বুধবার, ২২ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

জাতীয় গৌরবের পদ্মা সেতু

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

জাতীয় গৌরবের পদ্মা সেতু

২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন। মাত্র  ৬ মিনিটে পাড়ি দেওয়ার মতো বিশাল এ সেতু নির্মাণ যেমন বাংলাদেশের জন্য গর্বের, তেমনি বিশ্বের মানচিত্রেও স্থান হয়েছে বৈচিত্র্যময় এ সেতুর। কারণ পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে ক্রেন ব্যবহার, নদীশাসন, পাইল ও বিয়ারিংয়ের কয়েকটি আন্তর্জাতিক রেকর্ড হয়েছে। বিশ্বে এ পর্যন্ত কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে পাইলিং ও মোটা পাইল বসানো হয়নি। ১২০-১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে বসানো হয়েছে পদ্মা সেতুর পাইল, এও বিশ্বে রেকর্ড গড়েছে। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো সক্ষমতা রয়েছে পদ্মা সেতুর। সেতুতে ব্যবহৃত একেকটি বিয়ারিংয়ের ওজন ১০ হাজার ৫০০ টন। বিশ্বে কোনো সেতুতে এমন ওজনের বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি। বিশ্বে এই প্রথম কোনো সেতু নির্মাণে কংক্রিট ও স্টিল উভয়ই ব্যবহৃত হয়েছে, আর কোনো সেতু নির্মাণে কংক্রিট ও স্টিলের ব্যবহার একসঙ্গে দেখা যায়নি।

পদ্মা সেতু নানা কারণেই বিশ্বের বিস্ময়। পুরো সেতুটি বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে তৈরি এবং কোনো দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সংস্থা এতে আর্থিক অবদান রাখেনি। দেশি-বিদেশি নির্মাণ কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ সেতু তৈরিতে বিদেশি সাহায্যও নেওয়া হয়নি। কিছু মহল পদ্মা সেতু বিদেশি অর্থায়নে তৈরি হয়েছে এবং একে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ হলো চীনের উদ্যোগে শুরু হওয়া এমন এক কৌশল যাতে এশিয়ার সঙ্গে সরাসরি আফ্রিকা ও ইউরোপের সড়ক ও সমুদ্র যোগাযোগ তৈরি হবে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে এখন প্রতিদিন সন্ধ্যায় একসঙ্গে জ্বলে ওঠে ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্টের বাতি, দেখা দেয় আলোর ঝিলিক। পদ্মা সেতুর স্প্যানের ভিতর দিয়ে নেওয়া হয়েছে ৭৬০ মিলিমিটারের গ্যাস সঞ্চালন এবং ১৫০ মিলিমিটার অপটিক্যাল ও টেলিফোন ডাক্ট। এর বাইরে পদ্মা সেতুর ২ কিলোমিটার ভাটিতে হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ সঞ্চালন তৈরি করা হয়েছে। প্রকৃতিতে ঘন কুয়াশা বা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন অর্থাৎ আলোস্বল্পতা থাকলে বাতিগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে ওঠে। মাওয়া প্রান্তে থাকছে আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্র। কুয়াশা, বড় কোনো ঝড় কিংবা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে পদ্মা সেতুতে দেখা যাবে পূর্বাভাস, দুর্যোগের দুই ঘণ্টা আগেই জানা যাবে এসব তথ্য। পদ্মা সেতুর ফলে যেসব জেলা সরাসরি লাভবান হবে তার অন্যতম বাগেরহাট। পদ্মা সেতুর কল্যাণে বিরাট পরিবর্তন আসছে সবুজে ঘেরা এ জেলায়। ইতোমধ্যে এ জেলার চিত্র পদ্মা সেতু চালু হতে না হতেই পাল্টে যেতে শুরু করেছে। পিছিয়ে পড়া এ জেলার অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত অভূতপূর্ব উন্নয়ন শুরু হচ্ছে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, কর্মসংস্থান সব ক্ষেত্রেই পড়ছে অগ্রগতির ছাপ। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান জমি কিনছে। এখানে মোংলা বন্দর ও নির্মাণাধীন খানজাহান আলী (রহ.) বিমানবন্দরের ফলে জমির মূল্য বহুগুণ বেড়ে গেছে। পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে বাগেরহাটের মাছ, সবজি ধান ও পান বিশেষ ভূমিকা রাখে। সুন্দরবনসংলগ্ন বলে প্রাকৃতিক উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ মাছ আহরিত হয়। প্রতি বছর ৫০ হাজার মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন হয় এ জেলার পাঁচ উপজেলায়; এর সিংহভাগই ঢাকার বাজারে যায়। দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপিত হবে পদ্মা সেতু চালু হলে। পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলের অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। দীর্ঘদিনের বহু সমস্যার সমাধান তো হবেই, সেই সঙ্গে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বেকারত্ব দূরীকরণে। সবচেয়ে বড় কথা, এ অঞ্চলের পাশাপাশি গোটা দক্ষিণাঞ্চলের চেহারায়ও বিরাট পরিবর্তন ঘটবে।

যারা বন্দর ব্যবহার করছেন তাদের জন্য চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের চেয়ে মোংলা বন্দরের সুবিধা বেশি হবে। প্রধানত গাড়ি আমদানিতে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে মোংলার সুবিধা অনেক। তুলনামূলক খরচ কম, নিরাপদে গাড়ি রাখার সুবিধার ফলে চট্টগ্রামের চেয়ে মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি আনতে ব্যবসায়ীরা বেশি আগ্রহী। যানজট ও ফেরি জটিলতার কারণে মাছ ও সবজি নিয়ে যানবাহনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হতো পদ্মাপাড়ে। এখন অল্প সময়ে এসব মালামাল পৌঁছে যাবে ঢাকাসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয়। ফলে কৃষকের উৎপাদিত ফসল সহজেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাবে এবং কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবে। কৃষি ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গেছে। পদ্মা সেতুতেই বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে ভাবমূর্তির উজ্জ্বল শিখরে। নানা কারণেই এ সেতু আশ্চর্য ও গৌরবের। বিশেষভাবে  সাহসিকতার সঙ্গে দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে শতভাগ দেশি অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু মাথা উঁচু করে এখন দাঁড়িয়ে আছে। সেই সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে পৃথিবীর বুকে পদ্মা সেতু এক দারুণ ও অভূতপূর্ব বিস্ময়। সবচেয়ে বড় কথা, এটি আমাদের দেশের অর্থনৈতিক গতিধারায় আনবে আরেক আমূল পরিবর্তন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। সে কারণেই পদ্মা সেতুর বিরোধিতাকারীরা এখনো ষড়যন্ত্র করছে। শত্রুরা বসে নেই, তাদের উদ্দেশ্য একটাই- বর্তমান জনকল্যাণমূলক সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্যের অর্জন প- করা। জননেত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর দৃঢ়সংকল্প ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে জনগণের সহায়তায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন, বহির্বিশ্বের কোনো অর্থ সহায়তা ছাড়াই এত বড় একটি বিশাল স্থাপত্য তিনি নির্মাণ করতে পেরেছেন। তাই বাঙালি জাতির জন্য পদ্মা সেতু এক মহান গৌরবগাথা স্থাপত্যশৈলী। অতএব, বাঙালির অন্তরে ধারণ করে রাখার জন্য ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী দিনটিকে ‘জাতীয় গৌরব দিবস’ ঘোষণা করা হোক।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দসৈনিক (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র)।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর