মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

পদ্মা সেতু : বদলে যাবে অর্থনীতি

মো. আতাউর রহমান প্রধান

পদ্মা সেতু : বদলে যাবে অর্থনীতি

‘যত দূরে যাও পাখি দেখা হবে ফের/স্বাধীন ওই আকাশটা শেখ মুজিবের।’

লাল-সবুজের এ সাড়ে ৫৫ হাজার বর্গমাইলের যেখানেই আমরা দাঁড়াই, ইতিহাস কি ভবিষ্যতের যে বাঁকেই আশ্রয় খুঁজি অবধারিতভাবে সেখানে সত্য হয়ে ওঠে এ পঙ্ক্তিমালা। এ জাতির স্রষ্টা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আলোকচ্ছটা এখনো এ দেশকে, দেশের মানুষকে বিলিয়ে যাচ্ছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা, বঙ্গবন্ধুর পবিত্র রক্তের উত্তরাধিকার বিশ্বনেতা হয়ে ওঠা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব, সাহস আর বিচক্ষণতায় আমরা পেতে যাচ্ছি দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কাক্সিক্ষত স্থাপনা কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। মাত্র দুই যুগ আগেও যা ছিল আমাদের কাছে স্বপ্ন, কল্পনার ক্যানভাসের মতো। বঙ্গবন্ধুকন্যার বিশুদ্ধ দেশপ্রেম ও চ্যালেঞ্জের সুফল হিসেবে আজ তা মহাসত্য। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময় ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থায় বিপুল পরিবর্তন ও অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হতে শুরু করে। তাঁর সরকারের সময় ১৯৯৯ সালে পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ শুরু হয়। তাঁর মেয়াদের শেষ দিকে ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধুকন্যাও তাঁর বাবার মতোই জীবনযুদ্ধ মোকাবিলায় আত্মনির্ভরশীলতায় বিশ্বাসী। তিনি সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখিয়েছেন জাতিকে। এ সেতু তাই কেবল একটি সুবিশাল স্থাপনা কিংবা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভিত নয়, এটা আমাদের জাতীয় সমতার অনন্য প্রতীক। বাঙালির আত্মপ্রত্যয়, অহংকার ও গর্বের এক মিনার। প্রবল দেশপ্রেমে বলীয়ান বঙ্গবন্ধুকন্যার ইস্পাতদৃঢ় মনোবলই ছিল পদ্মা সেতুর মূল ভিত্তি। ইতিহাসেরও কি আশ্চর্য মিল; ১৯৭১ সালে জাতির পিতা আমাদের উপহার দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব শতবর্ষে তাঁরই সুযোগ্য কন্যার বদৌলতে পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যানটি দৃশ্যমান হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমতার প্রতীক হিসেবে দৃশ্যমান হয়ে উঠল পদ্মা সেতু। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণের শুরুর পথটা মসৃণ ছিল না। শুরুতে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করে। মূল ঋণদাতা হিসেবে সম্মত হয় বিশ্বব্যাংক। সেই সঙ্গে জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও অর্থায়নে সংশ্লিষ্ট ছিল। কিন্তু এর পরই দেশি-বিদেশি একটি গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে সেতুর পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ তোলে বিশ্বব্যাংক। সে অভিযোগ প্রমাণ না করতে পারলেও ২০১২ সালের ২৯ জুন পদ্মা সেতু প্রকল্প চুক্তি বাতিল করে তারা। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একে একে অন্যান্য ঋণদাতা এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও সরে যায়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি অনেকের কাছেই ছিল অবাস্তব। অনেকেই পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন দক্ষভাবে সেতুটি নির্মাণের জন্যই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশের মানুষকে বিশ্বের দরবারে ছোট হতে দেননি। তিনি সাহস আর উচ্চ মনোবল নিয়ে সব ধরনের সংশয় ও সমালোচনা অগ্রাহ্য করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য অদম্য স্পৃহায় এগিয়ে যান।

পদ্মা সেতু নিয়ে সে সময় দেশি-বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র রুখে দিতে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১২ সালের জুলাইয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা জানান। শুরু হয় দেশে গণজাগরণ। দেশের মানুষ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা শুনে তারা সবাই সরকারকে সহযোগিতা করার ইচ্ছা পোষণ করেন। সে সময় সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের স্থানীয় কার্যালয়ে খোলা হয় দুটি হিসাব। সেখানে শত শত মানুষ তাদের কষ্টার্জিত অর্থ জমা করেন। হয়তো বা সেই অর্থ কোনো রিকশাচালকের অর্থ, কোনো স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীর অর্থ, কোনো দিনমজুরের অর্থ; যা ছিল আবেগ ও ভালোবাসায় ভরা। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি মূল সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। পরে ২০১৭ সালে কানাডার আদালত পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের তোলা অভিযোগের মামলা ভুয়া বলে রায় দেন। আজ এক যুগ পর এসে মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সে সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল। ওই অবস্থায় নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন কেবল তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেই।

অবকাঠামোগত দিক দিয়ে পদ্মা সেতু বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ স্থাপনা। প্রমত্তা পদ্মায় পানির নিচে প্রায় ৪০ তলার ভবনের সমান পাইলিং করে নির্মিত এ সেতুতে মোট ৪২টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যান বসানো হয়েছে। সেতুর মূল দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই স্তরবিশিষ্ট সেতুর ওপরের স্তরে রয়েছে ২২ মিটার প্রস্থের চার লেনের সড়ক এবং নিচের স্তরে নির্মাণ করা হবে ব্রডগেজের সিঙ্গেল লাইন রেলপথ। সেতুর দুই প্রান্তে উড়ালপথ, রেলপথের জন্যও উড়ালপথ, সেতুতে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত মহাসড়ক (এক্সপ্রেস), সংযোগ সড়কের পাশাপাশি সেতুতে রয়েছে গ্যাস সঞ্চালন লাইন, ফাইবার অপটিক্যাল ও টেলিফোন ডাক্ট। সেতুর ভাটিতে তৈরি হচ্ছে হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ লাইন। এ ছাড়া সেতুর দুই পাশে টোল প্লাজা, পুলিশ স্টেশন, সার্ভিস এরিয়া, ওজোন স্টেশন, জরুরি সহায়তা কেন্দ্র, বক্স কালভার্ট, আন্ডারপাসসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে সরাসরি এর সুবিধা ভোগ করবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা। এসব জেলার কয়েক কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের এ সেতু চালু হলে বদলে যাবে তাদের জীবনধারা। কৃষি-শিল্পসহ সব খাত পাবে উন্নয়নের বিপুল গতি। এ অঞ্চল পরিণত হবে দেশের প্রধান উৎপাদন কেন্দ্রে। এসব এলাকার উৎপাদিত পণ্য বিশেষত কৃষি ও পচনশীল পণ্য সহজেই রাজধানীতে প্রবেশ করতে পারবে। পায়রা, মোংলা ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে পুরো দেশের অর্থনীতিতে আসবে নতুন জোয়ার। প্রসার ঘটবে খুলনার হিমায়িত মাছ ও পাট শিল্পের। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব অনেকাংশে কমে গিয়ে দেশের অভ্যন্তরে বাণিজ্য ঘাটতিও কমে আসবে।

ইতোমধ্যে সেতুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। পদ্মার চরে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, বিমানবন্দর ও জাজিরার নাওডোবায় শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং, মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ী, চরজানাজাত ও শরীয়তপুরের জাজিরায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার যে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হবে।

সমীক্ষা বলছে, সেতুটি চালুর পর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি পাবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রতি বছর দারিদ্র্য কমে আসবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ। এ ছাড়া ২১ জেলার প্রায় ৬ কোটি মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে ভাগ্যের পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। এডিবির এক সমীক্ষা অনুযায়ী, পদ্মা সেতু দিয়ে ২০২২ সালে চলাচল করবে অন্তত ২৪ হাজার যানবাহন, এর মধ্যে বাস চলবে ৮ হাজার ২৩৮টি, ট্রাক ১০ হাজার ২৪৪টি, মাইক্রোবাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলবে ৫ হাজারের বেশি। ২০২৫ সাল নাগাদ সেতুর ওপর দিয়ে দিনে যান চলাচল বেড়ে দাঁড়াবে ২৭ হাজার ৮০০টিতে, ২০৩০ সালে ৩৬ হাজার ৭৮৫টিতে এবং ২০৪০ সালে ৫১ হাজার ৮০৭টিতে। শুধু এর মাধ্যমেই কর্মসংস্থান হবে কোটি মানুষের। আদতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মনে হলেও প্রকৃত অর্থে পদ্মা সেতু পুরো দেশের অর্থনীতির জন্যই এক দারুণ ভিত্তি হিসবে কাজ করবে। ধীরে ধীরে এটি পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পর্যটন বদলে দেবে। এমনকি সেদিন বেশি দূরে নয় এ সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

বহুল আকাক্সক্ষার পদ্মা সেতু ও সংযোগ সড়ক এশিয়ান হাইওয়ে রুট এএইচ-১-এর অংশ হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের দারুণ সুযোগ তৈরি হবে। এ ছাড়া সেতুটির মাধ্যমে ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযুক্তি ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ তৈরি এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সুবিধা তৈরির মাধ্যমে আর্থিক প্রবৃদ্ধি আনবে। প্রসারিত হবে এসব রুটের সঙ্গে সম্পৃক্ত পর্যটনের ক্ষেত্রে। অর্থনীতিতে বাংলাদেশের যে ক্রমোন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে এবং ২০৩৫-৪০ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছবে তার পেছনে বিশাল ভূমিকা থাকবে পদ্মা সেতুর।

লেখক : সিইও অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টও, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর