শনিবার, ৪ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

চা শিল্প ও চা শ্রমিকদের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান

ড. মো. আশ্রাফুল করিম

চা শিল্প ও চা শ্রমিকদের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান

পুণ্যভূমি, দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ কিংবা শ্রীভূমি, শ্রীহট্ট, সিলহট, ছিলট, জালালাবাদ ইত্যাদি নামে বিভিন্ন সময় নামকরণ হলেও বর্তমানে বৃহত্তর সিলেট তথা সিলেট বিভাগ হিসেবে পরিচিত এ ভূখন্ডটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত। হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও সুনামগঞ্জ এ চার জেলার সমন্বয়ে বৃহত্তর সিলেট গঠিত। ১৯৯৫ সালের ১ আগস্ট সিলেট বিভাগ আনুষ্ঠানিক যাত্রা করে। সিলেট বিভাগের তিন দিক ভারতের তিনটি রাজ্য দ্বারা পরিবেষ্টিত, অর্থাৎ সিলেট বিভাগের উত্তরে মেঘালয়, দক্ষিণে ত্রিপুরা, পুবে আসাম রাজ্য এবং পশ্চিমে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ। সিলেট শহরের উপকণ্ঠে ১৮৫৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা-আবাদ মালনিছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, প্রায় একই সময়ে ভারতের আসামেও প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। চা গাছ বৃদ্ধিতে আরণ্যক পরিবেশ প্রয়োজন, এরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে বৃহত্তর সিলেটে চা চাষের সূচনা হয়েছিল।

বাংলাদেশের প্রায় ১৬৭টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৫টি (সিলেটে ১৯, মৌলভীবাজারে ৯১, হবিগঞ্জে ২৫) বৃহত্তর সিলেটে গড়ে উঠেছে। চা বাগানে বসবাসরত প্রায় সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী চা শ্রমিকের আদি আবাসস্থল ভারতের আসাম, বিহার, ওড়িশা, মাদ্রাজ, পশ্চিমবঙ্গ, গুয়াহাটি, ছোটনাগপুর, উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশ। প্রায় ১৭০ বছর ধরে বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা শতাধিক ও জনসংখ্যা ৫ লাখ। চা শিল্পের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ করে চা চাষ ও এর উৎপাদন বৃদ্ধি, চায়ের গুণগতমান রক্ষা, বিদেশে চা রপ্তানি বৃদ্ধিতে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখা, চা ব্যবসায় জড়িতদের প্রয়োজনীয় লাইসেন্স ইস্যু ও সময়মতো নবায়নের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি বিষয়ে অফিশিয়াল সিদ্ধান্ত ও তার যথাযথ বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্যে ১৯৫০ সালে পাকিস্তান টি অ্যাক্টের আলোকে পাকিস্তান টি বোর্ড গঠন করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প মন্ত্রী এস এম সলিম এ বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান। উল্লেখ্য, পাকিস্তান টি বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান হিসেবে ৪ জুন ১৯৫৭ থেকে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৭ সালের ৪ জুন প্রথম বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান টি বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে যোগদানের ঐতিহাসিক দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের আলোকে ২০২১ সাল থেকে প্রতি বছর ৪ জুনকে জাতীয় চা দিবস হিসেবে উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২০২১ সালের চা দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, চা-শিল্পের প্রসার।’ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান টি বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে চা শিল্পের উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অবদান হলো, চা শ্রমিকদের স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ। এ অবদানের কথা চা শ্রমিকরা আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। এ ছাড়া তিনি চা ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উচ্চফলনশীল বীজ উদ্ভাবনের সক্ষমতা অর্জনের পদক্ষেপ গ্রহণ, স্বাধীনতাযুদ্ধের পর মালিকানাবিহীন ও পরিত্যক্ত চা বাগানগুলোর পুনর্বাসনের নির্দেশনা, চা গবেষণা স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউটে রূপান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং চা শ্রমিকদের বিনামূল্যে বাসস্থানের ব্যবস্থা, রেশন, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

কিন্তু পরে এর ধারাবাহিকতা আর রক্ষিত হয়নি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে চা শ্রমিকদের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। তারাও বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশকে স্বাধীন করতে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করেননি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রায় ৬০৩ জন চা শ্রমিক শহীদ হন, আহত হন অনেকেই এবং অনেক নারী চা শ্রমিক পাক সেনাদের দ্বারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। অনেক নারী চা শ্রমিক বিভিন্ন চা বাগানের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে রুটি বানানোর অর্থাৎ রান্নাবান্নার কাজও করেছেন বলে জানা যায়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান থাকা সত্ত্বেও তারা স্বাধীনতার সুফল প্রাপ্তি থেকে অনেকটাই বঞ্চিত বললে ভুল বলা হবে না। দেশের অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রাখা সত্ত্বেও বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানে যুগ যুগ ধরে বসবাসরত অবহেলিত চা শ্রমিকদের কল্যাণার্থে বঙ্গবন্ধুর পর তেমন বৈপ্লবিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। বর্তমান সরকারের উচিত বঙ্গবন্ধু চা শ্রমিকদের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে যেসব বাস্তবধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তার সফল বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্ন সার্থক করে তোলা।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর