শনিবার, ১১ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

লাগামহীন ডলারের মূল্য সর্বনাশা প্রবণতা

মেজর আখতার (অব.)

লাগামহীন ডলারের মূল্য সর্বনাশা প্রবণতা

ডলারের মূল্য অব্যাহতভাবে বাড়ানো চলছেই। ৫ জুন, ২০২২ একবারে বাড়ানো হয়েছিল ১ টাকা ৬০ পয়সা। আবার তার পর দিন বাড়ানো হয়েছে ৪৫ পয়সা। ফলে দুই দিনে ডলারের দাম বাড়ে ২ টাকা ৫ পয়সা। এর ফলে সর্বশেষ প্রতি ডলারের টাকার বিনিময়মূল্য দাঁড়িয়েছে ৯১ টাকা ৯৫ পয়সা। ৬ জুন, ২০২২ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৯১ টাকা ৯৫ পয়সা দামে ডলার বিক্রি করেছে। তার মানে ডলার ব্যবসা করে বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিনের ব্যবধানে ২ টাকা ৫ পয়সা অতিরিক্ত মুনাফা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ৬ জুন ৯১ টাকা ৯৫ পয়সা দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ১৩ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। সরকারি খাতে আমদানি ও বেসরকারি খাতে আমদানি হওয়া খাদ্যপণ্যের বিল মেটাতে এ ডলার বিক্রি করা হয়। অর্থাৎ জনগণের খাদ্যপণ্য আমদানি করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিনেই জনগণের পকেট থেকে কেটে নিয়েছে ২৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে বা বিদেশের ব্যাংকে এ ১৩ কোটি ডলার জমা ছিল। এলসি খোলা হয়ে গিয়েছিল এবং খাদ্যপণ্য দেশে এসে গিয়েছিল বা জাহাজে ছিল। তাহলে ওইসব আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যের জন্য বেশি বা অতিরিক্ত মূল্যে ডলার কার স্বার্থে বিক্রি করা হলো তার হিসাব পাই পাই নেওয়ার অধিকার আছে বলে জনগণ মনে করে।

এদিকে আরও খেলা চলছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্যে জানা যায়, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ডলারের নতুন দামকে বলা হচ্ছে আন্তব্যাংক দর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন ব্যাংক ডলারের বিভিন্ন দাম দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯১ টাকা ৯৫ পয়সায়। তবে ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের কাছ থেকে প্রতি ডলারের জন্য ৯৫ টাকার বেশি দাম নিচ্ছে। আর প্রবাসী আয় আনছে ৯৩ থেকে ৯৪ টাকা দরে।’ সোজাসাপ্টাভাবে দেখা যাচ্ছে ডলার ব্যবসার রমরমা অবস্থা। ব্যাংকগুলো যে যেভাবে পারছে ডলার ব্যবসা করে দেদার কামিয়ে নিচ্ছে। আর এদিক দিয়ে খাদ্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে, যা দেখার কেউ নেই! অথচ ব্যাংকগুলোর ডলার বেচাকেনার ব্যবসা করার কথা নয়। ব্যাংক কমিশনে ডলার লেনদেন করবে এবং সে কমিশন কোনো অবস্থাতেই হাজারে ১ টাকার বেশি হবে না। আরেক খেলা চলছে প্রবাসীদের আয় নিয়ে। প্রবাসী আয় আনতে ২ জুন ডলারের দামের সীমা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

ওই দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হয়, বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যাংকগুলো নিজেরাই ডলারের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। এর পর থেকে তিন দিনে তিন দফা ডলারের দাম বাড়ল। ব্যাংকাররা বলছেন, প্রবাসী আয়ে বড় ধাক্কা এসেছিল ডলারের দাম বেঁধে দেওয়ার কারণে। ফলে বিগত মে-তে নাকি প্রবাসীরা ১৮৮ কোটি ডলার পাঠিয়েছিল, যা এ বছরের এপ্রিল ও গত বছরের মে-র তুলনায় কম। তাদের মতে, গত বছরের মে-তে আয় এসেছিল ২১৭ কোটি ডলার। ফলে প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। জানা যায়, বিদায়ী মাসে কিছু ব্যাংক প্রবাসীদের কাছ থেকে প্রতি ডলার ৯৫ টাকার বেশি দামে কিনেছে। আর এ ডলার দেশে বিক্রি করেছে আরও বেশি দামে। এতে চাপে পড়েছে জনগণ। কারণ ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে খাদ্যদ্রব্যসহ ভোগ্যপণ্যের দাম। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২৯ মে প্রবাসী আয়ে সর্বোচ্চ ৮৯ টাকা ২০ পয়সা দর বেঁধে দেয় ব্যাংকগুলোকে। ফলে বৈধ পথে প্রবাসী আয় মাসের শেষ তিন দিনে কমে যায়। কিন্তু এ হিসাবগুলো দেওয়া হচ্ছে খুবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। কারণ আমাদের সবার খেয়াল রাখা উচিত ছিল ঈদ-পরবর্তী মাস হলো মে। ফলে ঈদের পর মে-তে সাধারণভাবেই প্রবাসী আয় কমে যাবে। সেখানে ঈদের পর অর্থাৎ এপ্রিলের পর ১৩ শতাংশ কমে যাওয়া কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। তা ছাড়া ২০২১ সালে ঈদ ছিল মে-র মাঝামাঝি যার ফলে ওই মাসে প্রবাসী আয় বেশি আসাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু একটি মহল তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে মে-তে প্রবাসী আয় কমে গেছে বলে সংবাদ প্রচার করে দেশে একটি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করে। যা দেখার কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। এ ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগে অনেক বিত্তবান প্রবাসী উচ্চমূল্য পাওয়ার আশায় তাদের আয় ধরে রাখেন। যার ফলে সাময়িকভাবে প্রবাসী আয় দেশে আসা কিছুটা কমে যায়। কিন্তু ডলারের মূল্য যদি স্থিতিশীল থাকে তাহলে ডলার আয়ের প্রবাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ দেশি ও বিদেশি ডলার ব্যবসায়ীদের ডলার কিনে মজুদ রেখে পরবর্তীতে বেশি দামে বিক্রি করার নিশ্চিত সুযোগ করে দেয়। তাই সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতায় ছেদ পতন আনার। কিন্তু তা করতে কর্তৃপক্ষ দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন; যার জবাবদিহির কেউ নেই!

এদিকে খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯৬-৯৭ টাকায় যা প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছে। মাঝখানে একবার ডলারের দাম ১০০ টাকায় উঠে গিয়েছিল। বিদেশে হুন্ডিতেও ৯২-৯৩ টাকা দরে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করা হচ্ছিল। কিছুদিন আগে ব্যাংকগুলো ৮৯ টাকা ২০ পয়সা দর দিয়েছিল। এতে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা কমে গেছে। ব্যাংকাররা তাদের কায়েমি স্বার্থে বলার চেষ্টা করছেন, দামের বড় ধরনের তারতম্যের কারণে বৈধ পথের চেয়ে প্রবাসী আয় হুন্ডিতে চলে যাচ্ছে। কারণ হুন্ডিতে পাঠালে প্রতি ডলারের বিপরীতে ৯৫ টাকার কাছাকাছি নাকি দাম দেওয়া হতো বলে তারা অপপ্রচার চালিয়েছিলেন। এর ফলে রাতারাতি ডলারের মূল্য ১০০ টাকার ওপরে উঠে যায়।। মেমোরিয়াল দিবসের কারণে গত সোমবার আমেরিকায় লেনদেন বন্ধ ছিল। আর রবিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ফলে দুই দিনে কোনো প্রবাসী আয় আসেনি। কারণ প্রবাসী আয় দেশের ব্যাংকগুলোর নিউইয়র্কের বিভিন্ন হিসাবে ডলারে জমা হয়। যাই হোক, এ ধরনের পরিকল্পিত পরিবেশ সৃষ্টি করে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দাম আবারও পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে তা পূরণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বাধ্য করতে সফল হয়। ব্যাংকারদের চাপে এক দিনেই দুই সিদ্ধান্ত দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল তা তুলে নিয়েছিল এবং বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যাংকগুলো নিজেরাই ডলারের দাম নির্ধারণ করতে পারবে বলে ঘোষণা দেয়। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম ৮৯ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করে দিয়ে বলেছিল হঠাৎ যেন ডলারের দাম বেশি বাড়িয়ে না ফেলা হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। পাশাপাশি বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো যাতে দাম বেশি বাড়াতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে বলা হয়েছিল। অথচ এহেন সিদ্ধান্ত দেওয়ার তিন দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই ডলারের দাম ২.০৫ টাকা বাড়িয়ে দেয়। এখন আমদানিকারকদের আরও বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে এবং কিনতে হবে। সামনের দিনে তা আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। এর ফলে বাড়বে আমদানি ব্যয়, যার প্রভাব পড়বে পণ্যের দামে। আরও বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে তখন জনগণকে। অথচ এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা দেখা যাচ্ছে না।

ডলার নিয়ে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে তা সবই আত্মঘাতী ও ষড়যন্ত্রমূলক। এর ফলে জনজীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। সবকিছু জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। মনে হয় সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে যাতে ক্ষমতা পরিবর্তনে কেউ আগ্রহী না থাকে! রপ্তানিকারকদের আয় বাড়ছে কিন্তু তারা শ্রমিকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াচ্ছে না। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের ব্যবসায়িক লাভ হচ্ছে এবং তাদের মুনাফা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকও তাদের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়াচ্ছে না।

ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জনগণ। জনগণের স্বার্থে ডলারের দাম বাড়ানো নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। ডলারের মূল্য নির্ধারণ ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি। গ্রামেগঞ্জে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি প্রবাদ আছে, ‘শুঁটকির নৌকার বিড়াল মাঝি’। ব্যাংক সুদ তথা লাভের ব্যবস্য করে। একসময় ব্যাংকগুলো লগ্নি করতে সুদের হার ১৮ শতাংশে নিয়ে গিয়েছিল। বর্তমান সরকার তা ৯ শতাংশে নামিয়ে আনে যার শতভাগ কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রীর। সুদের খেলাটি ছিল আমানত ও ঋণের ওপর সুদহার ধার্য নিয়ে। ব্যাংকারদের যুক্তি ছিল- চড়া সুদে আমানত নিলে চড়া সুদেই ঋণ দিতে হবে। সুদহার নিয়ন্ত্রণে সমাধান করা হলো- আমানতের ওপর সুদহার কমিয়ে ঋণের ওপর সুদহার কমাতে হবে যাতে উৎপাদন খরচ কমে এবং জনগণ স্বস্তি পায়।

ডলার নিয়ে এখন খেলা চলছে। সবাই বলাবলি করছে ডলারের দাম আরও বাড়বে। তাই যদি হয় তাহলে রপ্তানিকারকরা কি এতই বোকা যে তাদের রপ্তানি আয় চটজলদি দেশে নিয়ে আসবেন! প্রবাসীরা তাদের আয় হাতে ধরে না রেখে বোকার মতো তাড়াতাড়ি দেশে পাঠিয়ে দেবেন! ব্যাংকাররা তাদের লাভ বুঝবেন আর রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা বুঝবেন না!

তাই ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণের খেলাটিও সুদহার নিয়ন্ত্রণের মতো। এখানে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম কমাতে ও স্থিতিশীল রাখতে হবে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে যদি আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা সম্ভব না হয় তাহলে প্রথমত দেশে উৎপাদন বাড়িয়ে রপ্তানি বাড়াতে হবে যাতে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়ত, জনসম্পদ আরও দক্ষ করে বেশি বেশি কর্মীকে বিদেশে পাঠিয়ে প্রবাসী আয় বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, যেসব দেশ থেকে বেশি আমদানি হয় তাদের কাছ থেকে বিনা সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিতে হবে। না দিলে ওইসব দেশ থেকে আমদানি কমিয়ে দিতে হবে। চতুর্থত, বাণিজ্য ঘাটতি পূরণের জন্য আইএমএফের কাছ থেকে নামমাত্র সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিতে হবে।

আমদানি নিয়ন্ত্রণ বা সংকোচন কোনো সমাধান আনবে না। তাতে বরং দুর্নীতি বাড়বে এবং চাহিদা সৃষ্টি করে সংকট ঘনীভূত করবে। প্রয়োজনে আমদানি-বিকল্প উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি খরচ কমাতে হবে। আমদানি ও রপ্তানি বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সুসম্পর্ক গড়ার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজ। একা একা বাস করা সম্ভব নয়। নিজেদের তাকাব্বরি বা হামবড়াভাব পরিহার করে মিলেমিশে চলার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হতে হবে। সৃষ্টিকর্তাকে শুধু নিজেদের অংশীদারিতে না রেখে সর্বজনীন এবং পথ-মত ও ধর্মের প্রতি সম্মান রেখে সহাবস্থান করা জনগণের জন্য অনেক বেশি কল্যাণকর হবে। না হলে সংঘাত ও ধ্বংস ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না। মানুষ অজেয় ও চিরঞ্জীব নয়। পরাজয় ও মৃত্যুর স্বাদ সবার জন্য অবধারিত। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

পরিশেষে একটি ছোট্ট কথা সবার জন্য বিনীতভাবে বলতে চাই। পৃথিবী থাকবে কিন্তু আমি থাকব না এবং আমাকে ছাড়া সবকিছু চলবে এবং আরও অনেক ভালোভাবে চলবে। কাজেই আমি কোন ছার- দূর হ আপদ!

            লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর