি পরে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঢেউ ওঠার পরও আসামিদের বিরুদ্ধে শুধু ৫৪ ধারায় মামলা হয়, যেখানে সুনির্দিষ্ট অপরাধের ঘটনার প্রাথমিক প্রমাণ রয়েছে। এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ও ১৫৬ ধারামতে যখনই কোনো ব্যক্তি কোনো আমলযোগ্য অপরাধের তথ্য প্রাপ্ত হন, তার ওপর দায়িত্ব বর্তায় এজাহার করার। সে অর্থে পুলিশ কোনো আমলযোগ্য অপরাধের তথ্য পেলে তাদের জন্যও এজাহার করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। পুলিশ এ অজুহাতে দায় এড়াতে পারে না এই যুুক্তি দেখিয়ে যে কেউ এজাহার করেনি। অবশেষে বিজ্ঞ আদালতকে মামলা দায়েরের আদেশ দিতে হয়েছিল এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব আইনের শাসন রক্ষায় যে ভূমিকা পালন করল তা নিশ্চিতভাবে প্রশংসার দাবিদার। সেই মহিলা, যাকে মূল আসামি হিসেবে দেখানো হয়েছে, তাকে, এমনকি সিসিটিভির ফুটেজ থেকেও চিহ্নিত করা সহজ ছিল না যদি সে বোরকা পরিহিত হয়ে থাকে, কেননা বোরকার আড়ালে মুখ চেনা দুষ্কর। সেই অর্থে র‌্যাব সদস্যরা মহিলাকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়ে তাদের অসাধারণ দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। তদপুরি সে যে তার বোনের বাড়িতে পালিয়ে ছিল সেটি বের করার জন্যও নিশ্চয়ই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল তথ্যপ্রযুক্তি আইনের প্রয়োগ। একান্ত নিষ্ঠাবান না হলে কেউ এত কিছু করে এই আসামিদের ধরতে পারত না। ভুক্তভোগী নারীর পোশাকে আধুনিকতা থাকলেও এটি নিশ্চিতভাবে অশালীন বা বেআইনি ছিল না। তা ছাড়া এমনকি বেআইনি পোশাকধারী কোনো মানুষকে হেনস্তা করার জন্য আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোনো ক্ষমতা কোনো আইন কাউকেই দেয়নি, এ দায়িত্ব একান্তই আইন প্রয়োগকারীদের হাতে ন্যস্ত। এ ধরনের আসামিরা তাদের ইচ্ছামাফিক যদি কোনো ব্যক্তির পোশাকের প্রতি অনীহার কারণে এভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে নিরীহ, নিরপরাধ ব্যক্তিদের ওপর চড়াও হতে সক্ষম হয়, তাহলে দেশে অচিরেই ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি হতে পারে। শালীনতা এবং আইনের বিধিবিধান বজায় রেখে কোনো ব্যক্তি কী ধরনের পোশাক পরবেন, তা একান্তই তার নিজস্ব রুচি এবং সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এ ব্যাপারে নাক গলানোর কোনো অধিকারই কারও নেই। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি তাদের রুচিমাফিক পোশাক পরার হুকুম জারি করার ক্ষমতা হস্তগত করতে চায়, তাহলে সেটি হবে রাবণ রাজত্ব প্রতিষ্ঠার শামিল, যা বাংলাদেশের মতো কোনো গণতান্ত্রিক দেশে চলতে দেওয়া যায় না। এমনকি সৌদি আরবেও মহিলাদের পোশাক-আশাক এবং অন্যান্য কর্মকান্ডের ব্যাপারে আমূল পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ, যথা লেবানন, কুয়েত, আরব আমিরাত, জর্ডান, সিরিয়া, লিবিয়া প্রভৃতি দেশে শালীনতার বিধান সাপেক্ষে মহিলাদের পোশাক বাছাই করার অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয় না। তুরস্কেও সেই স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ। প্যালেস্টাইনের বহু মুক্তিযোদ্ধাই নারী, যাদের মধ্যে অতীতের যোদ্ধা লায়লা খালেদের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যাঁকে প্যালেস্টাইনের চে গুয়েভারা বলে উল্লেখ করা হতো, তিনিও আধুনিক পোশাক পরেই যুদ্ধ করতেন। এ উপমহাদেশে ১২ শতকে তুর্কি বংশীয় সম্রাজ্ঞী সুলতানা রাজিয়াও দেশ শাসন করতেন সে সময়ের স্বীকৃত আধুনিক পোশাক পরে। মুঘল আমলে রানী ও যুবরাজ্ঞীরাও আধুনিক পোশাকই পরতেন যা আমরা দেখতে পাই যোধা আকবর, সম্রাট শাজাহান কন্যা জাহানারা, নুরজাহান, আনারকলি প্রমুখের ওপর অঙ্কিত ছবি দেখে। এ মুহূর্তে শুধু ইরান ও আফগানিস্তানে এ ধরনের বর্বরতা বিরাজ করছে। আগে আফগানিস্তানেও এ ধরনের সংকীর্ণতা ছিল না এবং সেখানে মহিলা ক্রিকেট দলও ছিল। কিন্তু সম্প্রতি তালেবানরা ক্ষমতায় এসে সব উলট-পালট করে দিয়েছে। র‌্যাবের এ কাজের জন্য সংস্থাটি নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার, বিশেষ করে সেসব দেশ থেকে যারা বর্বরতা ও সংকীর্ণতায় বিশ্বাস করে না। একাধিক নামধারী অভিযুক্ত এই মহিলা এবং অন্য আরেক আসামিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়ে এ ধরনের ত্রাসের সম্ভাবনা বন্ধ করার কারণে র‌্যাব নিশ্চয়ই সাধুবাদের দাবিদার। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী এই আসামির বিরুদ্ধে তিন দিনের রিমান্ড আদেশ দেওয়া হয়েছে। রিমান্ডকালে এই মহিলা কেন একাধিক নাম ব্যবহার করত, কী তার আসল পেশা, সে তথ্যগুলোও বেরিয়ে আসতে পারে। র‌্যাবের এই সফল এবং তড়িৎ সিদ্ধান্তের ফলে যারা সেই মহিলার মতো এভাবে নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়ে অপরাধমূলক ঘটনা ঘটানোর কথা ভাবছিল, তারা নিশ্চয়ই সতর্ক হয়ে যাবে। তারাও বুঝতে পারবে এভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নিলে তাদেরও একই পরিণতি ভোগ করতে হবে। এটিই যে শুধু র‌্যাবের সাফল্যের একমাত্র ঘটনা তা নয়। গত কয়েক বছরে র‌্যাব এমন অনেক অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হয়েছে যা একদিকে আইনের শাসন রক্ষায় বিশেষ অবদান রেখেছে, অন্যদিকে নাগরিক জীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। এমন একটি সময় ছিল যখন সন্ধ্যার পর মানুষ রাস্তায় বের হতে পারত না। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, চিকিৎসাসেবার নামে বেআইনি কর্মকান্ড, ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল, তারা চাচ্ছিল এসব অপরাধ দমনে কার্যকর পদক্ষেপ, আর জনগণের সেই দাবিই মেটাচ্ছেন র‌্যাব সদস্যরা। এটা সত্য যে, র‌্যাবের গুটিকয় সদস্য/কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার করে এমনকি বেআইনি হত্যাকান্ডও ঘটিয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের অপরাধকারী র‌্যাব সদস্যরা আইনের হাত থেকে রক্ষা পাননি, যার বড় প্রমাণ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের দায়ে কয়েকজন র‌্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ। আরও বেশ কিছু র‌্যাব সদস্যের বিভিন্ন অভিযোগে বিচার ও সাজা হয়েছে, যা আমরা গণমাধ্যমযোগে জেনেছি। যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই আইন প্রয়োগকারীরা যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এমনকি হত্যাকান্ডও ঘটিয়েছে এবং ঘটাচ্ছে, গণমাধ্যমযোগে আমরা সেই খবরও পেয়েছি। দেশে বা বিদেশে এ ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহার কোনো বিবেকবান মানুষই সমর্থন করতে পারে না। তদুপরি অন্য কোনো দেশে বেআইনি কাজ হয়েছে, সেই অজুহাতে আমাদের দেশেও এর পক্ষে যুক্তি থাকতে পারে না। আমি বিদেশে এ ধরনের অপরাধের কথা এজন্যই বলছি যে, প্রতিটি দেশের কর্তৃপক্ষের উচিত অন্য দেশের ব্যাপারে কথা বলার আগে নিজের দেশে কী হচ্ছে তা অবলোকন করা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ আমাদের র‌্যাবের বিরুদ্ধে যেসব সিদ্ধান্ত নিল, তার আগে তাদের নিজের দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। আমরা জানি আমাদের দেশের একটি উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক মহল বেআইনিভাবে বিদেশি মুদ্রা পাচার করে লবিস্ট নিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করেছে, যা শুধু অর্থ পাচার আইনেই অপরাধ নয়, দেশদ্রোহিতাও বটে। উল্লেখযোগ্য যে, তাদের শাসনামলে তাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসনিক নির্দেশে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে বহু ব্যক্তিকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা, পঙ্গু, কঠোর নির্যাতন এবং গুম করা হয়েছিল এবং অপরাধীদের রক্ষা করার জন্য ২০০৩ সালে একটি ইনডেমনিটি আইনও করা হয়েছিল, যদিও সে আইন হাই কোর্টের আদেশবলে বাতিল হয়ে গিয়েছিল। অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে যে বহু লোককে বিচারবহির্ভূতভাবে খুন, জখম, গুম, আটক করা হয়েছিল, মহামান্য হাই কোর্টের রায়েই তার উল্লেখ রয়েছে। র‌্যাব সদস্যরা যে আমাদের দেশে আইনের শাসন, অপ্রতিরোধ্য অপরাধ দমন করে জনগণের মঙ্গল সাধন করছেন, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন এবং এসব কারণে র‌্যাব যে একটি জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সে কথাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। অনেকেই আছেন যারা র‌্যাববিরোধী। কিন্তু র‌্যাবের কর্মকান্ডে সন্তুষ্ট এমন লোকের সংখ্যাই অনেক বেশি। কিছু লোকের সমালোচনার পরও র‌্যাব যে তাদের অপরাধ দমন কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর, ৩০ মে সেই অভিযুক্ত মহিলাকে গ্রেফতার করে সংস্থাটি পুনরায় তা প্রমাণ করল। অপরাধ দমনে কঠোর ব্যবস্থার এবং আইনের শাসনের সমর্থকরা নিশ্চিতভাবে র‌্যাবের দৃঢ়তা সমর্থন করে যাবে। দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করে র‌্যাবের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

                লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর