রবিবার, ৫ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

মজুদদার ও ভোক্তা আইন কার পক্ষে?

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

মজুদদার ও ভোক্তা আইন কার পক্ষে?

বেশ কিছুদিন ধরে ভোজ্য তেল আর খাদ্যশস্যের মজুদ ইস্যু নিয়ে আলোচনা-  সমালোচনা চলছে। দেশের বিভিন্ন গুদামে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হচ্ছে হাজার হাজার লিটার তেল ও খাদ্যশস্য। প্রশ্ন উঠেছে, গুদামে তেল ও খাদ্যশস্য রাখা বৈধ না অবৈধ? এ বিষয়ে আইন কী বলে। ব্যবসায়ীরা কতটুকু, কত দিনের জন্য মজুদ রাখতে পারেন, বেশি মজুদ রাখলে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কী কী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়, আইন ব্যবসায়ীদের পক্ষে, না ভোক্তাদের পক্ষে, না নিরপেক্ষ- সেসব বিষয়ে আইনি আলোচনা নিয়ে আজকের নিবন্ধ।

প্রচলিত আইনে বলা হয়েছে, একজন পাইকারি বিক্রেতা সর্বোচ্চ ৩০ মেট্রিক টন পরিমাণ পাম ও সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ৩০ দিন মজুদ রাখতে পারবেন। আর একজন খুচরা বিক্রেতা সর্বোচ্চ ৫ টন পরিমাণের পাম ও সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ২০ দিন মজুদ রাখতে পারবেন। একইভাবে একজন আমদানিকারকও তার মোট আমদানিকৃত পাম বা সয়াবিন তেলের ২৫ ভাগ সর্বোচ্চ ৬০ দিন পর্যন্ত মজুদ রাখতে পারবেন। শুধু ভোজ্য তেল নয়, কন্ট্রোল অব কমোডিটিকস অ্যাক্ট, ১৯৫৬-এর সেকশন ৩ অনুযায়ী ‘সরকার বা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী এক মেট্রিক টনের অধিক খাদ্যশস্য বা খাদ্যসামগ্রী তার অধিকারে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না।’ খাদ্যশস্য বলতে এখানে ধান ও চালকে বোঝানো হয়েছে। অন্যদিকে চাল ও গমের ক্ষেত্রে সরকারের মজুদ আইনের নীতিমালায় এর ভিন্নতা রয়েছে।

সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ১৫ দিনে একটি রাইস মিল যে পরিমাণ ধান থেকে চাল প্রসেসিং করতে সক্ষম, ওই সময়ের মধ্যে উৎপাদন ক্ষমতার পাঁচ গুণ ধান ও দ্বিগুণ চাল মিল মালিকরা মজুদ রাখতে পারবেন। এ পরিমাণ ধান-চাল সর্বোচ্চ ৩০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুদদারি নিষিদ্ধ করে এ অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনের ২৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কেউ মজুদদারি বা কালোবাজারে লেনদেনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তার মৃত্যুদন্ড, আজীবন কারাদন্ড বা ১৪ বছরের কারাদন্ড হতে পারে। যদি প্রমাণ হয় যে মজুদদার কোনো লাভের জন্য পণ্য মজুদ করেনি, তাহলে তিন মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত হতে হবে।’ একই আইনের ২৫(ঘ) ধারায় বলা আছে, বিশেষ ক্ষমতা আইনে যেসব কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে সেসব কাজ করার চেষ্টা বা কাজ করায় সহযোগিতাও অপরাধ হবে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে মৃত্যুদন্ডের সাজা হলে দোষী ব্যক্তিকে ৩৪(ক) ধারা অনুসারে ফাঁসি দিয়ে বা নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসারে গুলি করে দন্ড কার্যকরেরও বিধান রয়েছে। মজুদদারির অপরাধে বাংলাদেশে কারও মৃত্যুদন্ড, আজীবন কারাদন্ড বা ১৪ বছরের কারাদন্ড হয়েছে এমন নজির বিরল। তাহলে আমরা কী বলতে পারি যে বাংলাদেশে কোনো কালোবাজারি, মজুদদার নেই!

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে কোনো পণ্য গুদামজাত করার অপরাধে কারখানা, দোকান, গুদাম সাময়িক বন্ধ করার; পণ্য যথাযথভাবে বিক্রি ও সরবরাহ না করলে সর্বোচ্চ এক বছরের শাস্তি ও জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু এ আইনে মজুদদার ও কালোবাজারি বিষয়ে কিছুই বলা নেই। আবার প্রাইস কন্ট্রোল অ্যান্ড অ্যান্টি হোর্ডিং অ্যাক্ট, ১৯৫৩-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ব্যবসায়ীরা সুবিধাজনক জায়গায় বা নিজেদের দোকান ও গুদামের সামনে পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য তালিকা প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য থাকবে। নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রয়ের তারিখ ও মেয়াদ সরকার নির্ধারণ করে দিতে পারবে।’ ধারা ৮-এ বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যবসায়ী সরকারের দেওয়া পূর্ব-কর্তৃত্ব ছাড়া কোনো ব্যক্তির কাছে কোনো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বিক্রি আটকে রাখতে পারবে না বা বিক্রি করতে অস্বীকার করতে পারবে না। এ আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদন্ড বা ১ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।’ পণ্য অতিরিক্ত মূল্যে কেনার মাধ্যমে আপনি যদি ক্ষতির শিকার হন কিংবা পণ্য বা সেবা কেনায় প্রতারিত হন তাহলে ৩০ দিনের মধ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে আবেদন করতে পারেন। অভিযোগের সঙ্গে প্রমাণাদি থাকলে যেমন যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেটার প্রদত্ত বিল বা পণ্য সেবার ক্যাশ মেমো এবং যদি দৃশ্যমান জিনিস হয় তার ছবি থাকলে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন। অধিদফতরের মহাপরিচালক কিংবা অধিদফতরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে অপরাধটি সম্পর্কে লিখিত অভিযোগ করতে হবে। এতে আপনার নাম, মা ও বাবার নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, ফ্যাক্স ও  ই-মেল (যদি থাকে) উল্লেখ করতে হবে। অধিদফতরের ওয়েবসাইট থেকে অভিযোগের ফরমটি ডাউনলোড করে নিতে পারেন। প্রিন্ট করে তাতে তথ্য ও বিবরণগুলো লিপিবদ্ধ করুন। যেসব জেলায় অধিদফতরের শাখা নেই, সেসব জেলায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর আবেদন করতে হবে। সরাসরি বা ডাকযোগে পাঠাতে পারবেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে। তবে ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন না করলে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ আপনাকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রদান করা হবে। এ আইনের অধীনে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হয়। জরিমানা ছাড়াও ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল, ব্যবসায়িক কার্যক্রম সাময়িক বা স্থায়ীভাবে স্থগিতও করতে পারে অধিদফতর।

লেখক : আইনের শিক্ষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক।

সর্বশেষ খবর