বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

রসুলের প্রতি ভালোবাসা মোমিনের ইমানি দায়িত্ব

এম এ মান্নান

রসুলের প্রতি ভালোবাসা মোমিনের ইমানি দায়িত্ব

ভারতের দুজন অর্বাচীন রাজনীতিক মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পারিবারিক জীবন নিয়ে অপপ্রচার করে ভারতসহ সারা দুনিয়ায় তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছেন। আশার কথা, শুধু ভারতীয় মুসলমান নয়, সে দেশের সব ধর্মের মানুষ এ নোংরামির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। জনমতের চাপে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ওই দুজন হঠকারী রাজনীতিককে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেছে। মহানবী (সা.)-কে বলা হয় সব যুগের সেরা মানব। সেরা এবং শেষ রসুলও তিনি। সপ্তম শতাব্দীতে মহানবী (সা.)-এর অভ্যুদয় ছিল মানবসভ্যতার ইতিহাসের গৌরবজনক অধ্যায়।

মনীষী টমাস কার্লাইল ১৮৪০ সালে এডিনবার্গে আয়োজিত একটি সভায় ঘোষণা করেন, ‘শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই নয়, সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত দূত বা নবীদের মধ্যে নায়কের স্থান অধিকার করে রয়েছেন সুদূর আরবের হজরত মুহাম্মদ (সা.)।’ ‘জগতের আদিকাল থেকে আরবরা মরুভূমির মধ্যে বিচরণ করে বেড়াত অখ্যাত মেষপালক জাতি হিসেবে। সেখানে যখন পয়গম্বর প্রেরিত হলেন, আর অমনি জাদুর মতো সেই অখ্যাত জাতি হয়ে উঠল জগদ্বিখ্যাত। দীনহীন জাতি হয়ে গেল জগতের শ্রেষ্ঠ জাতি। তারপর এক শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিমে গ্রানাডা থেকে পূর্বে দিল্লি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হলো আরবদের আধিপত্য।

মনীষী পিয়েরে ক্রাবইটের মতে, ‘মুহাম্মদ (সা.) সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে নারী অধিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন।’ ডব্লিউ ডব্লিউ কেশ লিখেছেন, ‘প্রথমবারের মতো ইসলামই নারীদের মানবাধিকার দিয়েছে। দেহব্যবসার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। মদকে হারাম ও জুয়া খেলাকে মহাপাপ গণ্য করেছে।’ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এ সম্পর্কে জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপক এডওয়ার্ড মান্টো বলেন, ‘চরিত্র গঠন ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে মুহাম্মদ (সা.) যে সাফল্য অর্জন করেছেন সেদিক থেকে তাঁকে বিশ্বমানবতার মহান দরদি নেতা বলে প্রতীয়মান করা হয়।’ ইতিহাসবিদ গিবনের মতে, ‘হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর পদতলে দুশমনদের পেয়েও একে একে সব দুশমনকে মাফ করে দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থপন করেন, অনুরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আর নেই। সেই ঔদার্য ও ক্ষমাশীলতার দ্বিতীয় কোনো দৃষ্টান্ত আর দেখা যায় না।’ বিশ্বখ্যাত রুশ সাহিত্যিক লিও টলস্টয় ছিলেন মহানবী (সা.)-এর গুণমুগ্ধদের একজন। তিনি বলেন, ‘আমি মুহাম্মদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তাঁর আবির্ভাবের আগে পৃথিবী অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। তিনি সেই অন্ধকারে দীপ্ত বহ্নির মতো প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছিলেন। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি, মুহাম্মদের শিক্ষা ও দীন ছিল যথার্থ।’ খ্যাতনামা দার্শনিক ও হিন্দুধর্মের শীর্ষ ধর্মীয় নেতা স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, ‘হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সাম্যের, মানবতার ও সৌভ্রাতৃত্বের সুমহান দূত।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে দেওয়া এক শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, ‘যিনি মহত্তমদের মধ্যে অন্যতম, সেই পবিত্র পয়গম্বর হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উদ্দেশে আমি আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। মানুষের ইতিহাসে এক নতুন সম্ভাবনাময় জীবনশক্তি সঞ্চার করেছিলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি এনেছিলেন নিখাদ, শুদ্ধ ধর্মাচরণের আদর্শ।’  হজরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রসুল। একজন মুসলমান রসুল (সা.)-কে পরিবার-পরিজন, স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবা এবং ধনসম্পদের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। নিজের জীবনের চেয়েও বেশি রসুল (সা.)-কে ভালোবাসা যে কোনো মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। এমন ভালোবাসা না থাকলে কেউ প্রকৃত মুসলিম হতে পারে না। আল কোরআন ও হাদিসের একাধিক বর্ণনায় মোমিনদের রসুল (সা.)-এর প্রতি গভীর ভালোবাসা স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘নবী মোমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও অধিক ঘনিষ্ঠ।’ (সুরা আহজাব, আয়াত ৬) আল্লাহ আরও বলেন, ‘তোমাদের কাছে যদি তোমাদের পিতা তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধনস¤পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান যাকে তোমরা পছন্দ কর- আল্লাহ, তাঁর রসুল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তাহলে অপেক্ষা কর আল্লাহর (আজাবের) নির্দেশ আসা পর্যন্ত। আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে হেদায়েত দেন না।’ (সুরা তওবা, আয়াত ২৪)

এজন্য প্রত্যেক মুসলমানের অন্তরে নবীর প্রতি গভীর ভালোবাসা থাকা ইমানের দাবি। যার মাঝে নবীপ্রেম নেই তার মধ্যে ইমান নেই। তাই তো রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় হই।’ (বুখারি) হাদিসের এ দাবি প্রতিফলিত হয়েছিল সাহাবিদের বাস্তব জীবনে। রসুল (সা.) ছিলেন সাহাবিদের কাছে তাঁদের জীবনের চেয়েও প্রিয়। যারা রসুল (সা.) সম্পর্কে কুৎসা রটিয়েছে, অপপ্রচার চালিয়েছে তারা মানবতার শত্রু। তাদের মনেপ্রাণে ঘৃণা করতে হবে। রসুল (সা.)-এর প্রতি নিজেদের মমত্ববোধ আরও বাড়াতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রসুল (সা.)-এর প্রেমিক হিসেবে ভূমিকা রাখার তৌফিক দান করুন।

                ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর