শনিবার, ৪ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

প্রাণিখাদ্যের দামেও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

শাইখ সিরাজ

প্রাণিখাদ্যের দামেও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

ঢাকা কলেজে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে গ্রামে ফিরে কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছিলেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার সুমন-উজ-জামান সুমন। বয়স ২৭-২৮ হবে। টগবগে তারুণ্য যাকে বলে তাই যেন তার ভিতর দেখতে পাই। ‘শৈশব থেকে আপনার কৃষি অনুষ্ঠান দেখে দেখে পণ করেছিলাম লেখাপড়া শেষ করে কৃষি খামার গড়ব। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির চেষ্টাও করিনি। গ্রামে ফিরে শুরু করি পোলট্রি খামার আর মাছ চাষ। আলহামদুলিল্লাহ শুরুটা ভালোই ছিল। কিন্তু বছর দু-এক ধরে প্রাণিখাদ্যের দাম যে রকম অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে, তার সঙ্গে তাল মেলানোটা কঠিন হয়ে পড়েছে। খাদ্যের দাম বাড়লেও খাবার না দিয়ে তো মুরগি আর মাছ রাখা যাবে না। লাভের আশা বাদ দিয়েছি এখন আসল নিয়ে টানাটানি।’ একই সুর ওই এলাকার অন্য খামারিদের কণ্ঠেও। তারা বলছেন, পোলট্রি খাবার, মাছের কিংবা গবাদি পশুর খাবার সবকিছুরই দাম বেড়েছে লাগামহীন। একই এলাকার বেতবাড়ী গ্রামের আতাউর রহমান। ২৬ বছর ধরে মাছ চাষ করছেন। ভালোই ছিলেন মাছ চাষ করে। তবে গত কয়েক বছর ধরে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধিতে দিশাহারা হয়ে উঠেছেন। দিন দিন কমিয়ে আনছেন মাছ চাষের পরিধি। বলছিলেন, ‘রাত পোহালেই পানিতে ঢালতে হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। যে হারে মাছের খাদ্যের দাম বেড়েছে সে হারে মাছের দাম তো বাড়ে না, বছর বছর লোকসান গুনতে হচ্ছে।’

গত দুই দশকে পোলট্রি শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলায়ও। এ এলাকার বহু খামার এখন বন্ধ। অথচ একেকটি খামার ছিল একেকটি স্বপ্নের উদ্যোগ। যা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে খাদ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, এক দিনের বাচ্চার মূল্যবৃদ্ধিসহ নানারকম প্রতিবন্ধকতায়। যত দূর জানা যায়, দেশে পোলট্রি শিল্পে বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার। অন্তত ৬০ লাখ মানুষ কর্মরত রয়েছেন এ শিল্পে। এখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবিকা নির্বাহ করছে ১ কোটির বেশি মানুষ। এ খাত শুধু দেশের মানুষের আমিষেরই চাহিদা মেটাচ্ছে না, লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও দারুণ ভূমিকা রাখছে। অথচ নানা অনিয়ম ও উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে বহু খামার। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার হাবিবুল্লাহ বাহার সুজন ১২ হাজার মুরগি নিয়ে পোলট্রি খামার গড়েছিলেন বছর দশেক আগে। ভালোই লাভ হচ্ছিল। পাঁচ বছরে আয়তনে দ্বিগুণ হয় খামার। কিন্তু মুরগির খাবারের দাম বৃদ্ধির কাছে পরাজিত হয়ে ধীরে ধীরে খামার গুটিয়ে আনতে হয়েছে তার। বললেন, ‘লোকসান হলেও দিন বদলাবে এই ভেবে লাভের আশায় বছরখানেক চালিয়েছি খামার। দিন তো বদলায়ইনি, আরও খারাপ হয়েছে পরিস্থিতি। ভারী হয়েছে ঋণের বোঝা। গত মার্চেও যে পোলট্রি খাবারের দাম ৫৫-৬০ টাকা ছিল এখন তা ১১০-১১৫ টাকা। এ দুই মাসে দফায় দফায় বেড়েছে খাবারের দাম। আমাদের দেখার কেউ নেই।’ একই পরিস্থিতি গবাদি পশুর খাবারের দামের ক্ষেত্রেও। রাজধানীর বেড়িবাঁধ এলাকায় গড়ে উঠেছে বেশ কিছু গবাদি পশুর খামার। দিন তিনেক আগে সেখান থেকে ঘুরে এলাম। আল মদিনা ডেইরি ফার্মের ব্যবস্থাপক রাজীব বলছিলেন, ‘প্রাণিখাদ্যের দাম যেন প্রতিদিনই বাড়ছে। গতকাল যে বস্তা কিনে আনলাম ১৯৫০ টাকায়, আজ তার দাম ২০২০ টাকা। এভাবে দাম বাড়ছে। গম, ভুসি, কুঁড়া কিংবা ডালের খইল সবকিছুর দাম বেড়ে চলেছে। গরুকে তো প্রতিদিনই খাবার দিতে হবে। বর্ধিত দামেই কিনতে বাধ্য হচ্ছি। কোরবানি সামনে রেখে যাঁরা গরু মোটাতাজা করছেন তাঁরা আছেন লোকসানের আশঙ্কায়।’ অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারি আঙুল তোলেন বড় বড় প্রাণিখাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের দিকেও। তাঁরা মনে করেন, বড় বড় প্রতিষ্ঠান নিজেরাই বড় বড় খামার তৈরি করেছে। নিজেদের তৈরি খাবার তারা নিজেদের খামারে ব্যবহার করছে, ফলে ছোট এবং খাবারের দাম ইচ্ছামতো বাড়িয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের বিপাকে ফেলছে।

খামারিদের কথা শুনে প্রাণিখাদ্য বিক্রেতা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলি। তাঁরা শোনান আরও সংকটের কথা। বলেন, প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে কাঁচামালের দাম। এর কারণ হিসেবে তাঁরা সামনে আনলেন করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সয়ামিল রপ্তানি চালু রাখা ও গম আমদানি কমে যাওয়ার বিষয়গুলো। খোঁজ নিয়ে জানলাম গত দুই বছরে কোনো কোনো খাদ্য উপকরণের দাম বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশের মতো। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত দুই বছরে সয়াবিন মিলের দাম বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। অন্য কাঁচামালের দাম বেড়েছে ১২৩ শতাংশ পর্যন্ত। বর্তমানে কাঁচামালসহ মোট উৎপাদন খরচ এতটাই বাড়ন্ত যে প্রতি কেজি ব্রয়লার ফিডে ৩-৪, লেয়ার ফিডে ২.৫-৩.৫, ক্যাটেল ফিডে ৩.৫-৪, ডুবন্ত ফিশ ফিডে ২.৫-৩.৫ ও ভাসমান ফিশ ফিডে ৪-৫ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ফিড মিলগুলো তাদের উৎপাদন কমিয়ে ফেলেছে ১৫-২০ শতাংশ। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছি কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় থমকে যাচ্ছে প্রাণিখাদ্য উৎপাদন। এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ফিড মিল বন্ধ হয়েছে। কাঁচামালের দাম বাড়ায় তাদের কেজিতে লোকসান হচ্ছে ৫ টাকা পর্যন্ত। টাঙ্গাইলের সাগরদিঘির আদর্শ এগ্রো ফিডের স্বত্বাধিকারী আবু বক্কর সিদ্দিক জানালেন কাঁচামালের বাজার পরিস্থিতি। তিনি বলেন, ‘ভুট্টার কেজি ছিল ২৪-২৫ টাকা, এখন ৩৫ টাকা। ৩৭ টাকার সয়াবিন মিলের দাম হয়েছে ৭০ টাকা। রাইস পলিস যেটা ২১ টাকা ছিল এখন ৩৭ টাকার ওপরে। ৫০-৫৫ টাকার পোলট্রি মিল ১১০-১১৫ টাকায় এবং ১০০ টাকার ফিশ মিল কিনতে হচ্ছে ১৫০ টাকায়। দামের কারণে খামারিরা খামারই বন্ধ করে দিচ্ছেন। বাধ্য হয়ে আমাদেরও উৎপাদন কমাতে হচ্ছে। ব্যবসা খারাপ।’

সংশ্লিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছি সয়ামিলের সংকট অনেকটাই কৃত্রিম। দেশের সয়ামিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সয়াবিন বীজ আমদানি করে শুল্কমুক্তভাবে। প্রতিষ্ঠানগুলো সয়াবিন তেল উৎপাদনের পাশাপাশি উপজাত হিসেবে পাওয়া সয়ামিল স্থানীয় বাজারে বিক্রি করত। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদার কারণে শূন্য শুল্ক সুবিধায় আনা সয়াবিন বীজ থেকে উৎপাদিত সয়ামিল তিন-চারটি সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী কোম্পানি বেশি মুনাফার লোভে রপ্তানি করে দিচ্ছে। প্রাণিখাদ্য শিল্পের ৮০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। কাঁচামালের মূল্য যেমন বেড়েছে, অন্যদিকে ডলারের দাম বাড়ারও প্রভাব পড়ছে প্রাণিখাদ্যের দামে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী দেশে নিবন্ধিত হাঁস-মুরগির খামারির সংখ্যা ৯০ হাজার। তবে নিবন্ধিত- অনিবন্ধিত মিলে সারা দেশে রয়েছে ১ লাখের বেশি হাঁস-মুরগির খামার। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) বলছে, লোকসানে ব্যবসা টানতে না পেরে ৪০ শতাংশের বেশি খামারি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। পোলট্রি ও প্রাণিসম্পদ খাত খুবই সংকটময় সময় পার করছে। করোনায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনতে না গুনতেই বারবার প্রাণিখাদ্য ও উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এ খাতটি সংকটের মধ্যেই রয়ে গেছে। অসামঞ্জস্য বাজারমূল্যের সিন্ডিকেট থেকে মুক্ত হয়ে ভোক্তার কাছে ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের উৎপাদন করে সরবরাহ যেমন নিশ্চিত করা জরুরি; একইভাবে উৎপাদকের টিকে থাকার প্রশ্নে আসন্ন বাজেটে পোলট্রি ও ফিড ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানির ওপর শুল্ক সুবিধা বাড়াতে হবে। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও উপকরণ আমদানিতে কর কমাতে হবে। যা নিয়ে আমি গত দেড় দশকে কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেটের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে খামারিদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের কাছে বারবার পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু আদতে এ খাতটি টিকিয়ে রাখার কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। কাগজে-কলমে আইন থাকলেও বাস্তবে বড় ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নিজেদের মতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে দেশে প্রাণি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার খামারির সংকট তীব্রতর হয়ে উঠছে। এ সংকট নিরসনে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ কথা সত্য, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য উপকরণের দাম বেড়েছে। বেড়েছে আমদানি ব্যয়। কিন্তু এ সুযোগ ব্যবহার করে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীও সুযোগ নেওয়ার চেষ্টারত। প্রাণিখাদ্যের বাজারে কার্যকর মনিটরিং যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি সুষ্ঠু নীতিমালার আওতায় আনা না গেলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা কৃষিজ এ শিল্পের ক্ষতি মানে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি, তথা দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদায় তৈরি হতে পারে ঘাটতি। এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে, সংকট নিরসনে হতে হবে উদ্যোগী।

 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর