মঙ্গলবার, ৭ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

বাবা আদম শ্রীরাম ও বুদ্ধের দেশ শ্রীলঙ্কা

সুমন পালিত

বাবা আদম শ্রীরাম ও বুদ্ধের দেশ শ্রীলঙ্কা

আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও শ্রীলঙ্কা একটি বহুজাতিক দেশ। জনসংখ্যার দিক থেকে সিংহলিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। শতকরা ৭৪ ভাগ। তামিলের সংখ্যা মাত্র ১৭ ভাগ। মুর বলে স্থানীয়ভাবে পরিচিত মুসলমান ৭ ভাগের মতো। অন্যদের সংখ্যা ২ ভাগের কম। পৃথিবীর প্রধান পাঁচটি ধর্মের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মিথের সঙ্গে জড়িত এ দেশের নাম। রামায়ণে এ দ্বীপদেশটি অভিহিত হয়েছে ‘লঙ্কা’ নামে। এ দেশ নিয়ে চমৎকার কেচ্ছা রয়েছে রামায়ণে। নির্ভেজাল সে রূপকথা দুনিয়ার শত কোটির বেশি মানুষকে উদ্বেলিত করে। আরব বা মুসলমানের কাছে শ্রীলঙ্কা ‘শরণদ্বীপ’ নামে পরিচিত। আদিনাম লঙ্কা হলেও একসময় এ দেশের নাম ছিল ‘সিংহল’। অন্তত ২ হাজার বছর বাঙালির দেওয়া এ নামেই পরিচিত ছিল ছবির মতো সুন্দর এ দ্বীপদেশটি। ইংরেজ শাসনামলে সিংহল হয়ে যায় ‘সিলোন’। ইংরেজি উচ্চারণের কারণেই ঘটে যায় এ নাম বিকৃতি।

শ্রীলঙ্কাকে বলা হয় মহামানবের মিলনকেন্দ্র। মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের বিশ্বাস দুনিয়ার প্রথম মানব আদম। আল্লাহর নির্দেশে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় আদমকে। তাঁর সঙ্গী হিসেবে সৃষ্টি করা হয় প্রথম মানবী বিবি হাওয়াকে। সৃষ্টির পর জান্নাত বা স্বর্গে রাখা হয় তাঁদের। বলা হয় জান্নাতের সবকিছু এই মানব-মানবীর জন্য ভোগ্য। শুধু একটি ফল তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ। শয়তানের ধোঁকায় আদম-হাওয়া আল্লাহর নির্দেশ বিস্মৃত হন। ভক্ষণ করেন ‘গন্ধম’ নামের নিষিদ্ধ ফল। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা জান্নাতে থাকার অনুপযুক্ত ঘোষিত হন। আল্লাহর নির্দেশ ভাঙার শাস্তি হিসেবে তাঁদের পাঠানো হয় পৃথিবীতে। তা-ও বিচ্ছিন্নভাবে। আদম অবতীর্ণ হন শ্রীলঙ্কায়। আর হাওয়াকে আরবের জেদ্দায়। ধর্মীয় কাহিনিমতে, আরাফার ময়দানে তাঁরা একে অন্যের দেখা পান। এ বিষয়ে ভিন্ন ভাষ্যও রয়েছে। তবে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্ট এবং কোরআনে এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট বর্ণনা নেই। শ্রীলঙ্কার একটি পর্বতশৃঙ্গ এ ধর্মীয় কাহিনিকে ধারণ করে আছে। যার নাম আদমশৃঙ্গ। পাহাড়ের শীর্ষে হজরত আদমের পদচিহ্ন আছে বলে বিশ্বাস করা হয়। মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের কাছে যে কারণে এটি একটি তীর্থকেন্দ্র। ভিন্ন অভিধায় হিন্দু ও বৌদ্ধদের কাছেও এ পাহাড়টি সমভাবে পবিত্র। হিন্দুদের বিশ্বাস, পাহাড়শীর্ষের পদচিহ্নটি তাদের উপাস্য দেবতা রামের।। বৌদ্ধদের মতে ভগবান বুদ্ধের। পাহাড়শীর্ষে একটি বৌদ্ধ মন্দির বা প্যাগোডা রয়েছে। আদমশৃঙ্গ দেখতে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক খ্রিস্টান, ইহুদি ও মুসলমান শ্রীলঙ্কায় আসেন। কিন্তু সেখানে এ তিন ধর্মের কোনো উপাসনাগার নেই। পবিত্র পদচিহ্নটির ছবিও তুলতে দেওয়া হয় না কাউকে। উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট। পদচিহ্নের ছবি দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে সেমেটিক ধর্মাবলম্বীদের কাছে তা দেখার আগ্রহ হ্রাস পাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে শ্রীলঙ্কার পর্যটন।

বাঙালির কাছে শ্রীলঙ্কা আবেগঘন এক অনুভূতির নাম। ছোটবেলায় শোনা বাংলা কবিতার একটি পঙ্ক্তি- ‘আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিল জয়’। বলা হয় বাঙালি যুবরাজ বিজয় সিংহ হাজার হাজার বছর আগে নৌ অভিযান চালিয়ে শ্রীলঙ্কা জয় করেন। তাঁর নামেই রামায়ণে বর্ণিত লঙ্কার নাম হয় সিংহল।

বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যগত সম্পর্কের কারণে দুই দেশের রাষ্ট্রনেতাদের দেখা-সাক্ষাতে ভিন্ন আবেগ স্থান পায়। ১৯৭৪ সালে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে। সে সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শ্রীলঙ্কার নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী মাভো বন্দরনায়েকে। সম্মেলন উপলক্ষে আলজেরীয় প্রেসিডেন্টে হুয়ারি বুমেদিন সম্মানিত অতিথিদের সংবর্ধনা দেন। সে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু করমর্দন করেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের সঙ্গে। তাঁকে বলেন, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক হৃদয়ের আবেগে ভরা। বাঙালি যুবরাজ বিজয় সিংহ লঙ্কা জয় করে এ দেশটির নাম যে সিংহল রেখেছিলেন সে কথাটি বঙ্গবন্ধু স্মরণ করিয়ে দেন। শ্রীমতী মাভো বন্দরনায়েকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এ আবেগাপ্লুত বক্তব্যের জবাব দেন রসিকতা করে। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আবারও কি আপনারা সিংহল জয় করতে চান? বঙ্গবন্ধু জবাব দেন, অবশ্যই। তবে ভালোবাসা দিয়ে।

মনে পড়ছে এরশাদ আমলে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট প্রেমাদাসা। ময়নামতিতে বৌদ্ধবিহার পরিদর্শনের সময় তিনি প্রটেকশন ভেঙে মিশে যান গ্রামবাসীর সঙ্গে। হোটেলে অবস্থানকালেও একবার সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন জনারণ্যে। যে মানুষটিকে হত্যা করতে তামিল টাইগাররা দেশে-বিদেশে ওত পেতে ছিল, তাঁর এমন স্বতঃস্ফূর্ত ও দিলখোলা ব্যবহার বাংলাদেশের মানুষকে সেদিন মুগ্ধ করেছিল। শ্রীলঙ্কা নিয়ে ধর্মীয় কেচ্ছা কিংবা সে দেশের ইতিহাস চর্চা আর নয়। মাত্র দুই বছর আগেও যেটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ তারা আজ নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। এ দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শূন্য। জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ। চলছে না কলকারখানা। ঘুরছে না গাড়ির চাকা। করোনাকালের দুই বছরে শ্রীলঙ্কার পর্যটন আয় নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত রুদ্ধ হয়ে পড়ায় বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। বিদ্যুৎ না থাকায় লালবাতি জ্বলছে তৈরি পোশাকশিল্পে।

শ্রীলঙ্কা এখন বিশ্বরাজনীতির তুরুপের তাস। বলা হচ্ছে, চীনের কাছ থেকে ঢালাও ঋণ নিয়ে দেউলিয়ায় পরিণত হয়েছে দেশটি। বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কায় পরিণত হবে কি না তা নিয়ে চলছে তুমুল বিতর্ক। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশটি যে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে তা এক মহাসত্যি। তবে যত দোষ নন্দ ঘোষ বলে চীনের দিকে তীর ছোড়ার কসরত যারা করছেন তারা জগদ্বাসীকে হয় ধোঁকা দিচ্ছেন নতুবা আত্মপ্রতারণায় ভুগছেন। কারণ শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের মাত্র ১০ শতাংশ চীন থেকে নেওয়া। সে ঋণ যদি মাফ করেও দেওয়া হয়, তার পরও এ দেশটির দেউলিয়াত্ব ঘুচবে না। শ্রীলঙ্কা কোনো সম্পদশালী দেশ নয়। কিন্তু দুনিয়ার অনেক সমৃদ্ধ দেশকেও দেউলিয়া অবস্থায় পড়তে হয়েছে অতীতে। জি-৮-এর সদস্য ব্রাজিলের মতো সমৃদ্ধ দেশও দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল বিগত শতাব্দীতে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ঋণে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল তারা। গ্রিসের অবস্থাও পৌঁছে গিয়েছিল দেউলিয়াত্বের প্রান্তে। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সামনে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও দানা বেঁধে উঠেছে এ দ্বীপদেশটিতে। বিদেশ থেকে ত্রাণসামগ্রী না গেলে হাজার হাজার মানুষ মারা যাবে অনাহারে।

শ্রীলঙ্কায় যে দেউলিয়াত্ব অবস্থা চলছে এ অবস্থার সুযোগ নিতে পারে তামিল টাইগাররা। সে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চুপসে যাওয়া বিদ্রোহীরা। অনেকের মতে, এ দ্বীপদেশটির সামনে সেটিই এখন বড় বিপদ। শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে পড়লেও দেশটি অচিরেই ঘুরে দাঁড়াবে এমনটিই আশা করা যায়। শ্রীলঙ্কার স্বাধীনচেতা মানুষই তাদের দেশের দেউলিয়াত্বের অবসান ঘটাবে। দুই প্রতিবেশী দেশ চীন ও ভারত নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে শ্রীলঙ্কাকে সহায়তা দিতে বাধ্য হবে। এমনকি কৌশলগত কারণে চীন তাদের ঋণের সব সুদ মাফ কিংবা দীর্ঘ মেয়াদে পরিশোধের প্রস্তাবও দিতে পারে। শ্রীলঙ্কাকে পাশে পেতে যুক্তরাষ্ট্রও বাড়াতে পারে সহযোগিতার হাত।

শ্রীলঙ্কা যে এখন ভয়াবহ মানবিক সংকটের সম্মুখীন তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। তার পরও এ বিপদের চেয়ে তামিল টাইগারদের দিক থেকে আসা হুমকিকে বড় করে দেখা হচ্ছে কেন? এ প্রশ্নের জবাবে আমাদের ফিরে যেতে হবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর ১৭৯৬ সালে শ্রীলঙ্কা তাদের দখলে আসে। ব্রিটিশ শাসকদের ছত্রচ্ছায়ায় সে দেশে শুরু হয় চা চাষ। চা বাগানের জন্য ভারতের তামিলনাড়ু থেকে মজুর হিসেবে আনা হয় তামিলদের। ব্রিটিশ আমলে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রভাষা ছিল ইংরেজি। ইংরেজদের কৃপা পেতে তামিলরা এ ভাষায় দ্রুত অভ্যস্ত হয়। অফিস-আদালতে চাকরির ক্ষেত্রে তামিলদের সংখ্যা ছিল ৮০ ভাগ। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তারা ছিল এগিয়ে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে শ্রীলঙ্কা। এর ছয় বছর পর ’৫৫ সালে প্রধানমন্ত্রী সলোমন বন্দরনায়েকে সিংহলি ভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তামিলরা। কারণ তারা সিংহলি ভাষায় অভ্যস্ত ছিল না। চাকরি হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে তারা। একপর্যায়ে তামিল অধ্যুষিত এলাকার স্বায়ত্তশাসন দাবি করে তামিলরা। ফেডারেল পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠাও ছিল তাদের দাবি। এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে সরকার।

তামিলরা স্বাধীনতার জন্য গঠন করে একাধিক সশস্ত্র সংগঠন। এর অন্যতম তামিল টাইগার্স। অচিরেই তারা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর গেরিলা দল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।। তামিলদের আত্মঘাতী হামলায় শ্রীলঙ্কার একজন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী প্রাণ হারিয়েছেন। একাধিক মন্ত্রীসহ অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তারা। এমনকি তামিলবিরোধী নীতির জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকেও প্রাণ হারাতে হয়েছে ভারতীয় তামিলদের হাতে।

কতটা দুর্ধর্ষ ও বেপরোয়া ছিল তামিল টাইগাররা? তারা শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, দুনিয়াজুড়ে নিজেদের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল। দেশে-বিদেশে শ্রীলঙ্কা সরকারকে অপদস্থ করতে এ গেরিলা সংগঠনটি ব্যাপক সাফল্যের পরিচয় দেয়। একবার শ্রীলঙ্কা সরকার অস্ত্র কেনে জিম্বাবুয়ের কাছ থেকে। সম্ভবত চীন জিম্বাবুয়ের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কাকে ওই অস্ত্রের জোগান দেয়। অস্ত্র জাহাজে তোলা হয়। সে জাহাজ রাতারাতি হাওয়া হয়ে যায়। এ ঘটনার পেছনেও তামিল টাইগার্সের হাত ছিল। শ্রীলঙ্কার তামিলরা গৃহযুদ্ধের সময় ছোট ছোট বিমান ও অস্ত্র তৈরির যোগ্যতা দেখিয়েছে। আত্মঘাতী হামলা পরিচালনায় ছিল না তাদের কোনো তুলনা। তার পরও তামিল টাইগার্সের বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে যায়। ২০০৯ সালে নিজ দলেই তামিল টাইগার নেতা প্রভাকরণের নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। টাইগারদের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার করুণা আমান ৬ হাজার তামিল টাইগারকে নিয়ে যোগ দেন সরকারি বাহিনীর সঙ্গে। পশ্চিমা দুনিয়া, চীন, ভারত বিদ্রোহ দমনে শ্রীলঙ্কা সরকারকে মদদ জোগায়। পরিণতিতে সপরিবারে প্রাণ হারান দুনিয়ার সর্বকালের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ গেরিলা নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ। ১ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারায় দুই পক্ষের যুদ্ধে। প্রভাকরণের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহের অবসান ঘটে রক্তাক্ত পথে। তার পর থেকে তামিল এলাকায় কবর বা শ্মশানের শান্তি বিরাজ করছে। কিন্তু সে শান্তিও হুমকির মুখে পড়েছে শ্রীলঙ্কার অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে।

শ্রীলঙ্কার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন সত্যিকার অর্থেই নিয়ন্ত্রণহীন। বিক্ষোভকারীরা জ্বালিয়ে দিয়েছে মন্ত্রীর বাড়ি। প্রেসিডেন্ট ভবনেও হামলা চালিয়েছে। সংসদ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলেছে। মানবসভ্যতার এ আদিভূমির প্রতিটি প্রান্তরে রয়েছে রক্তের ছাপ। এ দেশের মানুষ একসময় আপনজনের মৃত্যুর পর লোক ভাড়া করে আনত কাঁদার জন্য। এটি ছিল তাদের সামাজিক প্রথা। কিন্তু গৃহযুদ্ধ তাদের মনকে এমনই ক্ষতবিক্ষত করেছে যে চোখের পানিও যেন ফুরিয়ে গেছে। এ দেশের তামিল অধ্যুষিত এলাকায় এমন কোনো পরিবার নেই যাদের কোনো স্বজন গৃহযুদ্ধের নির্মম শিকারে পরিণত হয়নি। সিংহলিদের জন্যও এ কথা কমবেশি সত্য। ১ লাখের বেশি প্রাণের বিনিময়ে সিংহলি ও তামিলরা উপলব্ধি করেছে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে তারা ভুল করেছে। এ ভুলপথ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ শ্রীলঙ্কাকে পিছিয়ে দিয়েছে। দুনিয়ার অন্যতম মেধাবী জাতি তামিলদের মেধা সৃষ্টির বদলে ধ্বংসের পথে ব্যয় হয়েছে। শ্রীলঙ্কা ছোট দেশ। আয়তনে বাংলাদেশের অর্ধেকেরও কম। এ দেশের চারদিকে নীল সমুদ্র। শ্রীলঙ্কার সিংহলি ও তামিল সবার ভাগ্য এ ছোট্ট দেশটির ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ দেশ ছেড়ে তাদের কোথাও যাওয়ার পথ নেই। মিলেমিশে থাকার মধ্যেই সবার কল্যাণ নিহিত। বাবা আদমের দেশ, ১১০ কোটি মানুষের আরাধ্য দেবতা শ্রীরামের স্মৃতিধন্য ও ভগবান বুদ্ধের শান্তি ও অহিংসার দেশ শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া অবস্থা থেকে মুক্তি পাক, এ সমগ্র বিশ্ববাসীর কামনা। শ্রীলঙ্কার সব মানুষের শুভবুদ্ধির কাছে আমাদের আহ্বান একটাই- দোহাই, বাবা আদম, ভগবান শ্রীরাম ও মহামতি বুদ্ধের পুণ্যভূমিতে আর রক্ত যেন না ঝরে। মহান মানবতাবাদী রাহুল সাংকৃত্যায়ন যে দেশটিতে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছেন, সে দেশের মানুষ উগ্র জাতীয়তাবাদ আর ধর্মান্ধতার বলি হবে তা কোনোভাবেই শোভনীয় নয়।

 

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর