বুধবার, ২৯ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

পদ্মা সেতু এবং ঢাকার যানজট

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

পদ্মা সেতু এবং ঢাকার যানজট

দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বাঙালি জাতির স্বপ্ন এখন বাস্তব। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অজুহাতে অর্থায়ন থেকে যখন সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক, তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখে দুর্বার গতিতে স্বদেশ গড়ার এক অসামান্য লড়াইয়ে যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, ঠিক সেভাবেই পদ্মা সেতুর হাল ধরেন তিনি। তাই পদ্মা সেতু বাঙালি জাতিকে অপমান করার প্রতিশোধ, বাঙালির আবেগ, অহংকার ও গৌরবের প্রতীক। এটি আমাদের সামর্থ্য, সাহস ও সক্ষমতার প্রতীক। আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের এক উজ্জ্বল মাইলফলক। এটি বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রত্যয়, দৃঢ় মনোবল, আস্থা, সততা, আত্মবিশ্বাস ও অসম সাহসের সোনালি ফসল। অবহেলিত  দক্ষিণ বাংলার নতুন সম্ভাবনা, নতুন দিগন্ত। কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্য- সব ক্ষেত্রেই এ সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা ও সুন্দরবন সংলগ্ন ছোট ছোট বিভিন্ন দ্বীপ পর্যটন উপযোগী হবে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন ও পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে দেখা দেবে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। এটি শুধু একটি সেতুই নয়, এটি আমাদের উন্নয়ন, অহংকার, আত্মমর্যাদা, আত্মপরিচয় ও যোগ্যতার প্রতীক। সর্বোপরি বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের স্বপ্ন। এ সেতু শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই এক বিস্ময়।

এ সেতুর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাসের এ সেতুর ওপরের স্তরে চার লেনের সড়কপথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে। ৪২টি পিলার ও ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে মূল সেতুর অবকাঠামো তৈরি করা হয়। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১০ মিটার (৭২ ফুট)। সেতুর নিচতলা দিয়ে যাচ্ছে গ্যাসের পাইপলাইন যা পৌঁছাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায়। সেতুতে রয়েছে ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট, সেতুর বাইরে আছে আরও প্রায় ২০০ বাতি। সেতুর দুই প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটারসহ মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সেতুটি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখবে। ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪৪ হাজার বর্গকিমি (১৭ হাজার বর্গমাইল) বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯% অঞ্চলজুড়ে ৩ কোটির অধিক মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। প্রকল্পটি দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ সেতুটি নির্মিত হলে বাংলাদেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে ইতিহাসের অংশ হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে দেশে-বিদেশে। চলছে নবজাতকদের নাম রাখার হিড়িক। নারায়ণগঞ্জে অ্যানি বেগম (২৪) নামে এক গৃহবধূ একসঙ্গে তিন সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এবং তাদের নাম রেখেছেন স্বপ্ন (ছেলে), পদ্মা ও সেতু (দুই মেয়ে)। কুমিল্লার বরুড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঝুমুর আক্তারের যমজ মেয়েসন্তানের নাম রাখা হয়েছে পদ্মা ও সেতু। এদিকে সেতু উদ্বোধনের দিন গোপালগঞ্জের সারজিনা হোসাইন তৃমাকে বিয়ে করলেন তার প্রেমিক সাভারের বাসিন্দা হাসান মাহমুদ। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে ৪০ ফুট উচ্চতার দুটি ম্যুরাল নির্মিত হয়েছে, একটি বঙ্গবন্ধুর, অন্যটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি।

এ সেতু হওয়ায় যাত্রাবাড়ীর হানিফ ফ্লাইওভার সংলগ্ন গোলচত্বর থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা মোড় যেতে লাগবে মাত্র ৪০-৪৫ মিনিট। ফলে দক্ষিণবঙ্গের মানুষ সকালে ঢাকায় এসে বিকালে বাড়ি ফেরত যেতে পারবে। তাই আগের চেয়ে যানবাহনের সংখ্যা ঢাকায় বেশি হবে এবং সে কারণে যাতে শহরে ট্রাফিক জ্যাম না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, ঢাকা শহরে গাড়ির গতি মানুষের চেয়েও কম। ২০০৫ সালে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটের কারণে ঢাকা শহরে ঘণ্টায় গাড়ির গড় গতি ছিল প্রায় ২১ কিলোমিটার। একই গবেষণায় এ বছরের রমজানে প্রথম দিন (৩ এপ্রিল পর্যন্ত) ঢাকায় গাড়ির গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার, যা একজন অসুস্থ মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, একজন সুস্থ মানুষ স্বাভাবিক গতিতে ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার বেগে হাঁটতে সক্ষম। অর্থাৎ ঢাকায় এখন একজন সুস্থ মানুষের হাঁটার গতি গাড়ির চেয়েও বেশি। ঢাকার ট্রাফিকব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম বিশৃঙ্খল ট্রাফিকব্যবস্থার একটি। যে কোনো শহরের জন্য আয়তনের ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আর ঢাকায় আছে মাত্র ৭.৫ শতাংশ। প্যারিস আর ভিয়েনায় রাস্তা রয়েছে ২৫ শতাংশ। ওয়াশিংটন আর শিকাগোয় এর পরিমাণ ৪০ শতাংশ। ঢাকার জন্য আরও একটি বড় সমস্যা হলো বিচিত্র গতির যানবাহন। এখানে একই সঙ্গে রিকশা, মোটরগাড়ি, স্কুটার, হিউম্যান হলার, ঘোড়ার গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেট কার চলাচল করে। প্রতি বছর শহরটিতে অতিরিক্ত ৩৭ হাজার গাড়ি যোগ হচ্ছে। আর শহরটিতে চলাচল করা ৭ লাখ রিকশা অন্য যানবাহনের গতিও কমিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থায় গতিময় পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যখন বিশাল গাড়ির বহর ঢাকায় ঢুকবে তখন যাতে যানজটের এ অবস্থা কোনোভাবে বৃদ্ধি না পায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। পদ্মা সেতুর দুই পাশে একাধিক বৃহদাকার বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা যেতে পারে। জরুরি খাদ্য, ওষুধ এবং অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য বাসগুলোকে ওই টার্মিনালে যাত্রা সমাপ্ত করা এবং ভবিষ্যতে ওই টার্মিনাল পর্যন্ত বিশেষ মেট্রোরেল চালু করা যেতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর