সোমবার, ৬ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

কোন পথে হাঁটছে শ্রীলঙ্কা?

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মদ (অব.) পিএইচডি

কোন পথে হাঁটছে শ্রীলঙ্কা?

যদি একটি বয়লারে প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হয় এবং বয়লার থেকে চাপ বের হওয়ার সব ভাল্ব (Valve) বন্ধ রাখা হয়, তবে সেই বয়লারে বিস্ফোরণ ঘটাটাই স্বাভাবিক। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রযন্ত্রে এমনই এক বিস্ফোরোন্মুখ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে ক্ষমতাসীন দল বা জোট; যা রাজনীতি বিশ্লেষকদের ভাষায় ‘ক্ষমতাসীন দল যোগ এক’ বা ‘রুলিং পার্টি প্লাস ওয়ান’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে ক্ষমতাসীন দল হলো সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের দল শ্রীলঙ্কা পিপলস ফ্রন্ট, ক্ষমতাসীন জোট হলো ‘শ্রীলঙ্কা পিপলস ফ্রিডম অ্যালায়েন্স’ এবং যোগ এক বা ‘প্লাস ওয়ান’ হলেন সংসদে একটি মাত্র নির্ধারিত আসন পাওয়া ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির নেতা এবং সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। নতুন প্রধানমন্ত্রী যদিও মাহিন্দা রাজাপক্ষের পক্ষ ত্যাগ করা কিছু দলীয় নেতা এবং অন্য দলের কিছু প্রভাবশালী নেতাকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছেন, তবু তা প্রয়োজনীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখার তেমন সম্ভাবনা নেই বলেই ধারণা বিশ্লেষকদের। এর অন্যতম কারণ সম্প্রতি ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন প্রশ্নে নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিলের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। একটি হলো বিরোধী শিবিরের নেত্রী ও সংসদ সদস্য রোহিণী বিজয়ারত্নে কবিরত্নেকে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশবাসীর আস্থা অর্জন এবং জাতীয় সংসদে ঐক্যের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি। আর দ্বিতীয় পথ ছিল জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রাজাপক্ষের বলয় থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, শ্রীলঙ্কার বিতর্কিত সাংসদ তথা নতুন প্রধানমন্ত্রী বৃত্ত ভেঙে বের হতে ব্যর্থ হন। নতুন প্রধানমন্ত্রী ১৭ মে, ২০২২ সাংসদদের ভোটে ঘুরেফিরে আবারও পক্ষে-শিবিরের সংসদ সদস্য অজিত রাজাপক্ষকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করেছেন। এমন সিদ্ধান্তকে একটি আত্মঘাতী ও ভঙ্গুর সরকারের আলামত এবং আগামীতে অশান্ত সংসদের ইঙ্গিত বলে মনে করে শ্রীলঙ্কার সুশীলসমাজ।

পবিত্র সংবিধান নিয়ে শ্রীলঙ্কায় নাটকের পর নাটক চলছে। ১৯৭৮ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত টানা ৩৭ বছর সাংবিধানিক ক্ষমতার দাপটে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট অপরিসীম ক্ষমতা উপভোগ করেছেন। এর মধ্যে মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০০৫ থেকে ২০১৫ মেয়াদে নয় বছর ৫১ দিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৮ নভেম্বর, ২০১৯ মাহিন্দার ৭৪তম জন্মদিনে তাঁরই ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং আজও ক্ষমতাসীন। এর আগে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল সংবিধানে ১৯তম সংশোধনী এনে প্রেসিডেন্টের এ অবারিত ক্ষমতার লাগাম টানা হয় এবং সংসদ তথা প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতার পাদপীঠে আসীন করা হয়। ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর ২০তম সংশোধনী এনে সংসদের বদলে আবারও প্রেসিডেন্টের হাতে সব ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়। সংশোধনটি হয় ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির নেতা রনিল বিক্রমাসিংহেকে (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) সরিয়ে শ্রীলঙ্কা পিপলস ফ্রিডম অ্যালায়েন্সের পক্ষে মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২১ নভেম্বর, ২০১৯ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের ১১ মাসের মাথায়। আরও লক্ষণীয়, মাহিন্দার ৭৪তম জন্মদিনে এবং তাঁরই ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের তিন দিনের মধ্যে সংসদের বদলে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন দেশের প্রেসিডেন্ট, যা দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। বর্তমানে চলছে সংবিধানের ২১তম সংশোধনীর প্রক্রিয়া, যা আবারও প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাস ও প্রধানমন্ত্রী তথা সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। ২৩ মে, ২০২২ শ্রীলঙ্কার নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের মন্ত্রিপরিষদে এ সংশোধনের খসড়া উপস্থাপন করা হয় এবং সব রাজনৈতিক মহলের অবগতির জন্য এ খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠনো হয়। সংবিধান সংশোধন তথা সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বর্তমানে প্রেসিডেন্টের হাতে কুক্ষিগত অস্বাভাবিক ও অপার ক্ষমতার সমন্বয় বা ভারসাম্যের শর্তেই ১৭ দলের জোট শ্রীলঙ্কা পিপলস ফ্রিডম অ্যালায়েন্সের অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির সবেধন নীলমণি তথা একমাত্র সাংসদ তা-ও আবার জেলাভিত্তিক ১৯৬টি নির্বাচনী এলাকা নয়, ২৯টি জাতীয় আসনের মাত্র একটিতে জয়ী রনিল বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হন। তবে তাঁকেও জোটের এবং জোটের বাইরের সবাই মেনে নিতে পারছে না। ফলে অনুরোধ সত্ত্বেও অনেকেই দেশের এ ক্রান্তিকালে রনিলের মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কা মন্ত্রিপরিষদ ইংল্যান্ডের বারমুডাভিত্তিক অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান লাজার্ড (খধুধৎফ) ও লন্ডনভিত্তিক আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কিফোর্ড চান্স এলএলপিকে সংকট উত্তরণ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দাতা প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্য লাভের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় উপদেশ প্রদানের জন্য নিয়োগ দিয়েছে। উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা ব্যাংকের সদ্য বিদায়ী গভর্নর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী অজিত নিভাদ ক্যাবরাল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস নামার পরও ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ বৈদেশিক ঋণ বা বন্ডের কিস্তি পরিশোধে কোনো সমস্যা হবে না বলে ঘোষণা দেন। আর এভাবেই দেশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা হারায়। এ অবস্থায় ৭ এপ্রিল, ২০২২ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাল ধরেন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ড. নন্দলাল ভিরাসিংহে। অন্যদিকে অন্যান্য দেশসেরা অর্থনীতিবিদ যেমন ড. নিশান ডি মেল, ড. দুশনি ভিরাকন, ড. দিশাল ডি মেল, সর্বোপরি ভিয়েতনাম সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে সুনাম অর্জনকারী প্রফেসর হাওয়ার্ড নিকোলাসকে এখনো দৃশ্যত কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে না লাগানোর বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। আর এ বিতর্কে ঘি ঢেলেছেন নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে তাঁর আগ থেকেই বোঝাপড়া রয়েছে, তথাপি ২৫ মে, ২০২২ বিতর্কিত রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া কর্তৃক তাঁকেই অর্থমন্ত্রী নিয়োগের বিষয়টি মূলত সরকার ও রাজনীতির দৈন্যদশার প্রতিচ্ছবিই বলা চলে। কারণ বিদায়ী ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী রাজাপক্ষে নিজে ২০ মাস অর্থ মন্ত্রণালয় চালিয়েছেন। প্রায় ১০ মাস তাঁর ছোট ভাই বাসিল রাজাপক্ষকে দায়িত্ব দিয়েও অর্থনৈতিক ধস রোধ করতে ব্যর্থ হন মাহিন্দা। বাসিলকে সরিয়ে নিজ দলের অন্য নেতা মোহাম্মদ আলী সাবরিকে দায়িত্ব দেওয়া হলে এক মাসের মাথায় তিনি বিদায় নেন।

বিস্তর সমালোচনা রয়েছে শ্রীলঙ্কার বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা নিয়েও। বিশেষত পারিবারিকভাবে শক্তিশালী ও দীর্ঘদিন সেনা ছাউনিতে থাকা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার দেওয়া সমঝোতা প্রস্তাব, ঐকমত্যের সরকারে যোগদানের আমন্ত্রণ, জাতির উদ্দেশে ভাষণ ইত্যাদির বিপরীতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা এবং পাল্টা বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে অনাবশ্যক বিলম্ব বিরোধীদের রাজনৈতিক অপরিপক্বতাই প্রকাশ করে। বিশেষত সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে এবং বর্তমানে সংসদে বিরোধী দল সমাজি জন বালাউইগাইয়া বা এসজেবি (ইউনাইটেড পিপলস্ পাওয়ার) নেতা সাজিথ প্রেমাদাসার আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রত্যাশা করেছিল শ্রীলঙ্কাবাসী। এ ক্ষেত্রে সোভিয়েত নেতা জোশেফ স্টালিন কিংবা হাঙ্গেরির বিপ্লবী নেতা মেটোস্ রাকোসি অনুসৃত ‘সালামি ট্যাকাটিকস্’-এর কথা উঠে এসেছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্যে। যার আলোকে বিরোধীদের যে করেই হোক প্রথমে সরকারে ঢুকে পড়া এবং পরে দরকষাকষি করে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিদের সরকার থেকে বের করে দেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সে সুযোগ নিতে পারেনি বিরোধী শিবির। অন্যদিকে সরকারে কে নতুন যোগ দিল বা কে পদত্যাগ করল, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বর্তমান সংবিধানের বিগত কয়েক বছরের বিতর্কিত সংশোধনীগুলো দ্রুত বাতিল করে সরকারকে আরও জবাবদিহির মধ্যে আনা। এ ক্ষেত্রে বিরোধীরা যথাযথ চাপ সৃষ্টিতে ব্যর্থতার দোষে দুষ্ট। বিরোধীদের এ দুর্বলতার নেপথ্যে নিজেদের মধ্যে আস্থার অভাব, সরকার তথা পক্ষে-পরিবারের দেওয়া টোপ, বিরোধী দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আবার ছোট ছোট মেরুকরণ বা একটি দল বা একজন নেতার প্রতি অধিক দুর্বলতা এবং কারও কারও প্রতি তাচ্ছিল্য বা অবজ্ঞাকে দায়ী করেছে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ।

যে জনঅসন্তোষ বা গণআন্দোলন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও তাঁর পরিবারকে কোণঠাসা করেছিল, তার যৌক্তিক পরিণতি নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বিদ্যুতের অভাবে ফুটপাথে মোমবাতি জ্বালানো, জ্বালানি তেলের অপেক্ষায় দীর্ঘ লাইন কিংবা হাসপাতালে ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর তীব্র সংকটের আগেই একটি গণআন্দোলন গড়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা এবং দেশকে বাঁচানোর সুযোগ এসেছিল। এসব সংকটের আগে দেশজুড়ে সার ও কীটনাশক সংকটের প্রেক্ষাপটে খেতমজুরের কণ্ঠে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে, ‘গোতা গো হোম, গোতা গোতা গো’, যার অর্থ গোতা ঘরে ফিরে যাও, গোতা গোতা চলে যাও। এ সময় কৃষকরা একবাক্যে বলেছিল, ১৯৪৮ সালের পর এমন কোনো বাজে রাষ্ট্রপতি বা নেতা পায়নি শ্রীলঙ্কাবাসী। কেউ কেউ এ অবস্থাকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের দুরবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন। এমনকি অবস্থা ব্রিটিশ আমলের চেয়ে খারাপ বলেও চাউর হয়। একদা চীনের কৃষকরাও এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল। বিপ্লবী নেতা মাও সে তুং সে সময় কৃষকদের এমনি হতাশার সুর আপামর জনতার কাছে জনতার মাধ্যমেই প্রচার করেন এবং সবাইকে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় ঐক্যবদ্ধ করেন। জনতার একাংশের হতাশা জনতার মাধ্যমেই সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার এ রীতি পরবর্তীতে ‘গণলাইন’ এবং এ বৈপ্লবিক প্রক্রিয়াকে ‘জনতার থেকে, জনতার কাছে’ (ফ্রম দ্য মাস টু দ্য মাস) নামে ব্যাপক পরিচিতি পায় এবং পরবর্তীতে বহু দেশে আন্দোলন ও সংগ্রামের সময় সাফল্যের সঙ্গে তা অনুসৃত হয়। অথচ শ্রীলঙ্কায় আন্দোলনের নামে কখনো প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার পদত্যাগ, কখনো ২২৫ জন সাংসদের পদত্যাগ, কখনো সংসদকে শক্তিশালী বা ক্ষমতাসীন করা এবং ভিন্ন কণ্ঠে রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তনের সুর ওঠে। তবে বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বা চে গুয়েভারা এমন সুর প্রকাশ্যে আসতে দেননি। তাদের অভিন্ন লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা কুক্ষিগত করা একনায়ককে সবার আগে বিদায় করা। অন্যসব দাবি-দাওয়াকে এ মূল লক্ষ্য বাস্তবায়নের পর আলোর মুখ দেখতে পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় সচেতনভাবেই। ইরানের শাহকে গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত শাহবিরোধী খোমেনিরা অন্য কোনো দাবি-দাওয়া সামনে আসতে দেননি। ফিলিপাইনে আন্দোলনের একটাই স্লোগান ছিল- ‘স্বৈরাচার মার্কোসের বিদায়’, যা উপাসনালয় থেকে বিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অথচ শ্রীলঙ্কায় এমন এক ও অভিন্ন লক্ষ্যের অভাব প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। এ ক্রান্তিকালেও বিরোধীরা কখনো ২০তম সংশোধনীর কারণে স্বৈরাচার সৃষ্টি হয়েছে, কখনো যুগের পর যুগ আগাগোড়া স্বৈরাচারী শাসন, কখনো অর্থনীতির স্বর্ণযুগ কিংবা কালো অধ্যায় নিয়ে বিভক্তিমূলক বক্তব্যে সময় ক্ষেপণ করে।

শ্রীলঙ্কায় চলমান আন্দোলন শানিত হয় সংবিধানের ২০তম সংশোধনীর বিরুদ্ধে, যা মূলত সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীকে ঠুঁটো জগন্নাথ এবং প্রেসিডেন্টকে মহামানব বা মহাদানবে রূপান্তর করেছে। অথচ এমন সংসদের বিরুদ্ধেই একশ্রেণির আন্দোলনকারী উঠেপড়ে লেগেছে এবং সংসদ ও সংসদ সদস্যদের আক্রমণ করছে। অথচ ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ১৯৮৩ সালে সে দেশের স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস (সিনিয়র) বিরোধীদের চলমান আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে আমেরিকা থেকে দেশে ফেরেন মার্কোসবিরোধী নেতা বেনিনো একুইনো (জুনিয়র)। ১৯৮৩ সালের ২১ আগস্ট বিমান থেকে নামার পর নিরাপত্তা বাহিনীর হাজার হাজার সদস্যের মাঝেই মাথায় গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর তাঁর বিধবা স্ত্রী কোরাজন একুইনোর নেতৃত্বে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের অংশগ্রহণে ব্যাপক ও তীব্র গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। তবে তা ছিল অহিংস, শ্রীলঙ্কার মতো পথে-ঘাটে মন্ত্রী-এমপিদের দিগম্বর করার মতো নয়। সে আন্দোলনে সংঘাত হলেই ফিলিপাইনে সেনাশাসনের সম্ভাবনা ছিল। বাস্তবে তা হয়নি বলেই তীব্র আন্দোলনের মুখে ফিলিপাইন ছেড়ে বিদেশে আশ্রয় নিতে হয় মার্কোসকে। আর এভাবেই মার্কোসের ২১ বছরের অপশাসনের অবসান ঘটে। বাস্তবে শ্রীলঙ্কায় এমনটি হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। পরিবারতন্ত্র, অপরাজনীতি, বৈদেশিক ঋণের ফাঁদ, দুর্নীতি, অপশাসনের মতো একাধিক দুষ্টচক্রে শ্রী হারিয়েছে এককালে উন্নয়নশীল দেশের পথিকৃৎ শ্রীলঙ্কা। বর্তমান ও অদূর ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার শ্রী আবারও ফিরে আসুক- সেটাই প্রত্যাশিত। তবে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিলেই শ্রীলঙ্কা কিংবা একই ধরনের সমস্যায় জর্জরিত দেশগুলো মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে।

লেখক : গবেষক, কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর