শুক্রবার, ১০ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

সাধারণ নির্বাচন এবং সুশীলসমাজের হ্যালুসিনেশন

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী

সাধারণ নির্বাচন এবং সুশীলসমাজের হ্যালুসিনেশন

আমাদের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হতে বাকি মোটামুটিভাবে বলা চলে দেড় বছর। সুতরাং স্বাভাবিক নিয়মেই রাজনীতিতে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। পত্রিকা খুললেই বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশে ফেরার পর দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা প্রতিটি কাজ একটি দর্শন নিয়ে করছেন। মূল দর্শনটা হচ্ছে দেশপ্রেম এবং আগামী নির্বাচনেও তিনি একটি দর্শন নিয়ে কাজ করবেন। সেটি হলো, কেন এ নির্বাচনে আবার তাঁর দল অংশগ্রহণ করবে। আমাদের দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ককে আমাদের তথাকথিত সুশীলসমাজ সব সময় ঠিকমতো বুঝতে পারে না। এ বুঝতে না পারার ফলে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা যে জনগণের কাছে কতটা জনপ্রিয় এবং জনগণের কারণেই যে তিনি কতটা শক্তিশালী এ বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই। এ কারণেই তারা বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়। ভাবে যে আমেরিকা আছে, ইউরোপ আছে। এ কারণে এরা বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে এবং বিভিন্নভাবে নিজেদের তৈরি করা সংবাদগুলোতে প্রকাশ করে সেটাকে আবার বিদেশিদের কাছে পাঠায়। পাঠিয়ে ভাবে, আমাদের দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ককে একটা প্রেসারে ফেলা যাবে এবং যার ফলে তারা নির্বাচনে জিতবে।

একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিএনপি দাবি করে তারা প্রধান বিরোধী দল এবং আমি নিজেও মনে করি, এখন পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেক পেছনে থাকলেও তাদের প্রধান বিরোধী দল বলা চলে। তবে তারা এবং জাতীয় পার্টি এখন মোটামুটি প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে। এখন বিএনপি বলছে, যদি নিরপেক্ষ সরকার না হয় তাহলে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। বুঝতে হবে, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়কের কাছে আলাদা কোনো আলাদিনের চেরাগ নেই যে তিনি দেশের সংবিধান অবহেলা করে বা ভেঙে অথবা বিদেশের প্রেসারে তাদের চাওয়ামতো নির্বাচন দেবেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা নেই। সুতরাং যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো ব্যবস্থা নেই, ফলে সংবিধানের দাঁড়ি, কমা, ফুল স্টপসহ আমাদের দেশে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হবে। বিএনপি যদি সত্যিকারেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, (যেটা তারা এখন বলছে) তাহলে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা মুসলিম লীগ হতে চায়। মুসলিম লীগ যদি তারা হতে চায়, সেটা ভালো কথা। এটা তাদের বিষয়। এখানে যতই বলা হোক না কেন, তাদের যেসব কথাবার্তা তাতে মনে হয় তারা তাই চায়। তাদের সঙ্গে যারা মিশেছে, তাদের কথাবার্তাও এলোমেলো। তারা বলে জনগণ যদি সবাই রাস্তায় নামে তাহলে আওয়ামী লীগ দৌড়ে কূল পাবে না। এ ধরনের কি কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য হয়? জনগণ রাস্তায় নামবে আর তারা বসে টেলিভিশন দেখবে, সেটা তো হবে না। কয়েকটি পত্রিকা খুললেই বোঝা যায়, প্রতিটি নিউজ ট্রিটমেন্ট এমনভাবে করে যেখানে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে। আমি ১৯৬১ সাল থেকে মোটামুটিভাবে মিডিয়া জগতের সঙ্গে পরিচিত। তখন মূল পেপার ছিল ইত্তেফাক, তার সঙ্গে সংবাদ এবং আজাদ। তখন থেকে দেখছি, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কায়দা করে মোটামুটিভাবে অলমোস্ট প্রায় সব পত্রিকাই তিলকে তাল করে। এটা এক ধরনের ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্র করে কি একজন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ককে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব? সামান্যতম সম্ভাবনারও কোনো অস্তিত্ব দেখি না। শেখ হাসিনা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আছেন এবং নির্বাচনের মাধ্যমেই থাকতে চান। বিরোধী পক্ষের একমাত্র অস্তিত্ব আছে হ্যালুসিনেশনে বা নিজের কল্পনায়। এ হ্যালুসিনেশনের মাধ্যমে এখন তারা কাচ্চি বিরিয়ানি খাচ্ছে। এ হ্যালুসিনেশনের মাধ্যমেই তারা ক্ষমতায় আসতে চাচ্ছে। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কতগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ জোরের জায়গা আছে। সেগুলো যদি আমরা কিছুটা আলোচনা করি তাহলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। যেমন শতকরা ৮০ ভাগ লোক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তাদের জন্য এক কমিউনিটি ক্লিনিক করে, একটি বাড়ি একটি খামার করে, যাদের বাড়িঘর ছিল না তাদের ঘর করে দিয়ে, বিধবা ভাতা, প্রবীণ ভাতা, সমস্ত লোককে পেনশনের বন্দোবস্ত করছেন। এখন মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। অনেকেই অবসরের ১৫ বছর পর বেঁচে আছেন বলে পুরো পেনশন পাচ্ছেন। তারা কি দেখেন না, এই যে পদ্মা সেতু হচ্ছে। এটা এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। তাই এ সেতুর নাম রাখা উচিত দার্শনিক পদ্মা সেতু। দার্শনিক বললেই এখানে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে বোঝাবে। অর্থাৎ তাঁর নাম কোনো-না-কোনোভাবে এ সেতুর সঙ্গে থাকুক। কারণ এটি ইতিহাসের অংশ। তাঁর প্রতি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাংঘাতিক একটি ইমোশন রয়েছে। এজন্য আমি বললাম যে শতকরা ৮০ ভাগ লোক তাঁকে সমর্থন করে। আমি ২৪ মে মৌলভীবাজারে কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিক দেখতে গিয়েছিলাম। তখন সেখানে সমস্ত সাধারণ লোকজনের একটা উৎসবের আমেজ হয়। তখন তারা বলে, আলাদাভাবে তো অনেক জায়গায় অনেক দেশেই চিকিৎসা হয় শুনেছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যে প্রতি ১০ হাজারের কাছাকাছি জনগণের জন্য সমস্ত দেশব্যাপী কমিউনিটি ক্লিনিক করে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের চিকিৎসা দিচ্ছেন, এটা তো একটা রোল মডেল। এই যে করোনার সময় একই সঙ্গে তিনি জীবন এবং জীবিকা বাঁচালেন। এটাও তো একটি রোড মডেল সিদ্ধান্ত। এখানে নিজস্ব টাকায় পদ্মা সেতু করা যায় (অনেকে হাসাহাসি করেছেন) সেটি তিনি দেখিয়েছেন। এটিও তো একটি রোল মডেল। এরকমভাবে অনেক উদাহরণ দিয়ে দেখানো যায়। যেমন তিনি যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বললেন তখন অতি বুদ্ধিমানেরা হাসাহাসি শুরু করল। এবার করোনাকালীন দেখা গেল, এই ডিজিটাল বাংলাদেশ থাকার জন্য জীবন-জীবিকা শুধু নয়, লেখাপড়া থেকে শুরু করে সমস্ত দেশটি একই রকমভাবেই ছিল। মোটামুটিভাবে সবার একটা ধারণা সম্ভবত এই যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যে যুদ্ধ হচ্ছে, এটা তো আসলে পশ্চিমা শক্তি একদিকে; অন্যদিকে রাশিয়া এবং তার পেছনে নিশ্চয়ই চীনও আছে, আবার উত্তর কোরিয়াও- যেহেতু তারা যুদ্ধাস্ত্রে এখন অনেক এগিয়ে গেছে সেহেতু তারাও আছে। সুতরাং এ যুদ্ধ প্রায় এক বছর থাকবে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী খাবার থেকে শুরু করে সবকিছুতেই কিন্তু কমতি পড়েছে এবং জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। যেমন কিছুদিন আগে দেখলাম ইউকেতে খাবারের দাম শতকরা ৫০ ভাগ বেড়ে গেছে। সুতরাং যুদ্ধ এক বছর থাকলে আমাদের দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক কী করলেন? তিনি বললেন, খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে যারা রিসার্চ করবে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এই যে সার এর কীভাবে বিকল্প বের করা যায়, সার যাতে করে পাওয়া যায়, অর্থাৎ খাবার যাতে করে বাড়ে সে বিষয়ে বললেন। এভাবে আগে যেমন সরকারি জমি দেওয়া হতো। এখন তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, এভাবে জমি দেওয়া হবে না, দরকার হলে অ্যাপার্টমেন্ট করে দেওয়া হবে। তিনি কিন্তু এগিয়ে আছেন। দার্শনিক তো সেই কারণে তিনি ১০০ বছরের প্ল্যান করছেন। যে দার্শনিক ১০০ বছরের প্ল্যান করে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন, তাঁকে আপনারা ঘরের ভিতর থেকে বলবেন যে রাস্তায় যদি লোক নামে, আর কয়েকটা পত্রিকা মিলে আমার জানা মতে দু-তিনটি পত্রিকা বিরোধিতা করলেই শেখ হাসিনাকে বোধহয় ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া যাবে। আসলে বিষয়টা এত সহজ নয়। অনেকে বলে যে পরিবারতন্ত্র। আমি আমাদের দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার পরিবারের কথা বলি। আমার এখনো মনে আছে গত নির্বাচনের কাছাকাছি একটি সময়। সজীব ওয়াজেদ জয়কে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি কি নির্বাচন করবেন? তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, আমি নির্বাচন করলে তো দেশে থেকেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতাম। এখন পর্যন্ত দার্শনিক শেখ হাসিনা তাঁর পরিবারকে রাজনীতিতে নামাননি। বরং বিভিন্ন বক্তব্য থেকে তাঁর যেটা প্রমাণ হয়েছে সেটি হচ্ছে, পিতা-মাতার দায়িত্ব হচ্ছে ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখানো এবং সঠিকভাবে মানুষ বানানো। তিনি তাঁর দুই সন্তানকে সেটিই করেছেন। তারপর তারা কি ব্যবসা করবে, না শিক্ষক হবে, না রাজনীতি করবে এটা তাদের নিজস্ব বিষয়। এমনকি যেহেতু তাদের মা প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর অফিস ব্যবহার করে তারা কোনো কিছু করেছেন এ রকম সামান্যতম কোনো নজির নেই। তারা রাজনীতিতে এলে তিনি মা হিসেবে হয়তো তাদের উপদেশ দেবেন, কিন্তু রাজনীতির চেয়ারে বসিয়ে দেবেন, এটা তিনি চিন্তাও করেন না। কারণ তাহলে তাঁর যে কাজের নমুনা তা থেকে বোঝা যেত। শেখ হাসিনাই মূলত বিশ্বনেতার রোল মডেল। এটি হচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা। সেখানে কী করে আমাদের এই আগামী সাধারণ নির্বাচনে সুশীলসমাজ হ্যালুসিনেশনে ভোগে আমি তো বুঝি না। যে যা-ই বলুক না কেন, তাদের কোনো সুসংগঠিত দল নেই। তারা একেকবার এক ইঞ্জিন তৈরি করছে এবং অনেক মিডিয়া থাকার জন্য প্রচার পাচ্ছে। কিন্তু তাদের পেছনে জনগণের সাপোর্ট নেই। অর্থাৎ কোনো বগি নেই। তাহলে বগি ছাড়া রেললাইনে শুধু ইঞ্জিন থাকলে তো কোনো কাজ হবে না। যিনি ১০০ বছরের কথা ভাবেন, সে রকম একজন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ককে কোনোভাবেই আগামী নির্বাচনে সরানো সম্ভব নয়। আমি আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই। এবার যে ইলেকশন কমিশনার করেছেন, তার মতো একজন সৎ, স্পষ্টবাদী একজন মানুষ বাংলাদেশেই কম পাওয়া যায়। সুতরাং তিনি সঠিকভাবেই নির্বাচন করবেন। নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন ও সরকার। সরকার তো নিজে যায় না। সরকারের পক্ষ থেকে যেমন স্কুলের শিক্ষকরা নির্বাচনের বিভিন্ন কাজে থাকেন, তারপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকে। সেনাবাহিনী পর্যন্ত থাকে। প্রত্যেকে যে যার দায়িত্ব পালন করবে। এখানে শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে কাজটি তিনি ইতোমধ্যে সেটিই করে চলেছেন। সেটি হচ্ছে সংবিধান অনুযায়ী এবং সংবিধানের একটি দাঁড়ি, কমা পরিবর্তন হলে নির্বাচন হবে না। সুতরাং ওই হ্যালুসিনেশনে ভুগে খামাখা কাচ্চি বিরিয়ানি খেয়ে কোনো লাভ নেই। বরং যদি আপনাদের পরবর্তী কোনো নির্বাচনে জেতার আশা-ভরসা মনে পোষণ করেন, সেজন্য বরং আমার মনে হয় এখন থেকেই প্রস্তুতি নিলে ভালো হয়। না হলে আপনারা যে পথে চলছেন, জনগণ থেকে আপনারা বিচ্ছিন্ন আছেন, আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তো আপনাদের সঙ্গেই নেই। যেহেতু দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সঙ্গে শতকরা ৮০ ভাগ লোক ইতোমধ্যে আছেন, আর ২০ ভাগ লোকও বিভিন্ন দিকে রয়েছে। এ ২০ ভাগ দিয়ে দেশের সরকার পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। সুতরাং আগামী নির্বাচনে সুশীলসমাজের হ্যালুসিনেশন কোনো কাজে লাগবে না।

 

লেখক : সাবেক উপদেষ্টা, চেয়ারম্যান, বিএমআরসি।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর