মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধের পর সেরা বিজয়

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

মুক্তিযুদ্ধের পর সেরা বিজয়

পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হয়েছে। পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চল ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও মনোযোগ কাড়ায় গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্পকারখানা। এ সেতু দিয়ে বাংলাদেশ যুক্ত হতে পারবে এশিয়ান হাইওয়েতে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বাড়বে কর্মসংস্থান। পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতুর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর, মাদারীপুরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের ২১ জেলার সংযোগ ঘটেছে। ২১ জেলা হলো- খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে আছে চার লেনের সড়কপথ আর নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ।

২০০৬-০৭ সালে প্রকল্প প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত কিছু লোকের বিরুদ্ধে কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয় এবং অন্য দাতারাও তা অনুসরণ করে। এ ঘটনায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় ও সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়াকে জেলেও যেতে হয়। পরে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না পাওয়ায় কানাডিয়ান আদালত মামলাটি বাতিল করে দেয়। মিথ্যা অভিযোগের দায় থেকে মুক্তি পায় বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের অর্থায়নে ফিরে আসতে চাইলেও বাংলাদেশ রাজি হয়নি। প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

পদ্মা সেতু স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুধুই শেখ হাসিনার অবদান। ‘পদ্মা আমার মা’ গানটি যিনি লিখেছিলেন তিনি কি জানতেন প্রমত্তা পদ্মায় একদিন সেতু নির্মিত হবে। বাংলাদেশের অর্থনেতিক উন্নয়নে পদ্মার ওপর নিজ অর্থায়নে নির্মিত সেতু অযুত সম্ভাবনার জন্ম দেবে। আমাদের নিজের টাকায় পদ্মা সেতু হয়েছে। এটা জাতির জন্য বিরাট গৌরবের, আত্মমর্যাদার, সম্মানেরও বটে। আরেকটা কথা না বললেই নয়, পদ্মা সেতুর বদান্যতায় একসঙ্গে রেলসেতুও হতে যাচ্ছে। এটা অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটা বড় কিছু পাওয়া। আমাদের মনে রাখতে হবে, সেতুটি এমন এক নদীর ওপর, যা পৃথিবীর অন্যতম খরস্রোতা নদী। পদ্মা এমন এক নদী যেটি একেক সময় একেক রূপ ধারণ করে। ফলে নদী শাসন করে পদ্মা সেতু করতে গিয়ে মানের বেলায় আপসহীন হতে হয়েছে। পদ্মা সেতু তৈরি হয়েছে মূলত দেশি উপকরণ দিয়ে। সেতু তৈরিতে সবচেয়ে বেশি লাগে দুটি উপকরণ। একটি স্টিল, অন্যটি সিমেন্ট। আমাদের দেশে যথেষ্ট ভালোমানের সিমেন্ট ও স্টিল তৈরি হয়। শুধু স্টিল আর সিমেন্টই নয়, রড, বালু, পাথরসহ অন্য যেসব উপকরণ পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত হয়েছে তার সবই ছিল সর্বোচ্চ মানের। যারা এসব উপকরণ সরবরাহ করেছেন তারা সবাই ছিলেন সতর্ক। এও জাতির জন্য একটি বড় গৌরবের বিষয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাড়ে ৩ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকায় এক আলোর প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এ সেতু নির্মাণ ছিল সরকারের জন্য মর্যাদার লড়াই যা দাতা সংস্থাদের দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ সবকিছুই পারে। তাই এ সেতু নির্মাণের সফলতা আমাদের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর সবচেয়ে বড় বিজয়।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পরপরই ১৯৯৮ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে উদ্যোগের পথ ধরে ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয় এবং ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু পরবর্তী সাত বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় না থাকায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় পদ্মা সেতু প্রকল্পের গতি থমকে যায়। তারপর সৃষ্টিকর্তার পরম মহিমায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে প্রকল্পটি ফের গতি পায়। ২০০৯ সালের ১৯ জুন পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের প্রস্তাব মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে এবং ২৯ জুন চুক্তি হয় পরামর্শকের সঙ্গে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু হতে যাচ্ছে এর ইতিহাসের একটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়কপথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার অববাহিকায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান বসেছে, ৬.১৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মাণ হয় দেশটির সবচেয়ে বড় সেতু। সরকারের পরিকল্পনামাফিক ২০২১ সালের জুনে এটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা ছিল। পদ্মা সেতুর পাইল বা মাটির গভীরে বসানো ভিত্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বে গভীরতম। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত গেছে সেতুর অবকাঠামো। ১০ ডিসেম্বর বহুল কাক্সিক্ষত এ সেতুর সর্বশেষ স্টিলের কাঠামোর স্প্যান বসানো হয়। ৪১তম স্প্যান বসানোর পর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর পুরোটাই দৃশ্যমান হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমানতা শুরু হয় স্বপ্নের সেতুর। বাকি ৪০টি স্প্যান বসাতে তিন বছর দুই মাস লাগে। সড়ক ও রেলের স্লাব বসানো সম্পন্ন হলে সেতু দিয়ে যানবাহন ও ট্রেন চলতে পারবে। এতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সারা দেশের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে।

পদ্মা বহুমুখী সেতুর সম্পূর্ণ নকশা এইসিওএমের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল তৈরি করে। বাংলাদেশের প্রথম বৃহৎ সেতু পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করা হয়। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। এ প্যানেল সেতুর নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্প কর্মকর্তা, নকশা পরামর্শক ও উন্নয়ন সহযোগীদের বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদান করে। পদ্মা সেতুর ভৌত কাজকে মূলত কয়েকটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে যথা- (ক) মূল সেতু (খ) নদীশাসন (গ) জাজিরা সংযোগকারী সড়ক (ঘ) টোল প্লাজা ইত্যাদি। মাওয়া সংযোগকারী সড়ক, টোল প্লাজা ইত্যাদি এবং মাওয়া ও জাজিরা সার্ভিস এলাকা। প্রকল্পে নিয়োজিত নকশা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘মনসেল-এইকম’ ভৌত কাজের ঠিকাদার নিয়োগের প্রাক-যোগ্যতা দরের নথি প্রস্তুত, টেন্ডার আহ্বানের পর টেন্ডার নথি মূল্যায়ন, টেন্ডার কমিটিকে সহায়তাসহ এ-সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল নকশা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজ তদারক করত। ভৌত কাজের বিভিন্ন প্যাকেজের জন্য দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি।

প্রথম দিকে পদ্মার তলদেশের মাটি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় সেতু নির্মাণকারী প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের। তলদেশে স্বাভাবিক মাটি পাওয়া যায়নি। সেতুর পাইলিং কাজ শুরুর পর সমস্যা দেখা যায়। প্রকৌশলীরা নদীর তলদেশে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় মাটির বদলে নতুন মাটি তৈরি করে পিলার গাঁথার চেষ্টা করেন। স্ক্রিন গ্রাউটিং নামের এ পদ্ধতিতেই বসানো হয় পদ্মা সেতু।

প্রস্তাবিত পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে নির্দিষ্ট পথের মাধ্যমে দেশের কেন্দ্রের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সরাসরি সংযোগ তৈরি করবে। এ সেতুটি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। প্রকল্পটির ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪৪ হাজার বর্গ কিমি বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯% অঞ্চলজুড়ে ৩ কোটির বেশি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। ফলে প্রকল্পটি দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেতুটিতে ভবিষ্যতে রেল, গ্যাস, বৈদ্যুতিক লাইন ও ফাইবার অপটিক ক্যাবল সম্প্রসারণের ব্যবস্থা রয়েছে। সেতুটি নির্মাণের ফলে দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। পদ্মা বহুমুখী সেতু চালুর ফলে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকান্ড এবং অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষের জীবনে পরিবর্তন আসবে। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ বা কমপক্ষে ৩ কোটি মানুষ সরাসরি এ সেতুর মাধ্যমে উপকৃত হবে। এতে বলা হয়, এ সেতুর মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধ হবে, পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন হবে এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে। দেশের ওই অঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব গড়ে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত কমবে। বলেছে এ সেতু নির্মাণের ফলে দেশের আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে লক্ষণীয় অগ্রগতি হবে। মানুষ ও পণ্য পরিবহনের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে, যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি ও আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে। এডিবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সেতুর মাধ্যমে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকান্ড প্রসারের লক্ষ্যে পুঁজির প্রবাহ বাড়বে, পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের জন্য অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া স্থানীয় জনগণ উন্নততর স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য খুব সহজেই রাজধানী ঢাকা যেতে পারবে। এডিবির মতে, এ সেতুর ফলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ ও আঞ্চলিক জিডিপি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। সর্বোপরি পদ্মা বহুমুখী সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে এ সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে এ সেতু আসলেই দেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু হয়ে বাস্তবে ধরা দিয়েছে। জাতির জনকের স্বপ্ন পূরণের জন্যই যেন মহান আল্লাহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২১বার হত্যাচেষ্টা সত্ত্বেও বাঁচিয়ে রেখেছেন। শেখ হাসিনা আমাদের আশার বাতিঘর, বাংলাদেশের রক্ষাকবচ।

                লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর