বুধবার, ২৯ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

দর্শনবিহীন রাষ্ট্র পরিচালনা আর বৈঠা ছাড়া নৌকা চালনা একই কথা

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী

দর্শনবিহীন রাষ্ট্র পরিচালনা আর বৈঠা ছাড়া নৌকা চালনা একই কথা

আমাদের দেশে যদি সংক্ষেপে এই কথাটা বলতে হয় তাহলে বলতে হবে যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সবকিছুই তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। এমনকি যে দর্শনের ওপর বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সে দর্শনকেও তারা সেদিন শেষ করে দিয়েছে। বাঙালি জাতি অত্যন্ত ভাগ্যবান যে, এর ২১ বছর পর জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা যখন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, তিনি প্রথম যে কথাটি উচ্চারণ করেছিলেন তা হচ্ছে, আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি। তিনি ক্ষমতার কথা বলেননি। তারপর তিনি যে ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠন করলেন তখন তিনি কতগুলো দার্শনিক ভিত্তির কথা বললেন- এভাবে দেশ চালাতে হবে। সেগুলোর অনেক বিষয় আছে। আমি সংক্ষেপে বলছি। তিনি প্রথম দিকেই কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিলেন। এ কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলার পেছনে যে দর্শন কাজ করেছে তা হলো, অনেক জিনিস একসঙ্গে এ দর্শনের অধীন এসেছে। যেমন সাধারণ লোকজন, গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এত দিন তারা মূল চিকিৎসা- সেবার বাইরে ছিল। তারা চিকিৎসাসেবা পেল। ওখানে মেয়েদেরই কমিউনিটি ক্লিনিকের চাকরিতে প্রাধান্য দেওয়া হলো। এর ফলে গ্রামের সাধারণ পরিবারের মেয়েরা লেখাপড়ার দিকে আগ্রহী হলো। অর্থাৎ স্কুলে মেয়েদের ভর্তি সংখ্যা বেড়ে গেল। মেয়েদের শিক্ষার সংখ্যাও বাড়তে থাকল। একই সঙ্গে যেহেতু তারা লেখাপড়া করছে এবং তারা যদি এসএসসি পাস করতে পারে তাহলে কমিউনিটি ক্লিনিকে চাকরি পেতে পারে। সুতরাং বাল্যবিয়েও অনেকটা কমে গেল। তারপর যখন তারা পাস করল, অনেকে চাকরি পেল। অনেকের বিয়েও হয়ে যায়। তখন অনেক সময় দেখা যায় তাদের স্বামীরা অত্যাচার করে। কিন্তু একজন কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কারের গ্রামের জনগণের মধ্যে একটা নিজস্ব অবস্থান থাকার কারণে স্বামীরা তাদের ওপর বিনা কারণে কোনো অত্যাচার করার সুযোগ পেল না। আর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, আমাদের দাদি-নানিরা তাদের স্বামীর দ্বারা নিগৃহীত হলেও তাদের বলার কিছু ছিল না। কেননা তাদের অর্থনৈতিক কোনো সমর্থন ছিল না। বাবার বাড়িতে গেলে অনেকেই তাদের বোঝা মনে করত। সুতরাং তারা বাধ্য হয়ে স্বামীর ঘরে থাকত। অথচ যারা এ কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মী, তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। এ কারণে তাদের প্রতি কোনো অত্যাচার করার ক্ষমতা নেই। দর্শনের ভিত্তিতে দেশ চালানোর জন্য দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক কী করলেন? তিনি ইচ্ছা করলেই ক্ষুদ্র আকারে লোন দিতে পারতেন যে তোমরা স্বাবলম্বী হও এবং এ লোনে কোনো ইন্টারেস্ট নেই। কিন্তু তাতে অসুবিধা ছিল এই যে, যেদিন ওই ক্ষুদ্রঋণ সে পাবে সেদিন তার স্বামী যদি খারাপ ধরনের হতো তাহলে জোর করে টাকা নিয়ে নিত এবং নেশা করে বা তার খুশিমতো খরচ করে ফেলত। ওই মহিলার টাকা কোনো উপকারে আসত না। কিন্তু কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে তিনি নারীর ক্ষমতায়ন করলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা সমাজের অনেক কাজ করলেন। তিনি নারী শিক্ষা বাড়ালেন। যারা সমাজে অবহেলিত এবং মূলধারায় ছিল না, তাদের মূলধারায় আনলেন। লেখাপড়া থেকে শুরু করে, চাকরি থেকে শুরু করে, ক্ষমতা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই। অর্থাৎ এটা দর্শন ছিল। এর আগে যখন দেশ দর্শনবিহীনভাবে চলেছে তখন এমন অবস্থা ছিল যে, যার কোনো গন্তব্যস্থল ঠিক থাকে না, সমস্ত রাস্তাই তার গন্তব্য। কেননা তার কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থান নেই। কিন্তু দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক গন্তব্য ঠিক করলেন তাঁর দর্শন দ্বারা। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। এরপর আমরা যদি আসি তাহলে দেখতে পাব, পদ্মা সেতু চালু রোধ করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের তথাকথিত বন্ধুরা যারা আমাদের উন্নতি চাননি, যারা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির সঙ্গে তুলনা করেছেন তারাই এগুলো করছেন। আমাদের দেশের আইন রক্ষা করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একসঙ্গে কাজ করলে অবশ্যই এ ষড়যন্ত্র অচিরেই বন্ধ করা যাবে।

কিছু লোকের দায়িত্বই হচ্ছে সুশীলসমাজের নামে ডাক ছাড়া তারা দেশের কোনটা মঙ্গলজনক তা বলবেন না। তারা সব সময় উল্টোটাই বলবেন। অধিকাংশ মিডিয়া বা খবরের কাগজ এমনভাবে খবরগুলো পরিবেশন করছে যেন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়কের যে দর্শন সেগুলো চাপা পড়ে যায়। কারণ এখন পদ্মা সেতুর দিকে যাতে লোকের নজর না পড়ে সেজন্যই একের পর এক ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কিন্তু এ ষড়যন্ত্র টিকে থাকবে না। এখানে একটা গল্প বলতে চাই। তা হচ্ছে, গোয়েবলস ছিল হিটলারের প্রচারমন্ত্রী। তার কতগুলো থিওরি ছিল। যেমন একটি মিথ্যা কথা বারবার বললে সেটা লোকে বিশ্বাস করবে। এ রকম অনেক কথা, বানানো অনেক কিছু। গোয়েবলস তো অনেক আগে মারা গেছে, কিন্তু গোয়েবলসের আত্মা এসে এখন আপাতত বিএনপি মহাসচিবের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। তার জন্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হঠাৎ করে সেদিন আবিষ্কার করলেন, পদ্মা সেতু শুরু করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া! আমি কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি হিসেবে হয়তো হঠাৎ একদিন আমার জীবনে দেখব, যেহেতু এ কমিউনিটি ক্লিনিক খুব সাকসেসফুল হচ্ছে- এও করেছেন খালেদা জিয়া। এ কমিউনিটি ক্লিনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দর্শন। বরং যে কয় বছর খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন, সে সময় তারাই ষড়যন্ত্র করে কমিউনিটি ক্লিনিক চালাতে দেননি।

অবশ্যই রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার প্রতি, তাঁর দর্শনের প্রতি তাদের  ক্ষোভ-আক্ষেপ থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণ লোকজন বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তা নেই। দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক সব সময় বলেছেন, যদি লোকের স্বাস্থ্যকে আমি সুস্বাস্থ্যবান না করতে পারি, তাহলে তারা দেশের জন্য কোনো অবদান রাখতে পারবে না, বিশ্বের জন্যও কোনো অবদান রাখতে পারবে না। মূল কন্ডিশনই হচ্ছে তাদের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করে তোলা এবং এ সুস্বাস্থ্য একটি জায়গার দ্বারা করা যাবে না। তাই কমিউনিটি ক্লিনিক সেন্টার থেকে শুরু করে টারশিয়ারি সেন্টার। যেমন শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট। এটা ছিল বলে কত লোকের জীবন বেঁচে যাচ্ছে। যদি একটা হিসাব করা হয় যে, এই দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন কতটা আইসিইউ ছিল বাংলাদেশে, আর এখন তার চেয়ে কতগুণ বেশি আইসিইউ। আইসিইউ মানুষের জীবন বাঁচায়। জীবন বাঁচানোই তাঁর দর্শন।

এই যে বাজেট দেওয়া হলো, একটা কাউন্টার বাজেট তো কেউ দিতে পারল না। করোনার সময় কত কিছু বলা হয়েছে যে কিছুই হবে না, অথচ এত সুন্দরভাবে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক একে ম্যানেজ করলেন সে সম্পর্কে কোনো কিছু তো বলা হলো না। তখনো তারা কোনো কিছু বলতে পারেননি। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ককে বারবার ক্ষমতায় আনা। এর মূল কারণ হচ্ছে, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক ছাড়া এ দেশ সামনে এগোতে পারবে না এবং এ এগোনোর জন্য আমাদের দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে প্রয়োজন। আমাদের সবার স্বার্থেই প্রয়োজন। দেশ যদি থাকে তাহলে তো আমাদের ঠিকানা থাকবে। আমাদের পাসপোর্ট আছে। এ পাসপোর্ট তো থাকবে না, যদি দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশ সামনে এগিয়ে নিতে না পারেন। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, নৌকা চলতে গেলে যে হাল লাগে সে হালকে আমরা ঠিক রাখব কি না। আর আমাদের দেশের এখন একমাত্র হাল হচ্ছেন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। সুতরাং এ হালটা ঠিক রাখতে হলে আমাদের কিন্তু সবার দায়িত্ব আছে।

আমি কমিউনিটি ক্লিনিকের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়েছি। আমি সবচেয়ে অবহেলিত জনপদ যেটা সেখানে গেলাম। সেখানে একটি ছেলে ১১ বছর বয়সের। তাকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে মঙ্গা হতো জানো কি? সে বলল, ‘মঙ্গা কী জিনিস তা তো আমি জানি না’। ১১ বছরের স্কুলের ছেলে সে মঙ্গা শব্দটি শোনেনি। অর্থাৎ মঙ্গা দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক দূর করে দিয়েছেন। এর পেছনে একটি দর্শন কাজ করেছে। সে দর্শনটা হলো, তিনি মনে করেছেন, আমি যে রাষ্ট্র পরিচালনা করি সেখানে কেউ না খেয়ে থাকবে না। সেখানে কোনো লোক কোনো কষ্ট ভোগ করবে না। সেজন্যই তো তিনি একটি স্থায়ী পন্থা অবলম্বন করে মঙ্গা দূর করতে পেরেছেন। যার জন্য ওই স্কুলছাত্র মঙ্গার নামই শোনেনি। এককভাবে আমি বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছি এবং তাতে দেখতে পাচ্ছি যে, এ হালবিহীন দেশ এখন আর বাংলাদেশ নয়। এই হাল হচ্ছেন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক এবং তাঁর একটি দর্শন আছে এবং একের পর এক দর্শন তিনি বাস্তবায়ন করতে পারছেন। সুতরাং আমি বলতে চাই, সম্প্রতি দেখে এলাম উত্তরবঙ্গ। তাতে মনে হয়, উত্তরবঙ্গের সব লোক এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে (আমি যেসব অঞ্চলে গিয়েছি) যে, তারা চেনে শুধু দর্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে। তারা তাকেই নির্বাচিত করতে চায়। এখন নির্বাচন কীভাবে হবে তা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব।

আমি একটি খবর দেখে খুব অবাক হয়ে গেলাম। সম্প্রতি অতীতে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনার, তাঁরা বলেছেন বিএনপিকে অংশগ্রহণ করানো প্রয়োজন। এখন নির্বাচন যে আইন মতোই হবে এটা নির্দিষ্ট। এখন তাদের দলকে তো আর কোলে করে নিয়ে আসা যাবে না। দলের তো নিজস্ব দর্শন থাকে। তারা তো এখনো বলছে, এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না। তাহলে তারা কোন প্রসেসে যাবে এ সংবিধানের মধ্যে সেই পন্থা তারা বলে দিক। তারা বলবেই বা কীভাবে। তাদের তো কোনো দর্শন নেই। খবরের কাগজে খবর হওয়ার জন্য তারা এসব বলে। না হলে কোনো দলকে আরেক দল যে বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল তাদের আনতে পারে নির্বাচনে এ রকম উদাহরণ তো পৃথিবীতে নেই। তাই আমার শেষ কথা হলো, যেহেতু প্রধানমন্ত্রী দর্শন নিয়ে দেশ চালান, সেজন্যই দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকেই বারবার আমাদের দেশের জন্য, আমাদের সবার জন্য প্রয়োজন। সে প্রয়োজনীয়তা এখনো আছে এবং অদূর ভবিষ্যতেও থাকবে।

 

লেখক : সাবেক উপদেষ্টা, চেয়ারম্যান, বিএমআরসি।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর