রবিবার, ১৯ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

বাজেটে কৃষি : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

শাইখ সিরাজ

বাজেটে কৃষি : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণার পর সাধারণ মানুষ মূলত সংবাদমাধ্যম থেকে জানতে পারে কোন জিনিসের দাম বাড়বে, আর কোন জিনিসের দাম কমবে। এটুকুই। এর বেশি কিছু ভাবতে চায় না তারা। জানেও না। কিন্তু জাতীয় এ বাজেট কেবলই পণ্যের দাম বাড়া কিংবা কমার বিষয় নয়। আপনি সরকারকে কী দিচ্ছেন আর সরকার আপনাকে কী দিচ্ছে তার একটি হিসাব বলা যায় একে। আমি যখন এ লেখা লেখছি তখন জাতীয় সংসদে বাজেট ঘোষণা শেষ হয়েছে। আমার সামনে বাজেটের কৃষি খাতের অংশটুকুর প্রিন্ট কপি। বাজেটে কৃষি ক্ষেত্রে (কৃষি, খাদ্য এবং মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ) ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৩৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। যা গত বছর ছিল ২৪ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যার বড় একটি অংশ হয়তো খরচ হবে সারের ভর্তুকিতে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে সারের ভর্তুকির পরিমাণ ধরা হয়েছিল সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য সারের ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি ধরেছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। যদিও চাহিদার বিপরীতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভর্তুকির এ পরিমাণও বেড়ে যেতে পারে। যেসব দেশ থেকে আমরা সার আনি যেমন মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন, রাশিয়া সেখান থেকে সার আনার পর সরকার ভর্তুকি দেয়। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ সারের মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ। সারে সরকারের লাগাতার ভর্তুকিই আমাদের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক। কিন্তু সরকারই বা আর কত ভর্তুকি দেবে! সার উৎপাদনেও আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। সার কারখানার পরিধি ও কর্মকান্ড বাড়াতে হবে। বিশ্ব সার বাজার যে সব সময় আমাদের অনুকূলে থাকবে এমন নয়। তাই নিজেদের যা আছে ও যতটুকু প্রয়োজন তা চিহ্নিত করে সঠিক পরিকল্পনা নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে সততা আর দেশপ্রেম বুকে ধারণ করে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সরকারের লক্ষ্য বা স্বপ্ন হচ্ছে ২০৩১ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্বের ২০টি উন্নত দেশের একটি হওয়া। আমরা জানি কভিড-১৯ আমাদের অনেকখানি পিছিয়ে দিয়েছে। বৈশ্বিক প্রভাবও রয়েছে এখানে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং সাম্প্রতিক ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বে যে আঘাত করেছে তাতে আমাদের মতো রাষ্ট্রের জন্য সব ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে। একটি বিষয় উল্লেখ্য, উন্নত রাষ্ট্রে এসব নেতিবাচক প্রভাব মাথায় রেখে যে গতিতে শিক্ষা, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, উৎপাদন এগিয়েছে আমরা সেভাবে এগিয়ে যেতে পারছি কি না। বিশ্বায়নের এ সময়ে কোনো রাষ্ট্রই আর একক কোনো রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশও গ্লোবাল ভিলেজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বড় বিষয়ের ভিতর ছোট ছোট কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিরূপণ করার কাজটি আমাদেরই করতে হবে। বিশেষ করে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং বা যে কোনো খাতে আমাদের সক্ষমতা অর্জনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রতিদিন। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় আমরা ইঙ্গিত পেলাম বৈশ্বিক পরিস্থিতির। এখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধটি যদি লম্বা সময় ধরে চলে তাহলে আমাদের অবস্থা কী হবে? এ প্রশ্নে প্রাত্যহিক জীবনের নানান ইস্যুর মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও স্বাভাবিকভাবে চলে আসে। আমাদের ৮০ ভাগ গম, ৮০ ভাগ দুধ আমদানি করতে হয়। তেল, আটা-ময়দা, জ্বালানি তেল বলা চলে পুরোটাই আমদানিনির্ভর। এ অবস্থায় টিকে থাকার সক্ষমতা আমাদের কতটুকু আছে। কত দিন এভাবে মোকাবিলা করে যাব আমরা। আমাদের দেশের ভিতরে নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে যে কৃষিপণ্যগুলো আমরা সাধারণত বাইরে থেকে আমদানি করি সেগুলোর উৎপাদন বাড়াতে হবে। বাজেটে এ বিষয়গুলোয় সুস্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। যুগের পর যুগ ধরে কি আমরা আমদানিনির্ভর থাকব, যেখানে প্রাধান্য পাবে ব্যবসায়িক স্বার্থ?

আমার বিশ্বাস, স্বাধীনতার পর থেকে এতগুলো বছরে আমরা বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর হতে পারতাম। একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে কৃষিজমি কমেই চলেছে। তার পরও এ দেশের কৃষকই ধানের উৎপাদন বাড়িয়েছে এত সংকটের ভিতরেও। আমি বিশ্বাস করি, উন্নয়নের সোপানে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে ওঠা উচিত আমাদের। যদিও অনেক উন্নয়ন ইতোমধ্যে সাধিত হয়েছে, তার পরও আমাদের আর বসে থাকার সময় নেই। চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

উন্নত বিশ্বে সুগার বিট থেকে চিনি হয়। আমাদের সে পথে হাঁটা উচিত। আমাদের বোঝা উচিত কোথায় আমাদের টাকা বিনিয়োগ করা দরকার। অথচ ভর্তুকি দিয়ে আমরা কলকারখানা চালু রেখেছি! বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কৃষিতে বিনিয়োগের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতি বছরই কৃষি ও পল্লীঋণ নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩০.৫৫ লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিকে প্রায় ২৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লীঋণ প্রদান করা হয়েছে। এবারও বাজেটে রেয়াতি সুদে ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ প্রদানের তহবিল ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। তবে এ ঋণ যেন প্রকৃত কৃষকের ও কৃষি খাতের জন্যই দেওয়া হয়। এর আগে কৃষি খাতের কথা বলে ঋণ নিয়ে শিল্প খাতে বিনিয়োগের প্রচুর খবর আমরা পেয়েছি। বাটার আমদানিতে ২০% সম্পূরক শুল্ক আগে ছিল। এবার চিজ বা পনির আমদানিতেও ২০% সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে আমাদের চিজ বা পনির শিল্প গড়ে ওঠার একটা সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। বলা বাহুল্য, আমাদের দেশে পনিরের বড় একটা চাহিদা রয়েছে। আমি দেখেছি গ্রামে অনেক কৃষক দুধের ঠিক দাম পায় না। আবার দুধ সংরক্ষণ করতে না পারায় কম দামে বিক্রি করে দিতেও বাধ্য হয়। অথচ পনিরের একটা ভালো বাজার তৈরি হয়ে আছে। শুধু উৎপাদক ও বিপণনের একটা চেন তৈরি করা গেলেই কৃষক ও নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য একটা লাভজনক বাজার তৈরি হতে পারে। খাদ্যশস্য সংরক্ষণের বিষয়টি বাজেটে উল্লেখ থাকলেও পরিবর্তিত কৃষি সম্পর্কে আরও বেশি আলোকপাতের প্রত্যাশা ছিল।

সারা বিশ্বেই কৃষি শুধু কৃষি নয়, কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টিও। একই সঙ্গে পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রযুক্তির কৃষির বিকল্প নেই। সে জায়গাটিতে আমাদের অগ্রগতি নগণ্য। জমি কর্ষণে যন্ত্রের ব্যবহার হলেও ফসল হার্ভেস্ট থেকে সংরক্ষণ বা প্রক্রিয়াজাতকরণে যান্ত্রিকীকরণ ততটা হয়নি। অথচ উন্নত বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে প্রবেশ করেছে। আইওটি, রোবটিকস কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন যেমন সম্ভব হবে না; তেমনি উৎপাদনের হার বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে। খাদ্যপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ভালো কৃষিচর্চা (গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস) যেমন জরুরি, দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবেও এ চর্চা আমাদের রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রযুক্তির কৃষির বিকল্প নেই। স্মার্ট ফার্মিং, আধুনিক কৃষির সবকিছুই এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের এ দিকটিতেও জোর দিতে হবে। শুধু পরিকল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে মাঠে নেমে পড়তে হবে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে এবং আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বাংলাদেশ তা করে দেখাতে পারবে। গ্রিনহাউসের জন্য যে পলিনেট দরকার হয় তা আমাদের আনতে হয় ভারত থেকে। মূলত ইসরায়েল থেকে আসে ভারতে। তারপর সেখান থেকে আমাদের দেশে। এত খরচ করে আমাদের কতটাই বা পোষাবে? কৃষিপ্রযুক্তির বিকাশে ও দেশি কৃষিকৌশলের জন্য নিজস্ব যন্ত্রপাতি তৈরিতে উদ্যোগী হতে হবে। বাড়াতে হবে কৃষি গবেষণায় বরাদ্দ। পরিকল্পনার এ দিকগুলো বাজেটে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাসহ উঠে আসবে- এমনটিই প্রত্যাশা।

আগামীর বাজেট পরিকল্পনার ধারাবাহিকতায় এবং শতবর্ষী বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আগামী পাঁচ বছরের ভিতরই আমাদের একটি সুস্পষ্ট উন্নয়ন-লেখচিত্রের নানাবিধ সূচক দৃশ্যমান হবে বলে বিশ্বাস করি। পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রয়োজন বাস্তবিক প্রায়োগ। প্রয়োজন সম্পদের সুষম বণ্টন এবং উৎপাদনের ভারসাম্য। বিশেষ করে আমরা যদি কৃষিকে কেন্দ্র করে বিশ্ববাজারে আস্থার সঙ্গে অংশ নিতে পারি, আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ পাল্টে যাবে। আজকের ভর্তুকির কৃষিই একদিন হয়ে উঠবে টেকসই অর্থনীতির নির্ভরতম খাত।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর