শুক্রবার, ৩ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

প্রাণ আসুক হারিয়ে যাওয়া খালে

স্বপন খন্দকার

প্রাণ আসুক হারিয়ে যাওয়া খালে

গাঢ় সবুজ প্রকৃতি, নীল শুভ্র আকাশের ঠিকানা ছিল বরিশাল। পাম, দেবদারু আর লাল সুরকি বিছানো পথের দুই পাশে ঝাউয়ের সারি এক অপরূপ সৌন্দর্যের কথাই দেশময় প্রচার করত। তবে এসব সৌন্দর্যের কেন্দ্রেই ছিল ছন্দময় প্রবহমান আঁকাবাঁকা খাল। এক কথায় ‘বাংলার ভেনিস’। আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের এমন উপমাকে কবিতায় রূপ দিতেই এ শহরে একদিন জন্মেছিলেন রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ- ‘বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ আমি খুঁজিতে যাই না আর’। বর্ষা এলে বরিশাল জেগে ওঠে ছন্দময় জলের ধারায়। মনে হয় যেন বরিশাল একটি খালের শহর। একবার ভেবে দেখলে কেমন মনে হবে যে, বরিশাল শহরের মধ্যে মানুষ খেয়ানৌকায় পারাপার হচ্ছে! পাঠকমাত্রই বিস্মিত হতে পারেন। ২০০ বছরের প্রাচীন বরিশাল কিন্তু তেমনই ছিল। ঐতিহাসিক রেকর্ডপত্র তেমনই সাক্ষ্য দেয়। শিশুপাঠ্যের বর্ণনার ‘... ওরে ভোঁদড় ফিরে চা খোকার নাচন দেখে যা’ এমন সরস শিশুতোষ লেখার ভোঁদড় এই সেদিনও খেলা করেছে জেল খালের জেলেবাড়ির ঘাটে। এগুলো গল্প নয়, আশি-নব্বইয়ের দশকেই জেলেনৌকার গলুইয়ের সঙ্গে বাঁধা থাকত ভোঁদড়। পৌর শহরের মধ্যেই বাস করত জেলে সম্প্রদায়। খালের শহর বরিশালের এসব কথা এখন হারানো ইতিহাস। শুধু ইতিহাস কেন, বাংলা সাহিত্যে বাঙালির আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন-প্রবাহের যে প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত রয়েছে সেখানকার সব উপাদানেও রয়েছে বরিশালের খালের ঐতিহ্যের কথা। ১৯২০ সালে কাজী নজরুল ইসলাম একবার দুই দিনের সফরে বরিশাল আসেন। গবেষক ও লেখক আনিসুর রহমান খানের এক নিবন্ধে উল্লেখ রয়েছে- লেখক বরিশালে রূপ ও প্রকৃতির দুটি বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ করেন। এর একটি হচ্ছে বরিশালের রূপ-লাবণ্যে ভেনিস শহরের সাদৃশ্য রয়েছে। তখনই বরিশালকে ‘প্রাচ্যের ভেনিস’ নামে ডাকেন।

১৯০৫ বঙ্গভঙ্গের পর ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন। ১৫ আগস্ট দুপুরে তিনি জলপথে বরিশাল এসে পৌঁছলেন। উদ্দেশ্য বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেওয়া এবং সভাপতিত্ব করা। সে সময় বরিশালে প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশন নিয়ে পুলিশের সংঘাত ও উত্তেজনা চলছিল। খবর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ বরিশালের ভাটার খালে তাঁর বজরাতেই অবস্থান করেন। সন্ধ্যায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ নেতৃবৃন্দ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পরিস্থিতি বর্ণনা করেন। বরিশালে খালের রূপ-প্রকৃতি ও ঐতিহ্য কবিগুরুকে যে কতখানি প্রভাবিত করেছিল তার ছায়া পাওয়া যায় ‘বউ- ঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসে। বাংলার বারো ভূঁইয়ার অন্যতম রাজা রামচন্দ্রের রাজধানী মাধবপাশায়। বারো ভূঁইয়ার অন্যতম রাজা যশরাজ প্রতাপাদিত্যের কন্যা বিভাবতীকে বিয়ে করেন রাজা রামচন্দ্র। শ্বশুরালয়ে তাঁকে হত্যা করে রাজ্য দখলের কথা জানতে পারেন রামচন্দ্র। তাই স্ত্রীকে রেখে বরিশালে পালিয়ে আসেন। পরে স্বামী রামচন্দ্রের খোঁজে বরিশালে আসেন বিভাবতী। কিন্তু রাজা তাঁকে গ্রহণ করেননি। বাড়ির কাছের খালে বজরাতেই অবস্থান করেন রানী বিভাবতী। রানীকে কেন্দ্র করে সেখানে যে হাট জমে ওঠে তাই ‘বউ-ঠাকুরানীর হাট’।

দখল-দূষণ আর নাগরিক মানুষের অবহেলায় অনেক খাল এখন নিশ্চিহ্ন। খাল ভরাট করে কোথাও গড়ে তোলা হয়েছে মার্কেট, রাস্তাও নির্মাণ হয়েছে। এখন ১২টির মতো হতশ্রী খাল টিকে আছে তার অস্তিত্ব নিয়ে। কোনো কোনো খালকে লাগোয়া বাড়ির মালিকরা ভাগাড়ে পরিণত করে ফেলেছেন। ২০০ বছরের বেশি পুরনো বরিশাল শহর গড়ে উঠেছিল মাত্র আড়াই বর্গমাইল এলাকা নিয়ে। বগুড়া, আলেকান্দা, আমানতগঞ্জ ও কাউনিয়া এ চার মৌজা নিয়েই ছিল বরিশাল শহর। সে সময় এর লোকসংখ্যা ছিল ৬ হাজার। কীর্তনখোলা নদী আর বরিশাল অবিচ্ছেদ্য ধারা। ২২ খালের উৎস কীর্তনখোলা নদী। এর মধ্যে জেল খাল, সাগরদী খাল, আমানতগঞ্জ খাল, ভাটার খাল, রায়ের খাল, নাপিতখালী খাল অন্যতম। এ খালগুলোর ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। জীবন ও প্রকৃতিকে এগিয়ে নেওয়া এবং প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে যুগ যুগ ধরে অবদান রাখছিল এসব খাল। মহানগরের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, খালগুলো ঘিরেই এখানকার সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল। জেল খালের উদাহরণ দিয়েই বলি, ৫.২ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল। পুবে কীর্তনখোলা নদী থেকে শুরু হয়েছে। মিশেছে উত্তর-পশ্চিমে সন্ধ্যা নদীতে। কীর্তনখোলার মোহনায় খালের পাশে ২০০ বছরের প্রাচীন হাটখোলা হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র। যতই পশ্চিমে যাবেন দেখা মিলবে নানা স্থাপনা ও বসতি। প্রবহমান ধারার পাশেই রয়েছে প্রাচীনকালের বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার। এর কারণেই নাম জেল খাল। বরিশাল শহরের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন কাঁচাবাজার। বরিশালের প্রথম বৃহৎ চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র অর্থাৎ জেনারেল হাসপাতাল।

এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ভেনিস শহরের সেই খাল সহসা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোথাও কোথাও পাওয়া গেলেও জোয়ার-ভাটার প্রবাহ নেই। সংকীর্ণ ক্ষীণধারা রয়েছে। এসব খাল বন্যা ও বর্ষার পানি ধরে রাখতে পারছে না। শহরের প্রবীণ অধিবাসীদের মতে, দেশ স্বাধীনের পর থেকেই এমন অবস্থা চলছে। বিশেষ করে ১৯৯২ সালে বরিশাল প্রশাসনিক বিভাগে উন্নীত হওয়ার পর থেকে খালগুলোর বৈশিষ্ট্য লোপ পেতে থাকে। পরবর্তীকালে বরিশাল পৌরসভা সিটি করপোরেশনে উন্নীত হলে ‘শহরের প্রাণ’ খালগুলোর অস্তিত্ব সংকট দেখা দেয়। এর মূল কারণ অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ। এতে চাপে পড়ে যায় খালগুলো। কোথাও ভরাট হয়েছে, কোথাও খালের জমি দখল করে স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এ কারণে নগর তার প্রাকৃতিক রূপ-সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে। কয়েক বছর ধরে দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়া বরিশালের খালগুলো উদ্ধারে চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার ও নাগরিক প্রতিষ্ঠানগুলো। সুফল খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। এবার মহানগরের সাতটি খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আইনি কাঠামোর মধ্যে না এনে খালগুলো সংস্কার ও দখলমুক্ত করে উন্নয়ন করা হলে তা টেকসই হবে না। সবই করতে হবে আইনি কাঠামোর আওতায়। তাহলে খালগুলোর প্রাণবৈচিত্র্য ফিরে আসতে পারে। হতে পারে যুগোপযোগী টেকসই উন্নয়ন। জোয়ার-ভাটার প্রবাহে জলের যে কলরব আসবে তাতেই প্রাণ ফিরে পেতে পারে খালগুলো।

                লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর